‘বাংলাদেশ’ নামটি কীভাবে এলো?

নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসাবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ নামক দেশটি। আজ বাংলাদেশ আমাদের অস্তিত্বের পরিচায়ক, আমাদের এক পরম গৌরবের নাম। কিন্তু তারপরও অনেক সময়ই হয়তো মনের কোণে উঁকি দিয়ে যায় একটি প্রশ্ন, 'বাংলাদেশ নামটি কীভাবে এলো?'
একটি দেশের জন্য নামকরণ প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ নামকরণের পেছনেও রয়েছে সুবিশাল ইতিহাস। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক নানা ঘটনার সম্মিলিত অবদান রয়েছে এই নামকরণে। এই বাংলা ভূখন্ড ভারত উপমহাদেশের অন্যতম 'রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ অঞ্চল' বলে পরিচিত। ইতিহাসের নানা মোড়ে 'বাংলাদেশ' নামটির পরিভ্রমনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
বঙ্গ ভূখন্ড নামে এদেশের পথচলার ইতিহাস বেশ পুরাতন। যীশু খ্রিস্টের জন্মের বহু আগে ল্যাটিনদের নানা রচনাতে 'গঙ্গারিডি' নামের প্রচলন দেখা যায়। তারা ভ্রমণকালে এসব উল্লেখ করে থাকতে পারে। বিশেষত, ঐতিহাসিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিসের বিখ্যাত 'ইন্ডিকা' গ্রন্থে আমরা গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ঘটনার বিবরণ পাই। সেখানে তিনি বলেছেন আলেকজান্ডার প্রায় সমগ্র পৃথিবী জয় করে ফেললেও 'গঙ্গারিডাই' আক্রমন পর্যন্ত করেননি। এছাড়া টলেমিসহ অন্যান্য গ্রীক ঐতিহাসিকদের বহু রচনায় এই শব্দের উল্লেখ আছে।
প্রাচীন রচনাবলিতে গঙ্গা, গঙ্গারিডাই ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মতভেদ থাকলেও বঙ্গ শব্দটি নিয়ে খুব বেশি মতানৈক্য নেই। 'রিয়াজ-উস-সালাতিন' গ্রন্থে গোলাম হোসেন সলিম 'বঙ্গের' ইতিহাস বর্ণনা করেছেন ধর্মীয় দৃষ্টিকোনে। তার মতে, নূহ (আ.) নবীর আমলে মহাপ্লাবনের পরে পৃথিবীজুড়ে তাঁর পুত্রসহ ৮০ জন নরনারী বংশবিস্তারের কাজে নিযুক্ত হন। এশীয় ভূখন্ডে তাঁর পুত্রত্রয় সিন্ধ, হিন্দ এবং বঙ্গের নামানুসারে যথাক্রমে সিন্ধু, হিন্দুস্থান এবং বঙ্গের নামকরণ হয়। এছাড়াও, হিন্দু ধর্মানুযায়ী নানা ঘটনার উল্লেখ আছে। তাদের পৌরাণিক কাহিনিতে অঙ্গ, বঙ্গ, পুন্ডের কথা পাওয়া যায়।
তবে, 'বাংলা'র উৎপত্তি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তাঁর মতে, বাংলা শব্দটি এসেছে বঙ্গ থেকেই। এ অঞ্চলে আর্যদের বাস থাকায় তারা একে বঙ্গ নামে অভিহিত করত। অন্যান্য স্থানীয়রা বঙ্গের সাথে ফারসি প্রত্যয় 'আল' যোগ করে বাঙ্গাল নামকরণ করে। ড. আনোয়ার হোসেন ঐতিহাসিক আবুল ফজলকে বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন।
'আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থের রচয়িতা আবুল ফজলের মতে 'আল' শব্দের অর্থ বাঁধ দেয়া। এ অঞ্চল জলাকীর্ণ থাকায় শাসকগণ নানা সময়ে বিভিন্ন বাঁধ তৈরি করতেন ফসল এবং জনপদ রক্ষার্থে। তাছাড়া, আল শব্দটি দিয়ে ফসলি ক্ষেতের সীমানাকে বোঝানো হতো। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা তাঁর প্রসাশনিক অঞ্চলকে (বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা) বঙ্গ বলে পরিচিত করিয়েছিলেন। আবুল ফজলের বইতে আরো পাওয়া যায়, এ অঞ্চলে সুলতানি এবং মোঘল উভয় মুসলিম শাসনামলেই তারা 'বাঙালাহ' শব্দটি ব্যবহার করতেন। নিকট অতীতে বাংলা সাহিত্যের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম এবং চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তাদের কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবেই বঙ্গদেশ, বাংলাদেশ ব্যবহার করেছেন।

