স্বল্প খরচে অভিবাসন সুবিধা সত্ত্বেও সরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারক সংস্থা যেখানে ব্যর্থ

সবচেয়ে কম খরচে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়ে থাকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল)। তা সত্ত্বে গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটি মোট প্রবাসীদের মধ্যে মাত্র শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ কর্মীকে দেশের বাইরে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। এতে বৈদেশিক শ্রমবাজারে প্রতিষ্ঠানটির দুর্বল অবস্থান সহজেই দৃশ্যমান।
নিরাপদ অভিবাসন ও ভালো কাজের সন্ধান দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির মূলমন্ত্র হলেও আমলাতন্ত্র, অপর্যাপ্ত তহবিল এবং শ্রমবাজার বিশ্লেষণের সীমিত সক্ষমতার কারণে দুটি ক্ষেত্রেই তারা দক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ।
১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বোয়েসেল বিদেশে মাত্র এক লাখ পাঁচ হাজার শ্রমিক পাঠাতে পেরেছে। অন্যদিকে, একই সময়ে দেশের মোট রপ্তানিকৃত জনশক্তির সংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ। অর্থাৎ, চাকরি প্রত্যাশীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করেও বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানিতে রিক্রুটিং এজন্সি এবং দালালরা বেশি সফল।
সরকারি প্রতিষ্ঠানটি দ্বিপাক্ষিক সরকার চুক্তি অনুযায়ী জর্ডান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বিশেষভাবে কর্মী পাঠিয়ে থাকে। এছাড়া, এটি আরও ৩০টি দেশেও কর্মী পাঠিয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানার আগে গত এক দশকে প্রতি বছর গড়ে সাত লাখ কর্মী দেশের বাইরে গেছেন। অথচ গত পাঁচ বছরে দেশের একমাত্র সরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটি বার্ষিক প্রায় ১০ হাজার কর্মী বিদেশে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। এর আগে এই সংখ্যা ছিল আরও কম।
মহামারি চলাকালে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মাঝে গত বছর দুই লাখ ১৭ হাজার কর্মী কাজে যোগ দিতে দেশের বাইরে যান। এরমধ্যে, বোয়েসেল ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মাত্র আট হাজার ৮২৫ জন কর্মীকে বিদেশ পাঠায়।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচীর প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বোয়েসেল প্রতি বছর এক লাখ কর্মীকে দেশের বাইরে পাঠাতে পারলে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো প্রতিযোগিতার মুখে তাদের খরচ কমাতে বাধ্য হতো।
তবে দুর্নীতিমুক্ত অভিবাসন নিশ্চিত করতে বোয়েসেল সফল হয়েছে বলে মন্তব্য করেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেশন মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী।
'বোয়েসেলের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো কর্মী প্রতারিত হওয়ার তথ্য আমাদের কাছে নেই। এটি একটি বিরাট সাফল্য। এখন চ্যালেঞ্জ হলো বেশি করে কর্মী পাঠানো,' বলেন তিনি।
দুর্নীতিমুক্ত অভিবাসন প্রসারে যা প্রয়োজন
কর্মসংস্থান সন্ধানের পূর্বশর্ত হলো নিয়োগদাতার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। বোয়েসেলের কোম্পানি সেক্রেটারি আবদুস সোবহান বলেন, বিদেশে চাকরির বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি সময়মতো তথ্য পায় না।
'বেসরকারি সংস্থাগুলো গন্তব্য দেশগুলোতে দালালদের সহায়তার কর্মসংস্থানের সন্ধান পেয়ে থাকে, তবে আমাদের এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের বিদেশি মিশনগুলো প্রত্যাশিত কর্মসংস্থানের তথ্য দিতে ব্যর্থ,' বলেন তিনি।
বোয়েসেলের চেয়ারম্যান এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, বোয়েসেলও বেসরকারি সংস্থার মতো চাকরির সন্ধানে মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়োগ করলে অভিবাসন খরচ বৃদ্ধি পাবে, যা প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্যের বিপরীত।
