হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সংকট, বগুড়ায় সাতজনের মৃত্যু

হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সংকটের কারণে বগুড়া মোহাম্মাদ আলী হাসপাতালে ৭ জনের মুত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল নয়টা পর্যন্ত ১৩ ঘণ্টায় ওই সাতজনের মৃত্যু হয়েছে।
আরও অন্তত ১৫ জনের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। মুমূর্ষু করোনা রোগীরা প্রয়োজনীয় অক্সিজেন না পাওয়ায় এ নিয়ে দু-সপ্তাহে অন্তত ২৫ জন মারা গেছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক জানিয়েছেন।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নুরুজ্জামান সঞ্চয় সাতজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে বিভিন্ন জেলা থেকে রোগীরা ভর্তি হতে আসছেন খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা নিয়ে। তারা আগে থেকেই শারীরিকভাবে বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছিলেন। অবশ্য করোনা হওয়ার পর তাদের অক্সিজেন লেভেলও খুব কম। মূলত মৃত্যু হচ্ছে, অক্সিজেন ঘাটতির কারণে। হাসপাতালেও হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সংকট রয়েছে। এ কারণে ক্রিটিকাল রোগীদের হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ার করোনার জন্য বিশেষায়িত ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে আজ শুক্রবার (২ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত প্রায় ২২৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ প্রয়োজন। কিন্তু, হাসপাতালটিতে বর্তমানে মাত্র দুটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে। এ কারণে দুজনের অতিরিক্ত আর কোনো রোগীকে উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যেসব রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন (রক্তে ঘনীভূত অক্সিজেনের মাত্রা) ৮৭–এর নিচে রয়েছে তারা সংকটে রয়েছেন।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ার তিন হাসপাতালে (মোহাম্মদ আলী, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি টিএমএসএস হাসপাতাল) করোনা ওয়ার্ডে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা আছে ২৩টি। এর মধ্যে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ২টি, শজিমেক হাসপাতালে ১১টি এবং বেসরকারি টিএমএসএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০টি।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, এই হাসপাতালে রোগীর যে পরিমাণ চাপ, সেখানে অন্তত ২০টি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা প্রয়োজন, বিপরীতে আছে মাত্র দুটি। এতে হিমশিম খাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাবে গত ২৪ ঘণ্টায় বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ও শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মিলে মারা গেছেন ১১ জন। তবে আজ শুক্রবার সকাল ৮টার পর মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আরও দুজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এই হিসাবে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে (শজিমেক) ৬ জন করোনা রোগীর মৃত্য হয়েছে।
শজিমেক হাসপাতালের উপপরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, আমাদের এখানে তিনজনকে হাইফ্লো অক্সিজেন দেওয়া ছিল। তারপরও তারা মারা গেছেন। অন্য তিনজনও করোনায় মারা গেছেন।
বগুড়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩ জনের মৃত্যুর বিষয়টি শুক্রবার দুপুরে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নুরুজ্জামান এবং বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন মোস্তাফিজুর রহমান তুহীন।
জেলা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. সাজ্জাদ-উল-হক জানান, বগুড়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৮০টি নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত হয়েছেন ১০০ জন। নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে জেলায় করোনা শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ৩১ শতাংশ।
দেশে প্রথম দফায় করোনা শুরুর পর বগুড়ার ২৫০ শয্যার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালকে করোনা রোগীদের বিশেষায়িত হাসপাতাল করা হয়। প্রথমে এখানে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু ছিল না। ওই সময় সিলিন্ডার দিয়ে করোনা রোগীদের অক্সিজেন দেওয়া হতো। বিভিন্ন চিঠি চালাচালির পর একই বছরের জুনের শেষ দিকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের সুবিধাযুক্ত ৫০ শয্যার করোনা ইউনিট চালু করা হয়। এরপর শজিমেক হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে ১৩টি আইসিইউসহ ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। পরে চাহিদার প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের এপ্রিলে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ চালু করা হয়।
বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নুরুজ্জামান সঞ্চয় জানান, এখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ চালু হলেও সব শয্যায় উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এখানে আট শয্যার আইসিইউ ইউনিট রয়েছে। অথচ মাত্র দুটিতে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে। ফলে পুরো হাসপাতালের মধ্যে আইসিইউ ইউনিটের ওই দুটি শয্যায় কেবল উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে।
আবাসিক এ চিকিৎসক আরও বলেন, ফেস মাস্ক দিয়ে একজন করোনা রোগীকে প্রতি মিনিটে মাত্র পাঁচ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব। অন্যদিকে, রিব্রিদার মাস্ক দিয়ে প্রতি মিনিটে ১৫ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। আর হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দিয়ে একজন রোগীকে প্রতি মিনিটে ৬০ লিটার অক্সিজেন দেওয়া যায়।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শফিক আমিন বলেন, আমাদের এই হাসপাতালে এখন যেসব রোগী আসছেন, তাদের বেশির ভাগেরই অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৬০ থেকে ৭২-এর মধ্যে। তাদের হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দিয়ে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের হাসপাতালে শুধু আইসিইউ ইউনিটের দুটি শয্যায় ওই ব্যবস্থা রয়েছে, যে কারণে বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অক্সিজেন–সংকটের কারণে বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে শুক্রবার বেলা ৯টা পর্যন্ত ১৩ ঘণ্টায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছে এবং আরও অন্তত ২০ জনের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এখন পর্যন্ত করোনায় মোট আক্রান্ত হলেন ১৪ হাজার ৭৩ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১২ হাজার ৭৪৮ জন। বর্তমানে জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৯১৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টার নতুন মৃত্যু নিয়ে জেলায় মোট মৃত্যুসংখ্যা ৪১০–এ দাঁড়িয়েছে। তবে শুক্রবার সকাল ৮টার পরে নতুন দুজনের মৃত্যু আগামী ২৪ ঘণ্টার হিসাবে ধরা হবে। এই দুজনসহ জেলায় এখন পর্যন্ত মোট ৪১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।