পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ: ‘আমরা সবাই নন-পেইড ভলান্টিয়ার’

আজকের গল্প একদল উদ্যমী তরুণের যারা সাহসের সাথে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সকল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের প্রান্তিক মানুষের। 'পাশে আছি Initiative' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একদল তরুণের গড়া পুরোপুরি অলাভজনক ও স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠন।
করোনা মহামারির প্রথমদিকে সারাদেশ লকডাউনের আওতায় আসার পরে খেটেখাওয়া, দিন-মজুর, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পড়ে। একদিকে করোনার ভয়, অন্যদিকে পেটের দায়ে হতবিহ্বল কর্মহীন নিম্নবর্গের মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ায় 'পাশে আছি Initiative'-এর তরুণেরা। তারা খাবার, পোশাক, ঔষধ, মাস্ক-গ্লাভস, স্যানিটাইজার ইত্যাদি দিয়ে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোকে সাহায্য করে।
সংগঠনটির একজন কো-ফাউন্ডার সাজিদ রেহমান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে 'পাশে আছি'-র শুরুর গল্পটি বলেন। কোনোরকম পূর্ব-পরিকল্পনার মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। লকডাউনের শুরুর দিকে প্রান্তিক না খেয়ে থাকা মানুষগুলোর জন্য কি করা যায় এ ব্যাপারে ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে কথা বলতে বলতে খাবার সরবরাহের আইডিয়া আসে।
সাজিদ রেহমান বলেন, 'প্রথমে আমরা নিজেরা চাঁদা তুলে মোহাম্মদপুর ও শঙ্কর এলাকার ২০২০ সালের ২৪ মার্চ মোটামুটি ১০০ জন রিকশাওয়ালা, সিএনজিওয়ালা, দিনমজুর খেটেখাওয়া মানুষকে চাল-ডাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দিয়ে সাহায্য করি। সেগুলোর ছবি ফেসবুকে ছাড়ার পর বিষয়টি ব্যাপক সাড়া জাগায়। কয়েকজন আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায়।'
'ভালো সাড়া পেয়ে আমরা সাহায্যের কাজটি একটি সংগঠনের মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত নেই। এই চিন্তা থেকেই ''পাশে আছি Initiative'' এর যাত্রা শুরু।'
সংগঠনটিতে শুরুর দিকে ছিলেন তাহমিদ, রাফিউল, সাজিদ, সাকিফ, আনিকা, জয়া, অভীক, রিফাত, নিলয়। এরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী। সংগঠনের বিস্তারের সাথে সাথে সদস্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিভাগের অনেক জুনিয়র এবং বন্ধু-বান্ধবদের কেউকেউ তাদের সাথে যুক্ত হয়।
ঢাকার বাইরে কার্যক্রম চালানোর জন্য বিভিন্ন জেলায় স্বেচ্ছাসেবী বা ভলান্টিয়ার নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রায় ১০টি জেলায় পাশে আছি-র ভলান্টিয়ার নিযুক্ত আছে। এর ভেতর ৬ টি জেলা উত্তরবঙ্গের। কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, খুলনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ। বাকি চারটি জেলা খুলনা বিভাগের – খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা।

ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে উত্তরবঙ্গকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে ভলান্টিয়ারদের অন্যতম ফারদিন কবীর বলেন, 'উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে দারিদ্রের হার অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে খানিকটা বেশি। আর কোনো জেলায় ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে সে জেলা বা আশেপাশের এলাকাগুলোয় স্বেচ্ছাসেবী থাকা জরুরি।'
'উত্তরবঙ্গে স্বেচ্ছাসেবীদের অংশগ্রহণমূলক মানসিকতা আমাদের সেখানে যেতে আরো অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। উত্তরবঙ্গে আমরা আমাদের ভলান্টিয়ার দের সাহায্য নিয়ে বন্যাকবলিত ও দুর্গম চর অঞ্চলগুলোয় গিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি।'
জনাচারেক তরুণের ছোট্ট একটি উদ্যোগ দিয়ে শুরু হলেও পাশে আছি-র বর্তমান নিয়মিত টিম মেম্বারের সংখ্যা ২৫-৩০ জন। এরা সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। প্রথমদিকে পাশে আছি-র প্রধান উদ্দেশ্য ছিল না খেয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখে খাবার তুলে দেওয়া। ঢাকার বিভিন্ন এরিয়াতে সিএনজি অটোরিকশাতে করে ভলান্টিয়ারদের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করা হত।
খাবার সরবরাহের বিষয়টি দিন-মজুরদের কাছে শুরু হলেও ধীরে ধীরে সে কার্যক্রম হিজরা, পতিতা ও মেথরদের মাঝেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
পাশে আছি-র ভলান্টিয়ার রা জানান যে তারা ঢাকার প্রায় প্রতিটি হিজরাপল্লীতে ঘুরে ঘুরে তাদের খাবার পৌঁছে দিয়েছে। ঢাকার বাইরের হিজরা পল্লীগুলোতেও তারা ছুটে গেছে।
পাশে আছি-র একজন ভলান্টিয়ার ফারজিন মুমতাহিনা বলেন যে প্রথমদিকে খাবার সরবরাহের পাশাপাশি তারা পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করে এবং রিক্সাওয়ালাদের মাঝে মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিতরণ করে।
খাবার সরবরাহের পরে পাশে আছি-র প্রথম ভিন্নধর্মী কার্যক্রম 'প্রজেক্ট গ্রন্থমঙ্গল'। করোনার থাবায় নীলক্ষেতের বইবিক্রেতারা অসহায় হয়ে পড়লে পাশে আছি-র ভলান্টিয়াররা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পাশে আছি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইনে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। লভ্যাংশের পুরো টাকা বইবিক্রেতাদের দান করা হয়।
পাশে আছি-র একজন প্রথম দিককার ভলান্টিয়ার ও কো-ফাউন্ডার তাহমিদ হাসান জানান, 'পাশে আছি-র মাধ্যমে প্রায় ৪০০০-৫০০০ জন ক্রেতা নীলক্ষেতের বই বিক্রেতাদের ১০০০০ এর মতো বই কিনেছে এবং আমরা মোটামুটি ১৫০ জন বই বিক্রেতাকে সাহায্য করতে পেরেছি।'
কথায় কথায় পাশে আছি-র ফান্ডিংয়ের ব্যাপারে কো-ফাউন্ডাররা জানান, 'প্রথমে বিকাশ, রকেট বা নগদের মাধ্যমে সাহায্য আসা শুরু হয়। ধীরেধীরে সাহায্যের পরিমাণ বাড়তে থাকে। পরে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সাহায্যপ্রাপ্তির রাস্তা চালু করা হয়।'
প্রথমদিকে পাশে আছি-র ফান্ডিংয়ের সিংহভাগ আসত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। বর্তমানে এর সিংহভাগ অর্থায়ন করে থাকেন প্রবাসী বাঙালিরা। তাদের পাশাপাশি দেশে বসবাসকারী ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীদের অনেকে ফান্ডিং করে থাকেন।