তবে আরএমএমআরইউ'র চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকীর মতে, বোয়েসেল তার বদ্ধ আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার বাইরে যেতে পারবে না।
'বেসরকারি রিক্রুটিং সংস্থাগুলোর মতো এই খাতে কাজ করার পর্যাপ্ত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠানটির নেই,' বলেন তিনি।
তাসনিম আরও বলেন, 'গন্তব্য দেশে বেসরকারি সংস্থাগুলো তুমুল প্রচারণা চালায়। বোয়েসেলের দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানোর মতো তহবিল বা সক্ষমতা নেই।'
তবে আহমেদ মুনিরুছ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিষয়টি উড়িয়ে দেন।
তিনি বলেন, বোয়েসেল সম্প্রতি বৃহৎ শ্রমবাজারগুলোতে কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগদান।
'মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ অব্যাহত আছে,' বলেন তিনি।
আমলাতন্ত্র প্রতিস্থাপন করে তাসনিম বোয়েসেল পরিচালনায় বেসরকারিভাবে চুক্তিভিত্তিক লোক নিয়োগ করার পাশাপাশি অভিবাসন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পরামর্শ দেন।
'এই ব্যবস্থা মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়া কীভাবে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী পাঠানো সম্ভব তা দেখিয়ে দেবে,' বলেন তিনি।
এ পর্যন্ত অর্জিত সাফল্য
নির্বাচিত চাকরি প্রত্যাশীদের কাছ থেকে 'নো প্রফিট-নো লস' ভিত্তিতে পরিষেবা খরচ বা সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করে থাকে বোয়েসেল। চাকরির ধরন, দেশ ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সার্ভিস চার্জ ১২ হাজার টাকা থেকে ৬৮ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, বেসরকারি এজেন্সিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে কর্মী পাঠাতে দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে চার লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে।
তবে বোয়েসেল মূলত জর্ডান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকারের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির অধীনে কর্মসংস্থানগুলো নির্বাচন করে থাকে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) জানায়, এই দেশগুলোতে গন্তব্যের ক্ষেত্রে বোয়েসেল একক সুবিধা ভোগ করে থাকে।
'এই গন্তব্য দেশগুলোতে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে আমরা সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন পাচ্ছি না। কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান যদি নির্দিষ্ট দেশে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে এককভাবে বাজার দখল করে, তাহলে এই খাতের সমৃদ্ধি সম্ভব নয়,' বলেন বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী।
রিক্রুটিং সংস্থাগুলোর সংযোগ আছে- এমন গন্তব্য দেশগুলোতেও বোয়েসেল কর্মী পাঠাতে পারবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি।
তবে বোয়েসেল চেয়ারম্যান ড. আহমেদ মুনিরুছের দাবী, গন্তব্য দেশগুলোই বোয়েসেলের সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
'অন্যথায়, বেসরকারি রিক্রুটিং সংস্থার সঙ্গে টিকে থাকার সম্ভাবনা ছিল কম,' বলেন তিনি।
বোয়েসেল প্রায় ৩০টি দেশে কর্মী পাঠিয়ে থাকে, যার অধিকাংশই জর্ডান ও দক্ষিণ কোরিয়ায়।
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটি দক্ষ নারী পোশাক শ্রমিকদের দেশের বাইরে পাঠানো শুরু করে। এখন পর্যন্ত ১৭ হাজার ৭৫০ টাকা খরচে ৬০ হাজার ৬৭৫ জন কর্মীকে জর্ডানে পাঠানো হয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারা বিমান ভাড়া বহন করেছে।
এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেমের (ইপিএস) অধীনে বোয়েসেলের দ্বিতীয় বৃহৎ গন্তব্যস্থল হলো দক্ষিণ কোরিয়া। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী সেখানে কর্মী পাঠানো হয়ে থাকে।
২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ২১ হাজার ২৬০ জন কর্মীকে দক্ষিণ কোরিয়া পাঠায়। পরিষেবা ব্যয় হিসেবে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩৪ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়।