সাগরকে চোখে চোখে রাখা তার কাজ; তিনি লাইফগার্ড, ডুবন্ত মানুষ উদ্ধার করেন

প্রতিদিন আট ঘণ্টা করে সাগরের ওপর নজর রাখেন জয়নাল আবেদীন ভুট্টো। ঢেউয়ের গতি ও উচ্চতা লক্ষ্য রাখার কাজ তার। তিনি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের একজন লাইফগার্ড। লাবনী পয়েন্ট, সুগন্ধা বিচ আর কলাতলি বিচে পালা করে কাজ করেন তিনি। তাদের দলে ২৭ জন লাইফগার্ড আছেন। প্রতিদিন দুই শিফটে ভাগ হয়ে তারা কাজ করেন। প্রথম দলটি আসে সকাল ৭টায়, দ্বিতীয় দলটি সকাল ১১টায়। শীতকালে তাদের কাজের সময় এক ঘণ্টা কমে যায়। সে হিসেবে প্রথম দল সকাল আটটায় এসে দুপুর ৩টা অবধি আর দ্বিতীয় দল এগারটায় এসে থাকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। দুই দল একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করে চার ঘণ্টা। সমুদ্র নজরে রেখে লাইফগার্ড বা লাইফসেভাররা মূলত পর্যটকদের সমুদ্রে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন।
পতাকার রং লাল-হলুদ
প্রতি পয়েন্টে ৩–৪ জন লাইফগার্ড থাকেন। সকালে এসে প্রথমে তারা সাগরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। নির্দিষ্ট বিচের তুলনামূলক বেশি নিরাপদ চারশত মিটার জায়গা তারা নির্বাচন করেন দুটি বিষয় বিচার করে — উল্টো স্রোতের গতি এবং অনশোরে খালের অবস্থান দেখে। তারপর ৪০০ মিটারের দুই প্রান্তে দুটি লাল-হলুদ পতাকা গেড়ে দেন। মাঝখানে দুই মানুষ সমান উঁচু একটি ওয়াচ টাওয়ার বসান যেখানে দুইজন বসতে পারেন। টাওয়ার বসানোর পর একটি হার্ডবোর্ডে লাইফগার্ড লিখতে থাকেন বাতাস কোন দিক থেকে বইছে, বাতাসে তাপমাত্রা কত, জলের তাপমাত্রা কত, ঢেউয়ের উচ্চতা কত, জোয়ার বা ভাটার শুরু ও শেষ সময় এবং দুয়ের পিক টাইম। বোর্ডটি তারপর টাঙিয়ে দেন টাওয়ারের মাথায়। যারা সাগরজলে ভাসতে চান তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই কাজগুলো করা হয়ে থাকে। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সি সেফ নামের প্রকল্পের অধীনে কাজ করেন লাইফগার্ডরা। ভুট্টো একজন সিনিয়র লাইফগার্ড।

২০০৭ সালে ভুট্টো এসএসসি পাশ করেন। কক্সবাজারের স্থানীয় তারা। প্রায় বিকালেই সৈকতে আসেন। ততদিনে সার্ফার হিসাবে জাফর আলমের নাম দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢেউয়ের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে জাফরের চলাচল দেখে ভুট্টো মুগ্ধ হন। সার্ফিংয়ে আগ্রহী হয়ে পরিচিত হন জাফরের সঙ্গে। সার্ফিংয়ের তালিম নিতে থাকেন। ওই সময়ও লাইফ সেভিংয়ের কাজ করেছেন ভুট্টো। কিন্তু ভাবেননি এটিই একদিন তার পেশা হয়ে উঠবে।
আরএনএলআই দিলো প্রশিক্ষণ
২০১১ সালে যুক্তরাজ্যের আরএনএলআইয়ের (রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট) কয়েকজন কর্মী কক্সবাজার আসেন। ১৮২৪ সালে বিপদগ্রস্ত জাহাজ থেকে প্রাণ রক্ষার তাগিদে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন ফর দ্য প্রিজারভেশন অব লাইফ ফ্রম শিপরেক নাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় আরএনএলআই। পরে ১৮৫৪ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ায় রয়্যাল শব্দটি যুক্ত হয় নামের আগে। ছয় বছর পর ১৮৬০ সালে বর্তমান নামকরণ হয়। ২০২২ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংগঠনটি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড এবং আইল অব মানের ২০০টি সমুদ্রসৈকতে লাইফগার্ড সেবা দিয়ে থাকে আরএনএলআই।

