ঢাকার গাছ বাঁচাতে এক দম্পতির নিঃসঙ্গ লড়াই
ধূসর চুলের লম্বা, সুদর্শন একজন মানুষ বালতি হাতে ঢাকার একটি পার্কের গাছে পানি দিচ্ছেন। বয়সটা সম্ভবত ৬০-এর কোঠায়, পরনে টিশার্ট — তার ওপর ঘামের ছাপ কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তার কাজের দিকে উৎসুক চোখ তুলে তাকানো পার্কের অন্য ভ্রমণকারীদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করছেন না মানুষটা। হয়তো গাছপালার প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়ার এ মনোভাবই তাকে আর সবার কাছ থেকে আলাদা করে তুলেছে।
এজন্যই অভিনেতা মীর সাব্বির সেদিন সকালে জগিং করতে বেরিয়ে এ ভদ্রলোকের কাজ ক্যামেরায় ধারণ করেন। তার সঙ্গে কথা বলে তার কাজের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত ২৫ ডিসেম্বর প্রকাশ করেছিলেন সাব্বির।
এক মাসের কম সময়ে ওই ভিডিওটি দেখেছেন এক লাখ ৪৪ হাজার মানুষ। ওই ভিডিওতে ১০ হাজারের বেশি ইতিবাচক রিয়্যাকশন ও ৫০০ মন্তব্য করেছেন ব্যবহারকারীরা।
'লোকটাকে স্যালুট', 'এ দুনিয়ায় ভালো মানুষের বড়ই অভাব' এবং 'এ ভদ্রলোক অন্যদের অনুপ্রেরণা জোগাবেন' ইত্যাদি কথাই ছিল বেশিরভাগ মন্তব্যের মূলভাষ্য।
সম্প্রতি ওই ভাইরাল ভিডিওটির মানুষটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। তার নাম ড. নওশাদ আহমেদ। পেশায় একজন অর্থনীতিবিদ নওশাদ অতীতে ইউনিসেফ-এর আন্তর্জাতিক কর্মকর্তাদলের অংশ হয়ে কাজ করেছেন।

'আমার স্ত্রী [রওশন জাহান - সাবেক এ সাংবাদিক ঢাকাভিত্তিক একটি ইংরেজি পত্রিকায় কাজ করতেন] ও আমি গত এক দশক ধরে ঢাকার খোলা জায়গাগুলোতে গাছ রোপণ করছি। এরপর আমরা খেয়াল করলাম, নগরে লাগানো এক-চতুর্থাংশের কম চারা পানির অভাবে মারা যায়। তাই গাছে পানি দেওয়ার দায়িত্বটা আমি নিজের কাঁধে তুলে নিই,' ব্যাখ্যা করেন নওশাদ।
ঢাকার ধানমন্ডি লেক পার্ক, মানিক মিয়া এভিনিউর মিডিয়ান, উত্তরা ও পূর্বাচল এলাকায় বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা লাগিয়েছেন এ দম্পতি।
যে সকল জায়গায় তারা গাছ লাগিয়েছেন, সেগুলোতে পাইপ দিয়ে গতানুগতিক পদ্ধতিতে পানি দেওয়া তাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ধানমন্ডি লেক পার্কে গণশৌচাগার থাকলেও পার্করক্ষীরা নওশাদকে এসব শৌচাগার থেকে গাছের জন্য পানি আনতে দেন না।
'তাই আমি লেক থেকে বালতি দিয়ে পানি সংগ্রহ করি। আমার বয়সের একজন মানুষের জন্য এটা সত্যিই কঠিন একটা কাজ। অনেক আত্মীয়স্বজন আমাকে সতর্কও করেছেন। কিন্তু আমি এটাকে শারীরিক ব্যায়াম হিসেবে দেখি,' বলেন নওশাদ।

বর্ষাকাল ছাড়া নওশাদ পার্কের গাছগুলোকে সপ্তাহে একবার করে পানি দেন। গাছের যত্ন নিতে সপ্তাহে সবমিলিয়ে দুইদিন ব্যয় করেন তিনি। মাঝেমধ্যে গাছের গোড়ার মাটিও আলগা করে দেন তিনি যাতে সেগুলো একটু বেশি সময় ধরে আর্দ্র থাকে।
সপ্তাহের বাকি সময়টা নওশাদ বিভিন্ন সংবাদপত্রের জন্য কলাম লিখে কাটান। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার জন্য পরামর্শও প্রদান করেন তিনি।
বাবা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে নওশাদের ছেলেবেলা দেশের বিভিন্ন জেলায় কেটেছে। পুরোনো দিনের সরকারি কোয়ার্টারগুলোর বিশাল উঠানে শাকসবজি জন্মানো হতো। এসব উঠানের বাগানেই নওশাদ গাছের প্রতি তার ভালোবাসা প্রথম খুঁজে পান।

'আমি বিভিন্ন শাকসবজির বীজ সংগ্রহ করতাম। সেগুলোকে বাড়ির উঠানে রোপণ করতাম। বীজ থেকে চারা বের হলে আনন্দের সীমা থাকত না আমার,' নওশাদ স্মৃতিচারণ করেন।
তার স্ত্রী রওশনও একজন বৃক্ষপ্রেমিক।
কিছু নার্সারিকর্মীর সহায়তা নিয়ে এ দম্পতি তাদের বাসার কাছে ধানমন্ডি লেক পার্ক এলাকায় প্রথমবার ৩০০ গাছের চারা রোপণ করেছিলেন।
নওশাদ সুদান ও নাইজেরিয়ায় চাকরি করার সময় রওশন বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম চালিয়ে যান। কিন্তু সে সময় পুরোদস্তুর সাংবাদিকতার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। তাই পার্কের গাছগুলোকে পানি দেওয়ার কাজটা নিয়মিত করতে পারেননি।
২০১৮ সালে জাতিসংঘের চাকরি থেকে আগাম অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন নওশাদ। এ দম্পতি বুঝতে পারেন, গাছ লাগানোর কাজে তাদের শারীরিক শ্রম ও অর্থ অনেকাংশে অপচয় হয়েছে, কারণ পার্ক ও রাস্তার মিডিয়ানে পোঁতা অনেক গাছ পানির অভাবে মারা গেছে।
বছরে ৩৫০টি চারা লাগানোর পর মাত্র ৩০টি গাছ টিকে ছিল।

'তখন থেকেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, নিজেরা গাছে পানি দেব। কারণ মাটির গভীরে মূল পৌঁছার আগ পর্যন্ত গাছে পানি দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ,' নওশাদ ব্যাখ্যা করেন।
এছাড়া যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন নওশাদ। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলদের সঙ্গেও একাধিকবার যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। দেখা গেল, গাছ লাগানোর বেশিরভাগ প্রকল্পে কেবল লাগানোর খরচটাই ধরা হয়েছে, পানি দেওয়ার খরচ নয়।
নওশাদকে নিয়ে মীর সাব্বিরের করা ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আগে তার কাজ নিয়ে কেবল অল্পকিছু মানুষই আগ্রহ ও উৎসাহ প্রকাশ করেছিলেন।
'মজার ব্যাপার হলো, ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর দুজন বৃক্ষপ্রেমিক আমাকে ফোন করেছিলেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে তারা পার্কে পানি দেওয়ার সময় আমার সঙ্গী হচ্ছেন,' আনন্দে উদ্ভাসিত হতে হতে বললেন নওশাদ।