ময়মনসিংহে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ক্লিনিক-হাসপাতাল

নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ময়মনসিংহ শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে শত শত বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতাল। হাসপাতালের মধ্যে সনদ রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের। নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের সনদও। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নাকের ডগায় বসে বছরের পর বছর ব্যবসা চালিয়ে গেলেও দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থাই নেয় না স্বাস্থ্য বিভাগ। খোদ প্রাইভেট ক্লিনিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স মেয়াদ উত্তীর্ণ। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সনদ বিহীন হাসপাতাল ও ক্লিনিক
ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়া এলাকা। এখানে অলিগলিতে গড়ে উঠেছে প্রায় ২০০ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। হাসপাতালগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলছে চিকিৎসা; হচ্ছে অপারেশনও।
ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য বলছে, শহরের মাত্র আটটি হাসপাতাল-ক্লিনিকের বৈধ কাগজপত্র রয়েছে; আর বৈধ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা মাত্র ১৭টি। বাকিগুলো চলছে নিয়ম-নীতি না মেনে।
ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. তৌফিক হাসান বলেন, আমরা যখন পরিদর্শনে যাই, কোথাও মানসম্মত পরিবেশ পাই না। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের অপারেশন থিয়েটারগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। অপারেশন করার কোনো পরিবেশ সেখানে থাকে না। অনেক জায়গায় মরিচা পড়া যন্ত্রপাতি দেখেছি। এ সব ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

এ বিষয়ে হাসপাতাল ক্লিনিক মালিকরা কথা বলতে রাজি না হলেও তাদের পক্ষে কথা বলছেন প্রাইভেট ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ময়মনসিংহ-এর সাধারণ সম্পাদক ডা. হোসাইন আহমদ তারা গোলন্দাজ।
নিয়ম না মেনে চলা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, 'যারা আইন মানে না, লাইসেন্স করে না বা নবায়ন করে না- তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া উচিত।'
এ সময় সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যমতে তার নিজের প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্সের লাইসেন্স মেয়াদ উত্তীর্ণ; এমনকি তার প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো সনদও নেই জানালে তিনি অপ্রস্তুত হয়ে যান।
তিনি জানান, কিছু জটিলতার কারণে লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। দ্রুত লাইসেন্স করে ফেলবেন বলে জানান তিনি ।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ময়মনসিংহের আঞ্চলিক সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শিব্বির আহমদ লিটন বলেন, জেলায় প্রতিদিনই নতুন নতুন হাসপাতাল গড়ে উঠছে। সেগুলোর বেশির ভাগেরই নেই কোনো সনদ। চিকিৎসক না হয়েও চিকিৎসা দেওয়ার খবর পাওয়া যায়। অবৈধভাবে চলতে থাকা এ সব প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। গুনতে হচ্ছে কাড়ি কাড়ি অর্থ। বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবার নামে ওখানে শুধু বাণিজ্য চলছে। তিনি অভিযোগ করেন, 'সব দেখেও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে।'
ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন ডা. এ বি এম মসিউল আলম জানান, বেসরকারি এ সব হাসপাতালকে তারা নিয়মিত মনিটর করছেন। কোথাও নিয়মের ব্যতয় ঘটলে সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। যদিও আজ পর্যন্ত অনিয়মের কারণে কোন কোন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে- তার কোনো রেকর্ড তিনি দেখাতে পারেননি।
পরিবেশ অধিদপ্তর ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিচালক ফরিদ আহমেদ জানান, হাসপাতালগুলোতে মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানের মালিকরা আইন মানতে নারাজ। তাই আবেদন করলেও সরেজমিনে দেখার পর আর ছাড়পত্র দেওয়া যাচ্ছে না।

ভুল রিপোর্ট
ময়মনসিংহে মানহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় হচ্ছে ভুল। ওষুধেও ধরা পড়ছে ভেজাল। এ নিয়ে বিপাকে রোগীরা। শিকার হতে হচ্ছে ভুল চিকিৎসারও। কিভাবে নিয়ম না মেনে হচ্ছে রোগের পরীক্ষা, প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ? তার ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে।
গফরগাঁওয়ের যুবক নাজমুল হক। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে চিকিৎসা করাতে আসেন ময়মনসিংহে। শহরের চরপাড়ার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করান রক্তের পরীক্ষা। রিপোর্ট আসে হেপাটাইটিজ 'বি' পজেটিভ। শুরু হয় রোগের চিকিৎসা। কিছুদিন পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারের পরামর্শে একই পরীক্ষা করান ভিন্ন দু'টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। ফলাফল হেপাটাইটিজ 'বি' নেগেটিভ।
তিনি বলেন, 'রিপোর্টের ফলাফল দেখে ডাক্তার আমাকে ওষুধ লিখে দেন। আমি তা খেয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ি। পরে জানতে পারি, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরীক্ষার রেজাল্ট ভুল ছিল। আমি এই বিষয়ে থানায় অভিযোগ দিয়েছি।'
রিপোর্টে ভুলের এমন অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়। ময়মনসিংহে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর এমন ভুলের কারণ সরেজমিনে অনুসন্ধান চালানো হয়। নজর পড়ে চরপাড়ার রেডিয়াম ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার একটি মূল্য তালিকা ওপর।
সেখানে লেখা 'চিকনগুনিয়া টেস্ট ১২শ' টাকা। যিনি পরীক্ষা করেন, কথা হয় সেই ল্যাব টেকনেশিয়ান মোহাম্মদ আকাশের সঙ্গে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় 'চিকনগুনিয়া' নামে কোনো টেস্ট আছে কি-না। এটি কিসের টেস্ট? উত্তরে তিনি বলেন, 'এটি কালাজ্বরের একটি পরীক্ষা।' অর্থাৎ তিনি এ বিষয়ে জানেনই না। অথচ রোগ নির্ণয়ের কাজে অংশ নিচ্ছেন। জানা গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সনদ না থাকলেও ওই প্রতিষ্ঠানে পাঁচ হাজার টাকা বেতনে কাজ করছেন তিনি।

রিএজেন্ট সংরক্ষণে মানা হয় না নীতিমালা
রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রিএজেন্ট। যা সংরক্ষণে রয়েছে নির্দিষ্ট নীতিমালা। রয়েছে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখার বাধ্যবাধকতাও।
র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আক্তারোজ্জামান বলেন, 'রিএজেন্ট দিয়ে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও এটি সংরক্ষণে কোনো নিয়ম মানা হয় না। ময়মনসিংহে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় দেখেছি রিএজেন্ট রাখা হচ্ছে খাবারের ফ্রিজে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। অনেক সময় ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মেয়াদ উত্তীর্ণ রিএজেন্ট ব্যবহার করা হয়।'
এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সাদেকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, 'প্যাথলজিক্যাল টেস্টের অন্যতম উপাদান রিএজেন্ট। এটি যদি সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ না করা হয়, তবে রিপোর্ট ভুল আসবে। আর সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থাপত্র দিবেন চিকিৎসক। এভাবে ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন সেবা প্রার্থীরা। এ এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার।'
ময়মনসিংহের বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবার খারাপ মানের বিষয়টি ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আবুল কাশেমের নজরে আনা হলে তিনি জানান, অনিয়মের বিষয়গুলো তাদের নজরে রয়েছে। নিয়মিত মনিটর করছেন তারা। আশা করছেন দ্রুত এর উন্নতি হবে।