পাশে আছি তাদের দানকারীদের পরিচয় প্রকাশ করে কিনা সে ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে একজন কো-ফাউন্ডার সাজিদ রেহমান জানান যে তাদের অর্গানাইজেশন দানকারীদের নাম প্রকাশ করে না। সেরকম কোনো নিয়ম রাখা হয়নি যাতে লোকদেখনো কোনো বিষয় না আসে।
অত্যন্ত আনন্দের সাথে ভলান্টিয়ার রা জানান বিভিন্ন জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে সেখানকার জেলা প্রশাসক, ইউএনও এবং অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থেকে তারা সাহায্যলাভ করেছেন। ঢাকাতেও এমন হয়েছে। 'পাশে আছি Initiative' সরকারের নিকট রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করেছে। তারা আশা করছে খুব শীঘ্রই তারা নিবন্ধন লাভ করবে।

পাশে আছি-র আরেকটি অভিনব উদ্যোগের নাম 'প্রজেক্ট শিল্পগ্রাম'। এ প্রজেক্টের আওতায় দেশের হারিয়ে যাওয়া কুটির শিল্পকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং কুটির শিল্পীদের আর্থিকভাবে সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শখের হাঁড়ি, মাটির পুতুল, ঘট, বেতের কাজ, পটচিত্র সংগ্রহ করতে ভলান্টিয়ার রা রাজশাহী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রংপুরসহ দেশের নানা প্রান্তে কুটির শিল্পীদের কাছে ছুটে গিয়েছেন।
নীলক্ষেতের বইয়ের মতো কুটির শিল্পজাত পণ্যগুলোকে অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। সুশান্ত পালের পটচিত্র, বাসন্তী রাণীর কারুকার্যময় হাতপাখা, পরেশ চন্দ্র দাসের বেতের কাজগুলো অনলাইনে বিক্রি করা হয়। রতন পালের মতো শিল্পী যারা পেটের দায়ে তুলি ছেড়ে রিকশা চালানো শুরু করেছিলেন তারা তাদের শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করায় নতুন উৎসাহে কাজে লেগে পড়েন।
তিন পুরুষ ধরে হাত পাখা নির্মাণকারী বাসন্তি রাণী পাশে আছি-র ভলেন্টিয়াদের বলেন, 'দুই বৈশাখ ধইরা পাখা বিক্রি করতে পারি না, এমন চললে এই শিল্প ধইরা রাখুম কেমনে।' রিকশা আর্টিস্ট হানিফ পাপ্পুও দেশের হারিয়ে যাওয়া শিল্প নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পাশে আছি-র ভলান্টিয়ার রা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

অভুক্ত মানুষদের খাওয়াতে পাশে আছি-র আরেকটি অভিনব কার্যক্রমের নাম 'আম জনতা হোটেল' ও 'আম জনতা বাজার'। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এবং ঢাকার বাইরে ৫-৬ টি জেলায় ভ্রাম্যমাণ হোটেল স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিদিন কয়েকশ মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আম জনতার হোটেলে যে কেউ টাকা দিয়ে বা টাকা ছাড়া খাবার খেতে পারবে। মাত্র ৭০ টাকায় একজন মানুষের পোলাও বা খিচুড়ি ও মাংসের ব্যবস্থা করা হয়েছে আম জনতার হোটেলে। দরিদ্র, নিঃস্ব, অসহায়, ভিখিরি, ক্ষুধার্ত মানুষদের পরম আদরে আম জনতার হোটেলে খাওয়াচ্ছেন ভলান্টিয়াররা।
পাশে আছি-র সরবরাহকৃত প্রজেক্ট রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত চার মাস ধরে প্রতিদিন প্রায় তিন শতাধিক লোক আম জনতার হোটেল থেকে বিনামূল্যে খাবার খাচ্ছেন। এ কার্যক্রমটি পাশে আছি-র সবচেয়ে বৃহৎ বা পরিচিত কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে।
