৮ হাজার মাইল সাইকেলে চেপে এভারেস্ট বেজক্যাম্পে, অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট জয়

অনেক সময় অসাধারণ কিছু গল্প চোখে পড়ে, মনে হয় এই গল্প নিয়ে হতে পারতো বিলিয়ন ডলারের কোনো চলচ্চিত্র। গোরান ক্রপের মাউন্ট এভারেস্ট গল্প এরকমই এক কাহিনী।
সুইডিশ অভিযাত্রী লারস ওল্ড অলোফ গোরান ক্রপ বাইসাইকেলে চেপে সুইডেন থেকে মাউন্ট এভারেস্টের পাদদেশে যান, কোনো সাহায্য ছাড়াই আরোহণ করেন বিশ্বের সর্বোচ্চ এই পর্বতশৃঙ্গ। তারপর আবার ওই বাইসাইকেলে চেপেই নিজ দেশে ফিরে যান। এ ধরনের অর্জন শুনতে অবিশ্বাস্য শোনায় তো বটেই, সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে, চিন্তা করে বোঝাও মুশকিল।
কে এই গোরান ক্রপ?
তার জন্ম ১৯৬৬ সালে। বেড়ে ওঠেন সুইডেনের জোনকোপিংয়ে। মাত্র ছয় বছর বয়সে তার জীবন চিরতরে বদলে যায় যখন তার বাবা তাকে নরওয়ের গলধোপিগেনে নিয়ে যান। এটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সবচেয়ে উঁচু চূড়া। পর্বতারোহণের স্বাদ পাওয়া গোরান স্কুলের পরই সুইডিশ প্যারাসুট রেঞ্জার্সের কাজে যোগ দেন। এটি সুইডিশ সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ অপারেশন ইউনিট।
গোরান ক্রপের কিংবদন্তি মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া জয়ের আগে তিনি পৃথিবীর আরও কিছু উচ্চতম শৃঙ্গ জয় করেন, পথিমধ্যে রেকর্ড গড়েন বেশ কয়েকবার। ২২ বছর বয়সে তিনি তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানের মধ্যকার লেনিন শিখর (৭১৩৪ মিটার) আরোহণ করেন, এটিই তার প্রথম বড় কোনো অর্জন। তিনি ও তার সহযাত্রীরা সে সময় রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন, মাত্র ১০ দিনের মধ্যে চূড়ায় পৌঁছেছিলেন তারা।
এরপর ১৯৯০ সালে ক্রপের বয়স যখন ২৩ বছর, দক্ষিণ আমেরিকার ইলিনিজা সুর (৫২৬৬ মিটার), কোটোপ্যাক্সি (৫৮৯৭ মিটার), ইলিমানি (৬৩০০ মিটার), হুয়ায়না পোটোসি (৬০৮৮ মিটার) এবং ইল্লামপু (৬৫২০ মিটার) আরোহণ করেন। এর পরের বছর তিনি পাকিস্তানের মুজতাঘ টাওয়ার (৭২৭৩ মিটার) আরোহণ করেন।
এরপর ১৯৯১ সালে কিরগিজস্তানের পিক পোবেদা (৭৪৩৯ মিটার), ৯২ সালে চো ওয়ু অভিযানে যান। চো ওয়ুর যাত্রায় তার একজন সহযাত্রী মাথায় পাথরের আঘাতে মারা গিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি কে২ আরোহণে যান। মাউন্ট এভারেস্টের পর বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই পর্বত শৃঙ্গটি জয় করেন প্রথম সুইডিশ হিসেবে।
তারপরই ১৯৯৬ সালে তার ঝুলিতে যোগ হয় আরেকটি পালক, মাউন্ট এভারেস্ট জয়।
গোরান ক্রপের মাউন্ট এভারেস্ট অভিযান
সুইডেন থেকে এভারেস্ট পর্যন্ত যাওয়ার বেশ কয়েকটি পথ আছে। কিন্তু ক্রপ যে পথেই যান, সবগুলো পথের দূরত্বই অনেক। এই দূর পথ ক্রপকে ৮ হাজার মাইল বাইসাইকেলে চড়ে এভারেস্টে যাওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। পৌঁছানোর পর কোনো অক্সিজেন বা কোনো আরোহীর সাহায্য ছাড়াই তিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে যান। নেমেই আবার নিজের বাইকে চড়ে সুইডেনে ফেরত যান।
১৯৯৫ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি স্টকহোম থেকে যাত্রা শুরু করেন। প্রায় ৮ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে মাউন্ট এভারেস্টের বেজক্যাম্পে পৌঁছান তিনি। অর্থাৎ বেজক্যাম্পে যাওয়ার আগেই ৬ মাসের বাইক ট্রিপে ছিলেন তিনি।
তিনি মাউন্ট এভারেস্টে পৌঁছানোর পর অন্যান্য অভিযাত্রীদের সাথে একটি বৈঠক হয়। যেহেতু তিনি একাই আরোহণ করবেন তিনিই প্রথমে চূড়ায় চড়ার চেষ্টা করবেন- এব্যাপারে সবাই একমত হয়।
৩রা মে তিনি এভারেস্টের দক্ষিণ চূড়ায় পৌঁছান যা শিখর থেকে মাত্র ৩২৮ ফুট দূরে, কিন্তু তাকে উলটোপথে ঘুরতে হয়েছিল। তিনি প্রায় কোমর সমান গভীর তুষার ঢাকা পথে হাইকিং করছিলেন আর অন্ধকারও নেমে আসছিল। সে সময় তিনি চলতে থাকলে কুচকুচে অন্ধকারের মধ্যে ফিরে যেতে হত তাকে, নিশ্চিতভাবেই সেখানে মারা যেতেন তিনি।
তারপর ২৩শে মে তিনি সফলভাবে মাউন্ট এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছান। চূড়ায় পৌঁছানোর পর অক্সিজেন সাপোর্ট ছাড়াই তিনি নিচে নেমে আসেন। তারপর আবার সাইকেলে চড়ে ফরেস্ট গাম্পের মতো বাড়ি ফেরেন।
এভারেস্ট জয়ের পর কী হলো?
তার মৃত্যুর তিন বছর আগে ১৯৯৯ সালে মাউন্ট এভারেস্টে ফিরে আসেন। এবার তার প্রেমিকার সাথে এভারেস্ট অভিযানে যান। এই অভিযানকে তারা পরিচ্ছন্নতা মিশন হিসেবে নিয়েছিলেন, যাত্রাপথে তারা ২৫টি বাতিল অক্সিজেন ক্যানিস্টার সরিয়েছিলেন।
২০০২ সালে ওয়াশিংটনের ভ্যানটেজের বাইরে ফ্রেঞ্চম্যান কোউলিতে এয়ার গিটার রুটে আরোহণ করার সময় মারা যান। একটি সরঞ্জামের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ৬০ ফুট নিচে মাটিতে ছিটকে পড়েন তিনি। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় এই দুঃসাহসী অভিযাত্রীর মৃত্যুও হয় এক অভিযানের মধ্য দিয়ে।