দুদকের কাছ থেকে দায়িত্ব সরায় ৩,৫০০ কোটি টাকার প্রতারণা মামলা নিয়ে বিপাক

প্রতারণা ও জালিয়াতি মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইন ২০১৩ সালে সংশোধন করে সরকার। এর তিন বছর পর এই সংস্থা সেই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়।
এই পরিবর্তনের ফলে মোট ৩,৫০০ কোটি টাকার প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলাগুলোতে জট লেগে গেছে।
জানা যায়, ২০১২ সালে চট্টগ্রামের উত্তর হালিশহর এলাকার মইনুদ্দিন আসিফের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা মূল্যর জমি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জালিয়াতি করে নিজের নামে লিখে নেন আলী আকবর নামে এক ব্যক্তি।
জাপান প্রবাসী মইনুদ্দিন আসিফ ২০১৩ সালের দেশে ফিরে বাড়ি করার জন্য ঋণ নিতে ওই জমি অগ্রণী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখার চেষ্টা করেন। এজন্য জমির নামজারি খতিয়ান পেতে স্থানীয় ভূমি অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, জমির সম্পূর্ণ দলিল ও পরচা ক্রয়সূত্রে আলী আকবরের নামে লেখা।
তখন মইনুদ্দিন আসিফের চোখ কপালে ওঠে। চট্টগ্রাম আদালতে জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ এনে মামলা করেন তিনি। মামলাটি তদন্তের জন্য হালিশহর থানাকে দায়িত্ব দেন আদালত।
এই মামলায় আলী আকবর ৩ মাস কারাভোগের পর জামিনে বেড়িয়ে আসেন।
মামলার তদন্ত কাজ চলতে থাকে। ইতোমধ্যে ২০১৩ সালের ২০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে দুদক আইন সংশোধন করে ব্যক্তি পর্যায়ে জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলা তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়াও এরকম অভিযোগ পেলে দুদককে অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্ত করারও দায়িত্ব দেওয়া হয়।
দুদক আইন পরিবর্তন হলে মইনুদ্দিন আসিফের মামলাটি ২০১৩ সালের শেষ দিকে দুদকের কাছে পাঠায় হালিশহর থানা। দুদক চট্টগ্রাম অফিস মামলাটি তদন্তে একজন কর্মকর্তাও নিয়োগ করে। অজানা কারণে তিন বছরেও মামলার তদন্ত এগোয়নি।
ইতোমধ্যে আবারও দুদক আইনরে সংশ্লিষ্ট ধারাটি সংশোধন করে ২০১৬ সালের ১৯ জুন জাতীয় সংসদে বিল পাস হয়। সেই সংশোধনীতে ২০১৩ সালের সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলা তদন্ত ক্ষমতা দুদকে কাছ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে পুলিশের কাছে দেওয়া হয়।
মইনুদ্দিন আসিফের মামলাটি আবার হালিশহর থানায় ফেরত যায় তদন্তের জন্য।
তদন্ত শেষ না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আদালতে চারবার আবেদন করেন মইনুদ্দিন আসিফ। আদালতে পুলিশ প্রতিবার সময় নিলেও তদন্ত এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি। অবশেষে এই মামলায় বিচারিক তদন্ত চেয়ে গত মার্চ মাসে হাইকোর্টে রিট মামলা করেন তিনি। কোভিড-১৯-এর কারণে হাইকোর্টের বিচারকাজ সীমিত পরিসরে চলমান থাকায়ি রিটটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসেনি এখন পর্যন্ত।
হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'এটি অনেক পুরাতন বিষয়। তাই এ বিষয়ে খোজ খবর নিয়ে অপডেটেড তথ্য জানা যাবে। এজন্য সময় প্রয়োজন।'
হাইকোর্টে মইনুদ্দিন আসিফের আইনজীবী মোহাম্মদ মাসুদ মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শুধু মইনুদ্দিন আসিফ নন, একইসঙ্গে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার আরও ২১ জন এই রিটের বাদী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, সবার মামলার অবস্থা একই।'