'আম জনতার বাজার' কার্যক্রমটি শুরু করা হয়েছিল নিম্ন আয়ের সবজি বিক্রেতা ও মানুষদের সাহায্যের জন্য। পাশে আছি-র একজন ভলান্টিয়ার সাফা তাসনীম বলেন, 'আমরা লকডাউনের প্রথম দিকে সবজি বিক্রেতাদের থেকে ১০০০ কেজি সবজি কিনে নিয়েছিলাম এবং সেগুলো বিলিয়ে দিয়েছিলাম। পরে ভাবা হল এমন একটি দোকান করা যাক যেখানে সকল প্রকার সবজি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থাকবে এবং মানুষজন প্রয়োজনমত সেখান থেকে দ্রব্য নিয়ে যাবে।'

পাশে আছি শুধু খাবারই বিলায়নি। সচেতনতাও বিলিয়েছে। স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে 'প্রজেক্ট রিক্সা আর্ট' নামে একটি কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। এটি হয়ত পাশে আছি-র সবচেয়ে মজার উদ্যোগ। রিকশার পেছনে মাস্ক পরা ও করোনা সচেতনতার ব্যাপারে সাহিত্য, সিনেমা ও সংস্কৃতির প্রচলিত ডায়লগগুলো নতুনভাবে লিখে দেওয়া হয়। ডায়লগের পাশে সে চরিত্রটিকে মাস্ক পরা অবস্থায় দেখে দর্শকরা নিশ্চিতভাবে মজা পেয়েছে।
এরকম কয়েকটি ডায়লগ হল – 'আয়নাবাজি' থেকে 'মাস্ক না পরলে করোনার ভেলকি লাগবে, বোঝো নাই ব্যাপারটা?', ফেলুদা থেকে লেখা হয়েছে 'তোপসে, করোনার কেসটা মনে হচ্ছে বেশ গোলমেলে, বাংলা চিত্র নায়ক-নায়িকার ছবির সাথে দেওয়া হয়েছে 'ছেড়ে দে আমাকে, তুই মাস্ক পরিসনি', ডিপজলের ছবির সাথে দেওয়া হয়েছে 'ভাতিজা মাস্ক না পড়লে খাইছি তোরে', গোপাল ভাঁড়ের ছবির সাথে আছে 'হাসির রাজা জ্ঞানের রাজা মাস্কের রাজা গোপাল ভাঁড়'।
রিকশা আর্টগুলো করানো হয়েছে শিল্পী হানিফ পাপ্পুকে দিয়ে। এর ফলে তার জীবিকার সংস্থান হয়েছে। রিকশা আর্ট শুধু রিকশাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সেগুলো টুল, চেয়ার, কাপ, পিরিচেও তুলে বিক্রির ব্যবস্থা করেছে পাশে আছি-র ভলান্টিয়ার রা। উল্লেখ্য, কয়েকটি রিকশা আর্টে ধর্ষণ বিরোধী কিছু স্লোগান সংযুক্ত করা হয়েছিল।
এছাড়া 'প্রজেক্ট সুরক্ষা'র আওতায় বিনামূল্যে কয়েক হাজার মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। 'প্রজেক্ট মাটির গান'-এর আওতায় আর্থিকভাবে সাহায্য করা হয়েছে ৫০ জন লোকশিল্পীকে। নরসিংদীর অন্ধ বাউল হুমায়ূন কবীর তাদেরই একজন। শিল্পীদের গান পরিবেশনাকে পাশে আছি-র ফেসবুক পেজে শেয়ারের মাধ্যমে লোকগানকে উদ্বুদ্ধকরণের চেষ্টা করেছে ভলান্টিয়াররা।
অভুক্ত মানুষকে খাওয়ানোর পাশাপাশি তাদের জীবিকার সংস্থান করে দিয়েছে পাশে আছির ভলান্টিয়াররা। কাউকে ছাগল কিনে দিয়েছে, কাউকে রিকশা কিনি দিয়েছে। মুদি দোকানদার, স্কুলের দপ্তরি, প্রান্তিক চাষী বা খেটে খাওয়া মানুষদের সাহায্য করা হয়েছে।
বই পড়া নিয়ে পাশে আছি-র আরেকটি প্রজেক্ট 'প্রজেক্ট বুকস ফর প্লাস্টিক'। কমপক্ষে ২৫০ গ্রাম প্লাস্টিকের বিনিময়ে বই দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢাকায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় দুটি স্টল স্থাপন করা হয় যেখান থেকে পাঠকেরা প্লাস্টিকের বিনিময়ে বই নিতে পারবেন।
ভলান্টিয়ারা জানান, 'প্লাস্টিকের দাম বইয়ের চেয়ে অনেক কম। তবুও আমরা আমাদের ফান্ডের টাকা খরচ করে এই কার্যক্রম চালাচ্ছি শুধু মানুষকে পরিবেশের ব্যাপারে সচেতন করতে পাশাপাশি তাদের ভেতর বই পড়ার আগ্রহ বাড়াতে।'