কক্সবাজার সৈকতে আরএনএলআইয়ের কর্মীরা হাজার হাজার মানুষের সমাগম দেখতে পান, অথচ লাইফসেভিংয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় বিস্মিত হন। ভুট্টো জানালেন, তখনো স্বল্পসংখ্যক লাইফগার্ড ছিল, আমরা সার্ফাররাও খালে বা উল্টোস্রোতে ভেসে যাওয়া পর্যটকদের উদ্ধার করতাম, কিন্তু কেউই প্রশিক্ষিত ছিলাম না। সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখেশুনে আরএনএলআই পাঁচ দিনের এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেয়। ফিটনেস, সাঁতারে দক্ষতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে তারা সার্ফারদের অগ্রাধিকার দেয়।
ভুট্টো বললেন, 'প্রথমে তারা আমাদের ঢেউ চেনালেন, সাধারণ সময়ে কক্সবাজারে তিন ধরনের ঢেউ দেখা যায়: উঁচু হয়ে আসা তরঙ্গায়িত ঢেউ, দলবদ্ধ ঢেউ এবং ভেঙে ভেঙে আসা দলছুট ঢেউ। সাধারণত বিপদ ঘটে বিপরীত স্রোতে যখন ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ে ফিরে যায়। এসময় স্রোতটা কোনো খালের মধ্য দিয়ে যেতে থাকলে তার গতি বৃদ্ধি পায় এবং মানুষ তা সামলে উঠতে পারে না। এরপর শিখলাম উদ্ধার কৌশল। রেসকিউ টিউব, রিং বয়া, স্পাইনবোর্ড বা বোট দিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হয়। টিউব দিয়ে বেঁধে, বয়ায় ভাসিয়ে আর বেশিসংখ্যক লোক হলে বোটে উঠিয়ে বিপর্যস্ত ব্যক্তিকে আমরা পাড়ে নিয়ে আসি।

'ফার্স্ট এইড প্রয়োগের নিয়মাবলিও শেখানো হলো। সাগরে বিপদগ্রস্ত মানুষকে নিরাময় করার প্রথম পদক্ষেপ আরামে রাখা। যিনি বেশি বিপদগ্রস্ত মানে চৈতন্য হারিয়েছেন এবং শ্বাস নিতে পারছেন না তাকে সিপিআর (বুকে চাপ দিয়ে মুখ দিয়ে বাতাস প্রবেশ করানো) প্রয়োগ করা হয়। অনেকের আবার পায়ের হাড় ভেঙে যায়, কেউ কেউ আক্রান্ত হয় স্টিং রে বা জেলি ফিশ দিয়ে। আমরা চেষ্টা করি দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার।'
স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন তিন বছর
প্রশিক্ষণ শেষে ভুট্টো ও সতীর্থ সার্ফাররা তিনবছর স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন শুক্র ও শনিবার এবং বিশেষ বিশেষ দিন যেমন বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ বা দশমিতে। আরএনএলআইয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া কিছু ইকুইপমেন্ট ও পোশাক ছিল তাদের সম্বল। লাইফগার্ডরা হলুদ টি-শার্ট বা জ্যাকেট এবং লাল হাফ প্যান্ট পরে থাকেন। কারণ জানতে চাইলে ভুট্টো বললেন, 'সাগরে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি চোখে ঝাপসা দেখতে থাকেন, তখন হলুদ ও লাল রং তাকে বেশি সাহায্য করে। আমরা ভালো মানের সানগ্লাসও ব্যবহার করি যেন সমুদ্রে অনেকদূর পর্যন্ত দেখতে পারি।'
২০১৪ সালে ভুট্টো পেইড লাইফগার্ড হন সি সেফ প্রকল্পে। সপ্তাহে ডে অফ পেলেন একদিন করে। কোনোদিন ডে শিফটে কোনোদিন মর্নিং শিফটে ডিউটি পড়ে। লাইফগার্ডরা কর্তব্যরত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন না। ওয়াকিটকি দিয়ে ক্যাম্প অফিস এবং প্যাট্রল গার্ডদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। প্রতি ২০ মিনিট পর পর ওয়াচার এবং প্যাট্রল গার্ড স্থান বদল করেন। তখন ওয়াচার প্যাট্রলিংয়ে বের হন আর প্যাট্রল গার্ড ওয়াচারের দায়িত্ব পালন করেন। নির্ধারিত ৪০০ মিটারের বাইরে যারা সাগরে নেমেছেন, তাদেরকে ভেতরে চলে আসতে অনুরোধ করেন প্যাট্রলগার্ডরা।

অনেকসময় লাইফসেভারদের সঙ্গে পর্যটকরা বাজে ব্যবহার করেন, বয়া ব্যবসায়ীরা গায়ে হাত পর্যন্ত তোলেন। সবক্ষেত্রেই গার্ডকে নম্রতা বজায় রাখতে হয়। পর্যটক নিরাপত্তা সীমার বাইরে থাকলে বয়া যারা ভাড়া দেন তাদের সুবিধা হয়, ব্যবসায়ীরা তাই গার্ডদের ভালো চোখে দেখেন না। প্রায়শই তারা উগ্র আচরণ করেন এবং পর্যটকদেরও ভুল বুঝিয়ে ক্ষেপিয়ে তোলেন।
রেকর্ড করেছে ২০২৩
গার্ডরা সমুদ্রতট থেকে ৫০০ মিটার দূর পর্যন্ত উদ্ধার কাজ চালাতে পারেন। পেইড গার্ড হওয়ার আগে ২০১৩ সালে একটি শিশুকে উদ্ধার করেছিলেন ভুট্টো যা তার কর্মজীবনের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। শিশুটি স্রোতের টানে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল, গলা পর্যন্ত ডুবে জোরে জোরে চিৎকার করছিল। ভুট্টো কোনো ইকুইপমেন্ট ছাড়াই নেমে পড়েছিলেন সাগরে, দ্রুত সাতরে চলে গিয়েছিলেন কাছে। শিশুটি ততক্ষণে দুইবার ডুবে আবার ভেসে উঠেছে। নতুন বিপরীত স্রোত আসার আগেই তাকে উদ্ধার না করা গেলে আরও দূরে চলে যাবে, হয়তো হারিয়েই যাবে। ভুট্টো তাই সর্বশক্তি দিয়ে সাঁতরে গিয়ে ছেলেটির কোমর পেঁচিয়ে ধরেন। শিশুটিকে যতটা পারেন নোনাজল বাঁচিয়ে নিয়ে আসেন তীরে। শিশুটির পিতা-মাতা সব আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন, অবশেষে হারানো মানিক ফিরে পেয়ে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন, ভুট্টোকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন অনেকক্ষণ।