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে আইন সংশোধনের পর প্রায় ৬০০০ মামলার তদন্ত কাজ বিভিন্ন থানা এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) ও সংশ্লিষ্ট আদালতে ফেরত পাঠানো হয়। সেইসব মামলার বিপরীতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা জড়িত।
দুদকের তৎকালীন মহাপরিচালক (লিগ্যাল) এবং বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মঈদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, '২০১৩ সালে সংশোধিত দুদক আইনে প্রতারণা ও জালিয়াতির ধারাগুলো যুক্ত করা হয়। এ সংক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি খাতের সব অভিযোগ দুদককে দেখতে বলা হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'বেসরকারি খাতের হাজার হাজার অভিযোগের তদন্ত দুদকের পক্ষে করা সম্ভব নয়। দুদক শুধু সরকারি কর্মকর্তা বা সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট অভিযোগের তদন্ত করতে আগ্রহী হওয়া আইনটি সংশোধন করা হয়।'
তিনি বলেন, 'বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ অভিযোগের সঙ্গে সরকারের কোনো স্বার্থ জড়িত নেই। এসব মামলার চাপে দুদক ঠিকভাবে কাজ করতে পারছিল না। ২০১৬ সালে দুদক আইন সংশোধিত হওয়ায় এগুলোর তদন্ত সংশ্লিষ্ট থানা, সিআইডি ও আদালতে পাঠানো হয়। এরপর এ নিয়ে দুদক আর কোনো ফলোআপ করেনি।'
বিচার শুরু হয়নি একটি মামলারও
দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই ৬০০০ হাজার মামলার একটিরও তদন্ত এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। ফলে এসব মামলার বিচারও শুরু হয়নি।
দুদক জানায়, গত ৫ বছরে এসব মামলার বিষয়ে দুদককে উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন জানিয়ে প্রায় ৫০০ অনুরোধপত্র পাঠিয়েছেন বিভিন্ন বিচারপ্রার্থী।
দুদক সচিব ড. মুঃ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার টিবিএসকে বলেন, 'এই মামলাগুলোর তদন্ত সম্পন্ন করতে যেসব অনুরোধপত্র দিয়েছেন বিচারপ্রার্থীরা, সেগুলো স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কারণ এসব নিয়ে দুদকের আর কোনো এখতিয়ার নেই।'
তিনি বলেন, 'সরকারের জমি সংক্রান্ত কোনো জালিয়াতি, প্রতারণা, সরকারি কোনো চাকরিজীবীর বিরুদ্ধে প্রতারণা বা ব্যাংকের সঙ্গে প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলাগুলো দুদক অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্ত করছে।'
যত মামলা
২০১৬ সালে আইন সংশোধন হওয়ার পর যে ৬০০০টি মামলা দুদক ফেরত পাঠায়, এগুলোর মধ্যে জমির দলিল ও অন্যান্য কাগজপত্র জালিয়াতি সংক্রান্ত মামলা ছিল ১৯০০টি, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার অভিযোগে মামলা ছিল ১৬৭৪টি, ব্যবসা সংক্রান্ত প্রতারণার অভিযোগে মামলা ছিল ১৫৪ টি এবং ৮৭৮টি ছিল বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার মামলা।
এই ৬০০০ মামলার মধ্যে ২০১৩ সালের শেষ দিকে ও ২০১৪ সালের শুরুর দিকে বিভিন্ন আদালত থেকে দুদকের কাছে আসে ১২৪৪টি মামলা, পুলিশের কাছ থেকে আসে ২৩৫১টি। আর তিন বছরে দুদকের কাছে আসা অভিযোগ অনুসন্ধানের পর সত্যতা পাওয়ায় ২,৪০৫টি মামলা দায়ের করেছিল সংস্থাটি।
দুদকের দায়ের করা মামলা
২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে আইন সংশোধনের পর থেকে ২০১৬ সালের জুন মাসে আইনের পরবর্তী সংশোধনী পর্যন্ত দুদকে আসা অভিযোগের ভিত্তিতে যে ২,৪০৫টি মামলা দায়ের করেছিল দুদক, সেগুলোর তদন্ত কাজ দুদক নিজেই পরিচালনা করছিল।
আইন সংশোধনের পর সেগুলো সংশ্লিষ্ট আদালতে ফেরত পাঠায় দুদক।
দুদকের তৎকালীন সচিব মোস্তফা কামাল টিবিএসকে বলেন, 'এই মামলাগুলো আদালতে ফেরত পাঠানোর পর এখন পর্যন্ত সেগুলো তদন্তের জন্য কোনো সংস্থার কাছে পাঠানো হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সে সময় আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়েছিল।'