ইংরেজ আমলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি নামে বাংলা পরিচিতি পায়। তবে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলে আমাদের এই অঞ্চল পূর্ববাংলা নামধারন করে। আবার, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হবার পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হলো। তবে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হলো নামকরণ নিয়ে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা জনগনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এদেশের নাম 'পূর্ব পাকিস্তান' করার চেষ্টা চালায়। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কাগজে-কলমে যদিও 'পূর্ব বাংলা' নামটিই প্রচলিত ছিল, কিন্তু 'পূর্ব পাকিস্তান' নামকরণের তৎপরতাও জারি ছিল।
১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, "স্যার, আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে, তারা পূর্ব বাংলার স্থলে 'পূর্ব পাকিস্তান' বসাতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়ে এসেছি যে, [পূর্ব] পাকিস্তানের পরিবর্তে আপনাদের [পূর্ব] বাংলা ব্যবহার করতে হবে। 'বাংলা' শব্দটির একটি ইতিহাস আছে, আছে নিজস্ব একটি ঐতিহ্য...। আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নিবে কি না সেজন্য গণভোট নিতে হবে।"
এতকিছুর পরেও তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কাউকে তোয়াক্কা না করেই পুর্ব বাংলাকে সরকারিভাবে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। ৬০-এর দশকের থেকে 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' ধারণাটি জনগনের মাঝে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। ১৯৬৯ সালে সামরিক সরকার আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন প্রকট রুপ লাভ করে। গণঅভ্যুত্থানে একটি স্লোগান ছিল এমন : "বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো"। বলা যায় এ আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙ্গালী ভাষাভাষীর প্রাণের শব্দ 'বাংলাদেশ' কথাটি ইতিহাসের পাতায় গেঁথে যায়।
'বাংলাদেশ' নামকরণের দাবি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি ভাষণের পর থেকে। যারা 'পূর্ব পাকিস্তান' নামটি বদলাতে চাচ্ছিলেন তাদের যুক্তির প্রধান ভিত্তি ছিল, যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে গেছে এবং প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে সিন্ধ, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের সাবেক প্রাদেশিক নাম পুনর্জীবিত হচ্ছে, তাই পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে পূর্বে অবস্থিত প্রদেশের নাম আর 'পূর্ব পাকিস্তান' রাখা সংগত হবে না।

ওই বছরেরই ৫ ডিসেম্বর, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভাতে তৎকালীন নেতারা এ অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন। উল্লেখযোগ্য নামগুলো 'স্বাধীন পূর্ব বাংলা', 'বাংলা', 'বেঙ্গল', 'ইস্ট বেঙ্গল', 'বঙ্গ', 'বঙ্গ দেশ'। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 'বাংলাদেশ' নামটি উত্থাপন করেন। অধিকাংশ নেতাকর্মীই 'বাংলাদেশ' নামটি মেনে নেন। ৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন পত্রিকায় 'বাংলাদেশ' নামকরণের খবর ছাপা হয়। 'পাকিস্তান অবজার্ভার'-এ আতাউর রহমান খান, বঙ্গবন্ধুর এই নামকরণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেন। এছাড়া ন্যাপের মওলানা ভাসানী ৭ ডিসেম্বর এক জনসভায় বাংলাদেশ নামকরণ সমর্থন করে বলেন, "ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে 'বাংলাদেশ' নামকরণই হবে সঠিক এবং যথার্থ।" তিনি যুক্তি দেন, "যেহেতু এক ইউনিট ভেঙে গেছে, তাই 'বাংলাদেশ' নামটি পুনরুজ্জীবিত হওয়া উচিত।"
তখন পর্যন্ত সরকারী নথিপত্রগুলোয় 'পূর্ব পাকিস্তান' লিখতে হলেও কেউ মুখে 'পূর্ব পাকিস্তান' বলতেন না। সবাই 'বাংলাদেশ' বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে বঙ্গবন্ধু বেতারে তাঁর স্বাধীনতার ঘোষনাকালেও 'বাংলাদেশ' শব্দটি উল্লেখ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত হওয়া অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের নানা ঘোষণাপত্রে 'বাংলাদেশ' ব্যবহৃত হয়। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনতা লাভ করলে সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ নামকরণ হয়। এর মাধ্যমে হাজার বছরের পথচলা সমাপ্তি হয়ে 'বাংলাদেশ' নামক সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম লাভ করে।