মদ নিয়ে অদ্ভুত আইন যে দেশগুলোতে

সম্প্রতি হাইকোর্টের এক রুলের মাধ্যমে বাংলাদেশে মদ্যপানের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। গত ১৩ ডিসেম্বর, সোমবার বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারির মাধ্যমে জানতে চান যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী মদকে মাদকদ্রব্যের আইনের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না।
রিট আবেদনকারীর ভাষ্য, মদকে অন্যান্য মাদকদ্রব্যের সঙ্গে শ্রেণিভুক্ত করার ফলে নিষিদ্ধ মাদকের মধ্যে মদ বা অ্যালকোহলকে রাখা হয়েছে। কিন্তু অ্যালকোহল আমদানি-রপ্তানিযোগ্য পণ্য। এটি মাদকদ্রব্যের শ্রেণির মধ্যে পড়ে না। পৃথিবীর অনেক দেশেই এটি মাদকদ্রব্যের শ্রেণিভুক্ত নয়। এটির কার্যক্রম এবং প্রয়োজনীয়তা মাদকের যে সংজ্ঞা তার সঙ্গে তুলনীয় নয়।

কী আছে বাংলাদেশের আইনে?
বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়ায় এদেশের আইনে মদ নিষিদ্ধ। দেশের মুসলিম নাগরিকদের জন্য এটি অবৈধও বটে। কোনো মুসলিম চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া মদ বা মদজাতীয় কোনো পানি পান করতে পারবেন না।
২০০০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের যে সংশোধন করা হয়েছে ২০১৮ সালে, সেখানে বলা হয়েছে : "পারমিট ব্যতীত কোনো ব্যক্তি অ্যালকোহল পান করিতে পারিবেন না এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে সিভিল সার্জন অথবা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অন্যূন কোনো সহযোগী অধ্যাপকের লিখিত ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত কোনো মুসলমানকে অ্যালকোহল পান করিবার জন্য পারমিট প্রদান করা যাইবে না।"
মুসলিমদের জন্য এদেশে মদ নিষিদ্ধ হলেও, বিদেশি নাগরিক ও অমুসলিমদের জন্য মদ্যপানের অনুমতি রয়েছে। তবে বিদেশিদের জন্য মদ্যপানে নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও, লাইসেন্সকৃত বার বা ক্লাবে বসে মদ্যপান করতে হবে তাদের। বাড়িতে বা বাইরে অন্য কোনো জায়গায় বসেই মদ্যপান করতে পারবেন না তারা। এমনকি বাড়িতে মদ সংরক্ষণও করা যাবে না।
এদিকে পারমিট নিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের বানানো তাড়ি ও পচুঁই কেনার সুযোগ রয়েছে মুচি, মেথর, ডোম, ঝাড়ুদার ও চা বাগানের শ্রমিকদের। অন্যদিকে, ২১ বছরের কমবয়সি কোনো ব্যক্তির কাছেই মদ বিক্রি করা যাবে না।