আর্টের মাধ্যমে ধূমপানের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি একবার সিগারেটের মাথা সংগ্রহের জন্য চায়ের দোকানের পাশে একটি খোলা বাক্স রাখা হয় যেটি আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল নামে দু'ভাগে ভাগ করা। চায়ের দোকানের প্রায় সকল ধূমপায়ী ফুটবল ফ্যানেরা সিগারেটের মাথা বাইরে না ফেলে বাক্সে ফেলেন। এতে যেমন পরিবেশ রক্ষা পেয়েছে তেমনি তারা বিনোদন পেয়েছেন।
'পাশে আছি' করোনার মধ্যে অর্থ দিয়ে কয়েকজন স্কুল শিক্ষককে সাহায্য করেছে। গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। আনিকা নামক একজন ট্রান্স উইম্যানের, যার স্বপ্ন উচ্চ শিক্ষিত হয়ে রাজনীতির মঞ্চ কাঁপানো, সমস্ত পড়ালেখার খরচ নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
ভলান্টিয়ার আহমেদ রিফাত কবিরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল নিঃস্বার্থভাবে স্বেচ্ছাসেবা প্রদানের অনুপ্রেরণা তিনি কোথা থেকে পান। রিফাত কবির উত্তরে বলেন, 'পাশে আছি ইনিশিয়েটিভে কাজ করাটা সবসময় আমার মনে শান্তি এনেছে। আমি আমাদের এ সংগঠনকে সমাজের প্রতি দ্বায়িত্ব পালনের একটি মাধ্যম হিসেবে মনে করি এবং এখানে কাজ করার সুযোগ পাওয়াটা আমার জন্য সৌভাগ্যজনক।'

পাশে আছির সিরাজগঞ্জের স্থানীয় ভলান্টিয়ার তানভীর আনজুম তুষার জানান যে ২০২০ এর মে মাসে সিরাজগঞ্জে বন্যার্ত মানুষদের মাঝে জরুরী ত্রাণ সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে পাশে আছি সিরাজগঞ্জে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। স্থানীয় তরুণদের একত্র করে চর অঞ্চলগুলোয় কার্যক্রম শুরু করা হয়।
সাইদুল ইসলাম নামের কিশোরগঞ্জ জেলার একজন স্থানীয় ভলান্টিয়ার বলেন, পড়াশোনা, চাকরি-বাকরির পাশাপাশি পাশে আছি-র কাজের জন্য সময় বের করাটা একটু কঠিন হয়। কিন্তু যখন অসহায় মানুষগুলোর হাসিমুখ দেখতে পাই তখন এক মুহূর্তে সব দুঃখ-কষ্ট হারিয়ে যায়।'
পাশে আছি-র প্রথম দিককার অগ্রনায়ক যারা আছেন তারা সবাই প্রায় মাস্টার্স লেভেল অতিক্রম করেছেন। অধিকাংশই চাকরি-বাকরির সাথে যুক্ত। ফুল টাইম অফিসের পাশাপাশি তারা সরাসরি সংযুক্ত থেকে পাশে আছি-র কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
এ ব্যাপারে তারা বলেন, 'অফিস টাইমের শেষে আমরা কাজ করি। কোনো কোনোদিন রাত একটা-দুইটা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বিভিন্ন জেলায় সেবা প্রদান কার্যক্রম মূলত স্থানীয় ভলান্টিয়ার দের দ্বারাই পরিচালিত হয়ে থাকে। দরকার হলে এক জেলার ভলান্টিয়ার আরেক জেলায় পাঠানো হয়। আমরা খুব সৌভাগ্যবান যে আমাদের পরিবার থেকে আমাদের খুব সাপোর্ট দেওয়া হয়।'
পাশে আছি Initiative তাদের মোটামুটি দুই বছরের যাত্রায় অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেছে যেগুলো মানুষজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে অনেক। পাশে আছি Initiative তাদের ফেসবুক পেজে নিয়মিত কাজগুলো নিয়ে পোস্ট দিয়ে থাকে। সেখানে সুনামের পাশাপাশি অনেকেই অনেক রকম বাজে মন্তব্য করে।