ভুট্টোর লাইফগার্ড জীবনের সবচেয়ে খারাপ বছর ২০২৩ সাল। দশটি ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটে ওই বছর। একবার একসঙ্গে ১০ জন হারিয়ে যেতে বসেছিলেন। টিউব নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন ভুট্টো ও আরও দুই লাইফগার্ড। ভুট্টোদের লক্ষ্য ছিল সবাইকে ফিরিয়ে আনা কিন্তু বোট প্রস্তুত করার সময় পাননি। সাঁতরে গিয়ে যখন পৌছালেন অকুস্থলে, দেখেন একজন চৈতন্য হারিয়ে ফেলেছেন। ভুট্টো তার হাত ধরে ফেলেন, অন্য একজনকে টিউব দিয়ে আটকে নিলেন। এর মধ্যে আরেকটি উঁচু ঢেউ এসে অচেতন ব্যক্তিকে ছিনিয়ে নিতে চাইল। ভুট্টো আরও শক্ত করে ধরলেন, এর মধ্যে এলো আরেকটি ঢেউ। ভুট্টোর এবার নিজেকে ভাসিয়ে রাখা কঠিন হলো।
ভাগ্য ভালো বলতে হয়, সতীর্থ যে গার্ড লাঞ্চ ব্রেকে গিয়েছিল সে নৌকা নিয়ে অকুস্থলে হাজির হন। সবাইকে নৌকায় উঠিয়ে নিয়ে শেষে তারা তীরে পৌঁছেছিলেন। অনেকেরেই শ্বাসনালি নোনাজলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো পরিষ্কার করার পর কেউ কেউ আরাম বোধ করেছিলেন। তবে যিনি চেতনা হারিয়েছিলেন তাকে নিয়ে যেতে হয়েছিল হাসপাতালে। শেষপর্যন্ত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

যদিও চামড়া পুড়ে যায়
লাইফগার্ডের কাজ ভুট্টোর ভালো লাগে; যদিও রোদে চামড়া পুড়ে যায় বা শীতে কাঁপুনি ধরে যায়। কিন্তু জীবন বাঁচানোর মতো আনন্দ তো অন্য কিছুতে মেলে না। ভুট্টো বলছিলেন, কক্সবাজারে সারাদেশ থেকে, বিশ্বেরও অনেক দেশ থেকে লোক আসে। সবার সঙ্গেই যোগাযোগ করার সুযোগ থাকে লাইফগার্ডের। 'কাউকে উদ্ধার করার পর সৈকতের মানুষজন সব আমাদের ঘিরে ধরে, আনন্দ প্রকাশ করে, দোয়া করে। তখন নিজেকে সার্থক মনে হয়।'
ভুট্টোর বয়স এখন তেত্রিশ। দুই মেয়ে তার, বড়টির বয়স সাত। বাবার জীবন রক্ষাকারী কাজের ব্যাপারটি সে বোঝে এবং বাবাকে ভালোবাসে। ভুট্টো বলেন, 'এই বাজারে ভালোভাবে চলার মতো বেতন আমরা পাই না কিন্তু মানুষের কাজে আসতে পারছি, এটাই অনেক কিছু। ছোট মেয়েটার বয়স চারমাস। বড়টি ভালোই বোঝে, সে আমার গল্প বলে বেড়ায় বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনদের কাছে।'
ভুট্টো একজন প্রশিক্ষকও। নতুন ভলান্টিয়ারদের তিনি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন, নিজেরাও রিফ্রেশ প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। এই কাজের বড় পুঁজি শারীরিক সামর্থ্য। ভুট্টো আরও ১২–১৩ বছর লাইফগার্ডের কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন বলে মনে করেন। এরপর পুরোদস্তুর প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে নিয়োজিত হবেন। ভুট্টো বলছিলেন, 'আমাদের লক্ষ্য ডুবে যাওয়াকে শূন্যের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে — আসা তা উদ্ধারের মাধ্যমে যেমন, সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেও।'
ছবি সৌজন্য: জয়নাল আবেদীন ভুট্টো