বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের যাবতীয় তথ্য চেয়েছেন হাইকোর্ট

বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের নাম-পরিচয়সহ যাবতীয় তথ্য চেয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর, এনবিআর চেয়ারম্যান ও ঢাকার জেলা প্রশাসককে এসব তথ্য দাখিল করতে বলা হয়েছে।
অর্থপাচার ঠেকাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুলও জারি করেছেন আদালত। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে হবে।
আদালত একইসঙ্গে অবৈধ অর্থ পাচারের কার্যক্রম বন্ধ করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেন।
অর্থপাচার নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নজরে নিয়ে রবিবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্ব-প্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দেন।
১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে 'মিট দ্য প্রেস' অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন জানান, 'রাজনীতিবিদরা নন, বিদেশে বেশি অর্থপাচার করেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আমার ধারণা ছিল, রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশের বাইরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই বাড়ি বেশি আছে। তাদের পরিবারের সদস্যরা সেখানে থাকেন।'
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, তার কাছে ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন মাত্র চার জন। কিছু আছেন রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীরা। বাকিরা সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারি।
রোববার দেয়া আদেশের আগে আদালত বলেন, 'যারা মানিলন্ডারিং করছে, তারা দেশ ও জাতির শত্রু। তারা দেশ ও জাতির সাথে বেঈমানি করছে বলে আমরা মনে করি। কাজেই এগুলো আমাদের দেখা দরকার। কীভাবে তারা বিদেশে বাড়ি তৈরি করলো, এটা জানা দরকার। না হলে অপরাধটা কমবে না।'
আদালত আরো বলেন, 'দেশের মাটিতে বসবাস করে, পড়াশোনা করে দেশকে ঠকিয়ে বাইরে টাকা পাচার করবে, এটা তো হতে পারে না। দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলে কেউ কখনো এটা করতে পারে না। এভাবে তো আমরা দুর্বৃত্তদের অ্যালাও করতে পারি না। আমাদের এতগুলো আইনগত সংস্থা, কোর্ট আছে। এগুলো বন্ধ করতে আমাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে।'
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশিদ আলম খান।
আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, পাচারকারীদের তথ্য আদালতে উপস্থাপনের পর আদালত সংশ্লিষ্টদের প্রতি যে নির্দেশনা দেবেন, সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
দেশের বাইরে যতো অর্থপাচার
অর্থ পাচারের ক্ষেত্র পাচারকারীদের পছন্দের গন্তব্য হচ্ছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালেশিয়া ও সিঙ্গাপুর। কানাডার টরেন্টোর রিচমন্ড এলাকায় বহু বাংলাদেশীর বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে, যেগুলোর বেশিরভাগই পাচার করা অর্থে কেনা হয়েছে। স্থানটি বাংলাদেশীদের 'বেগমপাড়া' হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
এই বেগমপাড়াতেই ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বহুল আলোচিত পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করে গড়ে তুলেছেন বিলাশবহুল অট্টালিকা ও মার্কেট। শত কোটি টাকা পাচারকারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পিয়ন আফজালের অত্যাধুনিক বাড়িও আছে এখানে। বেগমপাড়ায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে এরকম আরো অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
গত মার্চে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে সাত বছরে ৫ হাজার ২৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে।
পাচারকৃত এই অর্থের বেশিরভাগই হয়েছে আমদানি-রফতানিতে জালিয়াতির মাধ্যমে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে গড়ে বছরে পাচার হয়েছে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার।
সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, জিএফআই-এর গবেষণাটি আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে। তাদের তথ্য সঠিক। তবে তারা শুধু আমদানি-রপ্তানির হিসাবের গড়মিল থেকে এ তথ্য পেয়েছে।
তিনি বলেন, বাণিজ্য ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের আরো অনেক উপায় আছে। এগুলোকে বিবেচনায় নিলে পাচার করা টাকার পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে।
২০১৮ সালের জুনে প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমানো অর্থের পরিমাণ ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা।
পাচার করা অর্থের প্রকৃত তথ্য নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে
দেশ থেকে কি পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে, এ বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।
অর্থপাচার নিয়ে জিএফআই-এর তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব তথ্যই সঠিক নয়। তবে অনেকাংশেই সঠিক। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থপাচার প্রতিরোধ করতে গত বছর 'প্রিভেনশন অব ট্রেড বেজড মানিলন্ডারিং' নীতিমালা জারি করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
মি. হাসান বলেন, 'অর্থপাচার নিয়ে বিএফআইইউর পাশাপাশি দুর্নীতি দমন সংস্থা (দুদক), শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডিসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মানিলন্ডারিং সম্পর্কিত তথ্য আমরা হাইকোর্টে উপস্থাপন করব।'
দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দেশ থেকে কত টাকা পাচার হয়েছে বা কতজন করেছে তার পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য দুদকের কাছে নেই। আমরা অর্থ পাচারের যেসব অভিযোগ ও মামলা তদন্ত করছি, সেগুলোর তথ্য নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে উপস্থাপন করব।'