মজার ব্যাপার হলো, এতসব নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স বা পারমিট নিয়ে মদ বিক্রি ও পানের সুযোগ রয়েছে। অবশ্য আইনে এ কথাও বলা হয়েছে যে একটানা তিন বছর কোনো লাইসেন্স বা পারমিট নবায়ন করা না হলে তা পুনরায় নবায়নযোগ্য হবে না।
সব মিলিয়ে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের আইনে মদ্যপান বিষয়ক নীতিমালা অত্যন্ত জটিল ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। এ কারণেই মদ নিয়ে হাইকোর্টের তোলা প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মদ যদি আসলেই মাদক হয়, তাহলে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম মাদক আমদানিকারক।
আর কোন কোন দেশে মদ্যপান বেআইনি?
বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই মদ্যপান একটি অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের মতো হাতে গোনা কয়েকটি দেশে আজও মদ্যপান নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশাপূর্ণ আইন। দিনশেষে সকল দেশেই কোনো না কোনো উপায়ে মদ্যপানের পথ খুঁজে নেয় নাগরিকরা, তবু আইনত মদকে আংশিক বা পরিপূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে রেখেছে ওই দেশগুলো। কোন অজুহাতে মদের উপর এমন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তারা? চলুন, জেনে নেওয়া যাক।
ইয়েমেন
ইয়েমেনে মদ পুরোপুরি নিষিদ্ধ, কেননা মদ ইসলামী শরিয়তেও নিষিদ্ধ। ইয়েমেনিদের নিজ দেশে মদ্যপানের অনুমতি নেই, এবং এডেন ও সানা'আ বাদে দেশে অন্যান্য জায়গায় মদ বিক্রিও বেআইনি। নির্দিষ্ট ওই দুটি শহরের কিছু নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁ, হোটেল ও নাইট ক্লাবে মদ বিক্রি করা যায়। বিদেশি অমুসলিমরা দেশটিতে সীমিত পরিমাণ মদ তাদের সঙ্গে বহন করতে এবং অপ্রকাশ্যে পান করতে পারে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (শারজা)
কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আমিরাতগুলোতে মদ বিক্রি করা হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম শারজা, যেখানে মদ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। শারজায় কেবল তারাই (সাধারণত অমুসলিমরা) নিজেদের কাছে মদ রাখতে পারে, যাদের সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া আছে। তাছাড়া যাদের কাছে লাইসেন্স রয়েছে, তারাও কেবল নিজেদের বাড়ির ভেতরেই মদ্যপান করতে পারে। প্রকাশ্যে মদ্যপান, মদ বিক্রি কিংবা মদের যেকোনো ধরনের ব্যবহার নিষিদ্ধ, এবং কেউ এর অন্যথা করলে তাকে কারাদণ্ড, চাবুকের আঘাত বা অন্যান্য শাস্তি দেওয়া হয়। এছাড়া অন্য আমিরাতগুলোর রেস্তোরাঁ, হোটেলসহ অন্যান্য স্থানে মদ বিক্রি করা যায়, কেবল যদি বিক্রেতার কাছে একটি বৈধ মদ বিক্রির লাইসেন্স থাকে। কিন্তু কোনো আমিরাতেই প্রকাশ্যে মাতলামি সহ্য করা হয় না। বিদেশ থেকে আগতদেরও শুধু তাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য সীমিত সংখ্যক মদের বোতল আনতে দেওয়া হয়।
সুদান
উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সুদানেও মদ নিষিদ্ধ। এই ইসলামী রাষ্ট্রে সেই ১৯৮৩ সাল থেকেই মদ বা মদজাতীয় পানীয় উৎপাদন, বিক্রি এবং পান নিষিদ্ধ। সুদান সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন পার্টির পাশকৃত 'লিকার প্রোহিবিশন বিল'-এর মাধ্যমে এই আদেশ জারি করা হয়েছে। তবে এই দেশেও, মদ্যপানের আইনটি প্রাথমিকভাবে শুধু মুসলিমদের জন্যই প্রযোজ্য। অমুসলিমরা তাদের ব্যক্তিগত পরিসরে মদ্যপান করতে পারে। বিদেশি ভ্রমণকারীদের বলা হয়ে থাকে, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে তারা যেন মদ্যপানের আইনসহ সুদানের স্থানীয় সকল আইনের প্রতি সম্মান দেখায় ও সেগুলো মেনে চলে।
সোমালিয়া
হর্ন অব আফ্রিকায় অবস্থিত সোমালিয়া মদ্যপান বিষয়ক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে খুবই কঠোর। এখানে মদ উৎপাদন, বিক্রি এবং পান্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ। অবশ্য অমুসলিম এবং ভ্রমণরত বিদেশিরা যদি মদ্যপানে আগ্রহী হয়, তবে তাদেরকে তা করতে হয় নিজেদের ব্যক্তিগত পরিসরে। দেশের ভেতরে যারা ইসলামী শরীয়ত অমান্য করে, তাদের কড়া সাজা দেওয়া হয়।

সৌদি আরব
বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র হিসেবে বিবেচিত সৌদি আরবে মদ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এদেশে মদ উৎপাদন, বিক্রি ও পান করার অনুমতি নেই। বিমানবন্দরগুলোতে খুব কড়াকড়ির সাথে আগত যাত্রীদের ব্যাগপত্র তল্লাশি করা হয়, যেন কেউ মদ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে মদ নিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। প্রকাশ্যে যারা মদ বিক্রি বা পান করতে গিয়ে ধরা পড়ে, তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। যেমন : দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড বা চাবুকের আঘাত। বিদেশিদেরও বলে দেওয়া হয় যেন তার সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে সাবধান থাকে এবং দেশটি ভ্রমণকালে মদ্যপান থেকে বিরত থাকে।
মৌরিতানিয়া
উত্তর পশ্চিম আফ্রিকার ইসলামী প্রজাতন্ত্র মৌরিতানিয়া। এখানে মুসলিম অধিবাসীদের মদ সঙ্গে রাখা, পান, বিক্রি ও উৎপাদন নিষিদ্ধ। তবে অমুসলিমদের নিজেদের বাড়ি বা এমন সব হোটেল বা রেস্তোরাঁয় মদ্যপানের সুযোগ রয়েছে, যেসব জায়গায় বৈধভাবে মদ বিক্রি করা হয়।
মালদ্বীপ
মালদ্বীপ একটি জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য, যেখানে রয়েছে বিশ্বমানের সমুদ্রসৈকত ও বিলাসবহুল রিসোর্ট। কিন্তু এখানে স্থানীয় জনগণের জন্য মদ্যপান নিষিদ্ধ। দেশটিতে রিসোর্টগুলো এবং কিছু হোটেল ও রেস্তোরাঁয় ভ্রমণকারীদের জন্য মদ বিক্রির বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়।

