রপ্তানি পণ্যের সংকট সমাধানে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়বে অতিরিক্ত দুটি জাহাজ

তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ সংকট নিরসনে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে অতিরিক্ত আরও দুটি কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ১০টি কন্টেইনার জাহাজ ভেড়ানো হয়। তা বাড়িয়ে ১২টি করা হচ্ছে।
একইসঙ্গে, জায়গা খালি করার জন্য বন্দরের ইয়ার্ড ও আইসিডি থেকে ২০ ফুট আকারের প্রায় আড়াই হাজর খালি কন্টেইনার দ্রুত ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সোমবার (১২ জুলাই) চট্টগ্রাম বন্দর ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত আমদানি রপ্তানি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কর্মপরিকল্পনা বিষয়ক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বৈঠকে চট্টগ্রাম বন্দরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন বিজিএমইএ, শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কন্টেইনার ডিপো'স অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাস অ্যাসোসিয়েশন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জাহাজ সংকটের কারণে ১৯ টি বেসরকারি আইসিডিতে সোমবার পর্যন্ত ১৫,৫৩৩ টিইউ'স (টুয়েন্টি ফিট ইকুয়েভিলেন্ট ইউনিট) রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার পূর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অথচ আইসিডিগুলোর ধারণ ক্ষমতা মাত্র ১০,০০০ টিইউ'স কন্টেইনার।
কন্টেইনার সংকটে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক, লরি আইসিডি গেটে দাঁড়িয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবে কন্টেইনার পণ্য লোড হওয়ার ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে জাহাজীকরণ হলেও বর্তমানে ১৫ দিনেও জাহাজীকরণ সম্ভব হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে ১০টি কন্টেইনার জাহাজ বার্থিং দেওয়া হয়। রপ্তানি পণ্য দ্রুত জাহাজীকরণের লক্ষ্যে ১২টি কন্টেইনার জাহাজ বার্থিং দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০ ফুট সাইজের ২ থেকে আড়াই হাজার খালি কন্টেইনার ট্রান্টশিপমেন্ট বন্দরে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, মেইন লাইন অপারেটরের মধ্যে মায়ের্কস লাইন বর্তমানে সিঙ্গাপুর রুটে বেশি পণ্য পরিবহন করে। প্রতিষ্ঠানটিকে চট্টগ্রাম- কলম্বো রুটে জাহাজ পরিচালনা বাড়াতে অনুরোধ করা হয়।
এছাড়া ঈদের ছুটিতে গার্মেন্টস বন্ধ থাকে। এই সময়ে রপ্তানি নির্বিঘ্ন থাকলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। যেসব আইসডিতে তুলনামূলক স্থান খালি আছে, সেসব আইসিডিতে কন্টেইনার স্থানান্তর করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় যেসব সিন্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে টেকনিক্যাল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এই সভা।
বিজিএমইএ যে ১০ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে, সেগুলো সোমবারের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে।
সংকট সমাধানে বিজিএমইএ'র ১০ দফা প্রস্তাব
এদিকে তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণের ক্ষেত্রে বর্তমান যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনকল্পে ১১ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে ১০ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি সৈয়দ ফারুক হোসেন।
এর আগে গত ৭ জুলাই জুম প্ল্যাটফর্মে চট্টগ্রাম বন্দরের রপ্তানি কন্টেইনার জাহাজীকরণে সমস্য সৃষ্টি হওয়ায় একটি সভার আয়োজন করে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়।
বন্দর চেয়ারম্যানকে দেওয়া বিজিএমইএ'র সভাপতির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মেইন লাইন অপারেটর (এমএলও) করোনার কারণে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় ফরোয়ার্ডারকে কন্টেইনার দিয়ে ও রপ্তানি পণ্য ভর্তি কন্টেইনার প্রাইভেট আইসিডি থেকে জাহাজীকরণের ব্যবস্থা নিচ্ছে না। পরিবহন চুক্তি থাকা স্বত্ত্বেও রপ্তানি পণ্য বোঝাই করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খালি কন্টেইনার আনছে না এবং রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেইনার আইসিডিতে খালি পড়ে থাকায় সেখানে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। এ কারণে শত শত রপ্তানি চালানের ট্রাক বিভিন্ন আইসিডি গেইটে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে রপ্তানিকারকদের ট্রাকে ডেমারেজ দিতে হচ্ছে।
এছাড়া, রপ্তানিকারকদের ২ থেকে ৩ গুণ বেশি ট্রাক ভাড়া দিতে হচ্ছে।
বিজিএমইএ'র প্রস্তাবনায় আরও রয়েছে:
- চীন ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বন্দরের সঙ্গে ফিডার জাহাজ পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা। রপ্তানি কন্টেইনার জাহাজীকরণের নমিনেশন প্রাপ্ত বায়ারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ শিপিং কোম্পানিগুলোকে তলব করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক খালি কন্টেইনার সরবরাহ এবং রপ্তানি পণ্য বোঝাইকৃত কন্টেইনার দ্রুত জাহাজীকরণ করে রপ্তানি কার্যক্রম সচল রাখার জন্য জাতীয় স্বার্থে জরুরি নির্দেশনা প্রদান করা।
- যেহেতু নির্ধারিত শিপিং কোম্পানি ছাড়া পণ্য জাহাজীকরণ সম্ভব হচ্ছে না, তাই বন্দরের মাধ্যমে বিদেশি ক্রেতার নমিনেশন প্রাপ্ত শিপিং কোম্পানির রপ্তানি পণ্য পরিবহনে বাধ্য করা। শিপিং কোম্পানি সমূহের খালি কন্টেইনার সমূহ ফোর্স শিপমেন্ট বন্ধ করা। বন্দর জেটিতে রপ্তানিবাহী কন্টেইনার সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত স্থানের ব্যবস্থা করা।
- নতুন জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে দ্রুত অনুমতি প্রদান করা এবং বর্হিনোঙ্গরে জাহাজের অবস্থানকাল কমানোর জন্য বার্থিং সুবিধা নিশ্চিত করা। বর্তমানে রপ্তানিতে ৪০ ফুট সাইজের কন্টেইনার স্বল্পতায় ২০ ফুট সাইজের কন্টেইনারের মাধ্যমে রপ্তানি চালান পরিবহনের ব্যবস্থা করা এবং মাদার ভেসেলের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। বিভিন্ন এমএলও ও ফিডার অপারেটরদের মধ্যে কমন ক্যারিয়ার এগ্রিমেন্ট ও কন্টেইনার ডাইরেক্ট ইন্টারচেইঞ্জের প্রথা চালুর নির্দেশনা প্রদান করা।
এদিকে, বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, জাহাজ সংকটের কারণে আইসিডিগুলোতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা সহসা কাটছে না। তবে কোরবানির ঈদের ছুটিতে পোশাক শিল্প কারখানা বন্ধ থাকলে তখন আইসিডিগুলোতে পণ্য আসা বন্ধ থাকবে। এই সময়ের মধ্যে জমে থাকা রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ করা গেলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে।
বিজিএমইএ'র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সোমবারের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বর্তমান সংকট কিছুটা হলেও কমে আসবে। বিশ্বের অন্যান্য বন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন রুট চালু করা গেলে এই সংকট সমাধান সম্ভব।