দুদক সচিব ড. মুঃ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, 'জনস্বার্থ বিবেচনা করে প্রয়োজনে আবারও এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়, সুপ্রিম কোর্ট ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে।'
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। পুলিশের কাছে থাকা মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত করতে নির্দেশনা দেওয়া হবে।'
আরও মামলা
বগুড়া জেলার শেরপুরের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনের ৩০ লাখ টাকা প্রতারণা করে আত্মসাৎ করেন তারই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সজীব মিয়া। ২০১৩ সালের শেষ দিকে আদালতে প্রতারণার মামলা করা হয় ওই কর্মচারীর বিরুদ্ধে। সেটি পুলিশের কাছে যায় তদন্তের জন্য। পরে দুদকের কাছে যায়। ওই ব্যবসায়ীর আইনজীবী আশরাফুল ইসলাম সুজা বলেন, 'এখন পর্যন্ত তদন্ত সম্পন্ন হয়নি। কবে তদন্ত শেষ করবে বলা যাচ্ছে না।' তার মক্কেল বিচার নিয়ে হতাশ বলে জানান তিনি।
এছাড়াও নারাণগঞ্জের বন্দর এলাকার ফলের আড়ত ব্যবসায়ী বাকের উদ্দিনের কাছ থেকে প্রায় ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তার এক ব্যবসায়ী পার্টনার। সব সম্বল হারিয়ে পথে বসে যান ওই ব্যবসায়ী। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে তিনি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে রমনা থানায় মামলা করে সংস্থাটি। পরবর্তীকালে মামলাটি তদন্তের জন্য থানায় ফেরত পাঠানোও হলেও এখন পর্যন্ত সেটির তদন্ত সম্পন্ন হয়নি।
বিস্ময় প্রকাশ বিশেষজ্ঞদের
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'দুদক আইন কয়েকবার সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধনের ক্ষেত্রে বা সংস্কারের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করা হয় না। প্রশাসনিক দৃষ্টিতে হয়তো মনে হলো, আইনের এ জায়গায় সংস্কার দরকার, চট করে সংশোধনী আনা হয়। অথচ এ ক্ষেত্রে অংশীদের মতামত নেওয়া উচিত।'
তিনি আরও বলেন, '২০১৩ সালে দুদক আইনে সংশোধনীর আগে আমরা কিছু সুপারিশ দিয়েছিলাম। সেগুলোর প্রতিফলন ওই সংশোধনীতে নেই। ২০১৬ সালের সংশোধনীর পরেও বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে।'
তবে বেসরকারি খাতের বা ব্যক্তি পর্যায়ের প্রতারণার মামলাগুলো তদন্তের জন্য পুলিশের কাছে ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ দুদকের জন্য ভালো ছিল। কিন্তু বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করা হয়নি। মামলাগুলোর তদন্ত কবে নাগাদ শেষ করবে পুলিশ, তার জন্য সময়সীমা টানা দরকার ছিল।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, 'কী কারণে মামলাগুলোর তদন্ত সম্পন্ন হচ্ছে না, সে বিষয়গুলো ফাইন্ড আউট করে আদালত ও পুলিশ যাতে একসঙ্গে এ নিয়ে কাজ করতে পারে, শিগগিরই সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে।'
পৃথক সংস্থা গঠনের দাবি
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, 'দেশের মালিক জনগণ। সেই জনগণের স্বার্থ রক্ষাই হলো রষ্ট্রের প্রধান কাজ। বিচারপ্রার্থীদের এই ভোগান্তি ও বিচার নিয়ে এই ধরনের হতাশা কাটাতে মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করার জরুরি।'
তিনি বলেন, 'যেহেতু তদন্তের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অবহেলা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাই সরকার চাইলে এসব মামলা তদন্ত করে বিচার শুরুর সহায়তা করতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠন করতে পারে, যেখানে অভিজ্ঞ ও অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার সঙ্গে পুলিশের লোকজন রাখা যেতে পারে।'