পাকিস্তান
স্বাধীনতার পর তিন দশক ধরে পাকিস্তানে মদ্যপানের অনুমতি ছিল। কিন্তু জুলফিকার আলি ভুট্টোর শাসনামলে মদকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৭ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেও নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। বর্তমানে দেশটিতে মুসলিমরা মদ তৈরি করতে, বানাতে বা পান করতে পারে না। কিন্তু অমুসলিম সংখ্যালঘুরা মদ্যপান বা বিক্রির জন্য পারমিটের আবেদন করতে পারে। প্রায়ই এসব পারমিট দেওয়া হয় ব্যক্তিবিশেষের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে। সাধারণত দেশটিতে একজন অমুসলিমকে মাসে পাঁচ বোতল মদ এবং ১০০ বোতল বিয়ার পানের অনুমতি দেওয়া হয়।
লিবিয়া
বাইরের দেশ থেকে আগত ভ্রমণকারীদেরকে লিবিয়ায় তাদের স্থানীয় প্রথা ও বিধিনিষেধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে বলা হয়। দেশটিতে মদ বিষয়ক আইন অত্যন্ত কড়া; মদ বিক্রি ও পান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যারা এ আইন অমান্য করে এবং প্রকাশ্যে মদ বিক্রি বা পান করে, তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। তবে তারপর দেশটির বিভিন্ন জায়গায় বেআইনিভাবে মদ বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যায়।
কুয়েত
কুয়েতে মদ বিক্রি, পান বা সঙ্গে রাখা আইনত নিষিদ্ধ। এখানে মদ্যপান করে গাড়ি চালানোর ক্জিরো-টলারেন্স নীতি মানা হয়। এমনকি সামান্য পরিমাণ মদের অস্তিত্বও যদি কোনো গাড়ি চালকের শরীরে পাওয়া যায়, তবে তাকে চড়া মাশুল গুনতে হয়। পাবলিক প্লেসে মদ্যপান নিষিদ্ধ, ফলে বিদেশিদেরও কারাদণ্ড দেওয়া হয় বা নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

ভারত (নির্দিষ্ট কিছু রাজ্যে)
ভারতে মদ বিক্রি, মালিকানা ও পান একটি রাজ্যভিত্তিক বিষয়। গুজরাট, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, এবং সম্প্রতি বিহারে, রাজ্যসীমানার ভেতর মদ বিক্রি ও পানকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মণিপুর ও লক্ষদ্বীপেরও কিছু অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে মদ নিষিদ্ধ। ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোতে মদের উপর কোনো বিধিনিষেধ নেই। তবে কয়েকটি রাজ্যে বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যে 'ড্রাই ডে' পালিত হয়। অন্যদিকে নির্বাচন চলাকালীন বা গান্ধী জয়ন্তীর মতো জাতীয় ছুটির দিনে 'ড্রাই ডে' পালন করা হয়।
ইরান
ইরানে মুসলিম নাগরিকদের জন্য মদ্যপান নিষিদ্ধ। তবে এখানে অমুসলিমদের জন্য আইন শিথিল করা হয়েছে, ফলে তারা নির্দিষ্ট কিছু শর্ত মেনে মদ প্রস্তুত ও পান করতে পারে। এছাড়া বাইরের দেশ থেকে অমুসলিমরা সঙ্গে করে মদ নিয়েও আসতে পারে।
ব্রুনাই
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্র ব্রুনাই। এখানে জনসম্মুখে মদ বিক্রি ও পান নিষিদ্ধ। তবে প্রাপ্তবয়স্ক অমুসলিমরা বাইরের দেশ থেকে আগতদের মাধ্যমে দুই বোতল মদ ও ১২ বোতল বিয়ারের ক্যান আমদানি করতে পারে। এজন্য তাদেরকে বিমানবন্দরের কাস্টমসে বিষয়টি অবগত করতে হয়, এবং একান্ত নির্জনেই কেবল তারা ওই আমদানিকৃত মদ পান করতে পারে।