ভলান্টিয়াররা জানান যে রিকশা আর্টের মাধ্যমে ধর্ষণ বিরোধী স্লোগান প্রচারণার সময়, হিজরা বা পতিতাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ফলে অনেক উগ্রবাদীর বাজে মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছিল তাদের। সোস্যাল মিডিয়ায় বা সামনা সামনি গুটিকয়েক মানুষের করা কটূক্তিগুলো তাদের জন্য কিছুটা বিব্রতকর ছিল।
সাফা তাসনীম বলেন, 'সর্বোপরি পাশে আছি-র স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা খুবই আনন্দদায়ক। সবাই আমাদের উদ্যোগগুলোর প্রশংসা করলেও কিছু মানুষ আছে যারা আমরা যত ভালো কিছুই করি না কেন বাজে ফিডব্যাক বা মন্তব্য করবে। সেগুলো আমাদের কাজের স্পৃহাকে নষ্ট করতে পারেনি কারণ প্রতিটি ভালো উদ্যোগই কিছু নেতিবাচক লোকের নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়।'
পাশে আছি-কে নিয়ে সবচেয়ে ভালো লাগা ও মন্দ লাগার দিনটি নিয়ে ভলান্টিয়ার জাইমা হামিদ জয়া বলেন, 'সেভাবে নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল কোন দিনটিতে আমরা সবচেয়ে আনন্দ বা কষ্ট পেয়েছিলাম। যেদিন নীলক্ষেতের দেড় শতাধিক বইওয়ালা মামাদের আমরা সাহায্য করতে পারলাম সেদিন আমরা সবাই আনন্দিত হই। রিক্সা পেইন্টের দিনটিও আমাদের আনন্দের দিন ছিল।'
'তবে আমরা সবচেয়ে কষ্ট পাই তখন যখন দেখি হত-দরিদ্র মানুষগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে। রংপুর ও সিরাজগঞ্জের চর এলাকাগুলোয় গিয়ে দেখি মানুষগুলোর থাকার ঘর নেই, পেটে খাবার নেই। আমরা সাধ্যমত তাদের সাহায্য করেছি। কিন্তু লোকবল, অর্থবলের অভাবে সব মানুষকে সাহায্য করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এটি আমাদের জন্য কষ্টদায়ক ছিল।'
পাশে আছি ইনিশিয়েটিভের কো-ফাউন্ডারদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে এই মুহূর্তে তাদের কোনটি বেশি প্রয়োজন – লোকবল নাকি অর্থবল? তারা বলেন, 'দুটোই প্রয়োজন।' পুরোপুরি নন-পেইড অর্গানাইজেশন হওয়ায় এদের কোনো বেতনভুক্ত কর্মী বা ভলান্টিয়ার নেই। ভলান্টিয়ার নিয়োগের সময় প্রথমেই এই কথাটি বলে নেওয়া হয়।
সাজিদ রেহমান বলেন, 'আমরা সবাই নন-পেইড ভলান্টিয়ার। ভবিষ্যতে আর্থিকভাবে শক্তিশালী হলে আমরা বেতনভুক্ত কর্মী বা ভলান্টিয়ার রাখার কথা ভেবেছি।'
পাশে আছি-র সাম্প্রতিক ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে তিনি আরো বলেন, 'এই মুহূর্তে আমরা সাহায্যের পরিমাণ ও ভলান্টিয়ার সংখ্যা বাড়ানোর দিকে ফোকাস করছি। পাশে আছি এখনও সারাদেশে তার কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে পারেনি। ভলান্টিয়ারের সংকট এর অন্যতম কারণ। আমরা শিক্ষা নিয়ে বিশেষ করে ভাঙন কবলিত চর অঞ্চলগুলোয় শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করার কথা ভেবেছি তবে তার জন্য আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন।'
'পাশে আছি Initiative' খুব সম্প্রতি 'শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড' লাভ করেছে। এটি তাদের জন্য অনুপ্রেরণা। পাশে আছি-র একটি উদ্যোগ থেকে আরেকটি উদ্যোগের জন্ম হয়েছে। সেভাবেই ভবিষ্যতের প্রকল্পগুলোও আসবে। ভলান্টিয়াররা কোনোভাবেই একবার চালু করা প্রকল্প থামাতে আগ্রহী নয়। ভলান্টিয়ারদের উদ্যমের অভাব নেই; প্রয়োজন শুধু খানিকটা মানবিক সাহায্যের হাত।