টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির আদি চমচমের খোঁজে...

২০০ বছরের পুরনো টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের নামডাক ও ঐতিহ্যের খবর কে না জানে? সেই পোড়াবাড়িতে বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম চমচম চেখে দেখার।
টাঙ্গাইল শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরত্বের পোড়াবাড়িতে পৌঁছানো যায় ইজিবাইক কিংবা সিএনজি চেপে। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্মস্থান সন্তোষ হয়ে দুইপাশের অপরূপ দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে পৌঁছানো যায় পোড়াবাড়িতে। আধাঘণ্টা থেকে ৪৫ মিনিটের পথ।
তবে যারা কখনো পোড়াবাড়িতে যাননি, তারা প্রথমবার গিয়ে হোঁচট খাবেন! আমার মতো কল্পনায় যারা পোড়াবাড়িকে অনেক বড় বাজার কিংবা জাঁকজমকপূর্ণ স্থান ভেবে বসে আছেন, তারা পোড়াবাড়ির ছোট্ট বাজার দেখে অবাক হবেন! পানেের দোকান, মুদিখানার দোকান, ফলের দোকান, চায়ের স্টল মিলিয়ে পুরো পোড়াবাড়িতে ৪০ থেকে ৫০টির মতো দোকান যার মধ্যে মিষ্টির দোকান রয়েছে মাত্র ৪টি।
পোড়াবাড়ি টাঙ্গাইল সদর উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম। তবে ছবির মতো দেখতে সুন্দর। গ্রামটিতে প্রচুর গাছপালা রয়েছে। আর ধলেশ্বরী নদীর তীরে গ্রামটি অবস্থিত হওয়ায় এর চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য যে কাউকেই টানবে।
টাঙ্গাইলের বাজারের নিরাপত্তা রক্ষী সানোয়ার আলীর সাথে কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, পোড়াবাড়ির বেশ কয়েকটি বাড়িতে সারারাত ধরে চলে মিষ্টি তৈরির কার্যক্রম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একসময় ধলেশ্বরী নদীর পানির সাথে দেশি গাভীর খাঁটি দুধ মিশিয়ে তৈরি হতো ছানা। সেই ছানায় তৈরি হতো সুস্বাদু চমচম। যার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে। কথিত আছে, ধলেশ্বরী নদীর পানির মিষ্টতা আর খাঁটি দুধের ছানার কারণেই পোড়াবাড়ির চমচমের এতো সুখ্যাতি ছিলো।
চমচম তৈরির প্রধান উপকরণ দুধের ছানা, ময়দা আর চিনি। এসব উপকরণে তৈরি চমচমে নরম ভাব যেমন, তেমন ঘ্রাণেও অনন্য। লালচে রঙের পোড়াবাড়ির চমচমের ওপর দুধ জ্বাল দিয়ে শুকিয়ে তৈরি গুঁড়া মাওয়া ছিটিয়ে দেওয়া হয় যাতে স্বাদে আনে অন্যরকম বৈচিত্র্য। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৫ কেজি দুধ জ্বাল দিয়ে শুকিয়ে পাওয়া যায় আধা কেজি মাওয়া। পোড়াবাড়ির এক কারখানায় গেলে তার কারখানায় তৈরি মাওয়া চাখতে দিয়েছিলেন। অসাধারণ স্বাদ, একেবারে দুধের খাঁটি গন্ধ নাকে এসে লাগে। স্বাদে ও ঘ্রাণে অনন্য। তবে অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো ব্যবসায়ী মাওয়ার পরিবর্তে বিস্কুট ছিটিয়ে দেয়।

ইতিহাস বলছে- দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি ধলেশ্বরীর পানি ও গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
এর আগে ১৬০৮ সালে পোড়াবাড়ি গ্রামটিকে নদীবন্দর হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সে সময়কালে ধলেশ্বরীর পশ্চিম তীরে গড়ে উঠেছিল জমজমাট ব্যবসাকেন্দ্র পোড়াবাড়ি বাজার। তখন পোড়াবাড়ি ঘাটে ভিড়তো বড় বড় সওদাগরি নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার। এ বাজারে যোগ হয় সুস্বাদু চমচম, গড়ে ওঠে মিষ্টির বাজার। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে।
তবে এখন আর পোড়াবাড়ির সেই সুখ্যাতি নেই। নদীতে বাঁধ দেওয়ায় নদীর পানির সেই প্রবাহও নেই। দেশি গরুও আর লালন-পালন করেন না স্থানীয় খামারিরা। বেশি দুধের আশায় বিভিন্ন ধরনের বিদেশি গরু এখন পালন করেন স্থানীয় চাষীরা। ফলে দুধের সেই স্বাদও নেই। তারপরও প্রতিদিন পোড়াবাড়িতে বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দুধের হাট বসে। ধলেশ্বরী নদীর পাড়ের খামারিরা দুধ নিয়ে এসে এই হাটে বিক্রি করেন। আগে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ মণ দুধ বিক্রি হলেও এখন তা কমে গিয়ে ১০০ মণে দাঁড়িয়েছে। দাম ৮০ টাকা থেকে ৯০ টাকা কেজি।
স্থানীয় বাসিন্দা আইনাল মুন্সী জানালেন, বাঁধ দেওয়ায় নদীর পানির সেই প্রবাহ আর নেই। প্রবাহ না থাকায় বদ্ধ পানি ব্যবহারপযোগীও নেই। আগে দেশি গরুকে নদীর চরের ঘাস খাইয়ে লালনপালন করা হতো। এখন ফিডসহ নানাধরনের খাদ্য খাওয়ানোতে দুধের সেই ঘনত্বও আর নাই। তাই পোড়াবাড়ির সেই বিখ্যাত চমচমও আর পাওয়া যায় না। পুরো পোড়াবাড়ি জুড়ে আট থেকে ১০টি কারখানায় মিষ্টি উৎপাদন হয়। তার মধ্যে চারটি কারখানায় উৎপাদিত চমচম পোড়াবাড়ি বাজারে বিক্রি হয়। বাকিগুলো অর্ডার মোতাবেক দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।

সন্ধ্যা থেকে সারারাত জুড়ে চলে কারখানায় চমচম তৈরি।
পোড়াবাড়ি বাজারে যে চারটি মিষ্টির দোকান রয়েছে তার একটি ষাটোর্ধ্ব দীনেশচন্দ্র গৌড়ের। তার মিষ্টির দোকানের নাম আদি পোড়াবাড়ি মিষ্টান্ন ভান্ডার। তার দোকানের পিছনেই বাড়িতেই মিষ্টির তৈরির কারখানা। এছাড়া টাঙ্গাইল শহরের সিএনজি স্ট্যান্ডেও তার একটি দোকান রয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষদের হাত ধরেই পোড়াবাড়ির আদি চমচম জনপ্রিয়তা পায়।
গত ৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় পোড়াবাড়িতে তার কারখানায় গেলে তাকে দেখা যায়, দুধ থেকে ছানা তৈরি করতে। তিনি জানান, তার নানা বাঙালী গৌড়ের দাদু ছিলেন দশরথ গৌড়। তাদের হাত ধরেই এই অঞ্চলে পোড়াবাড়ির আদি চমচমের জনপ্রিয়তা পায়।
তিনি জানান, পোড়াবাড়ির চমচমের স্বাদ পেতে হলে পোড়াবাড়িতেই আসতে হবে। পোড়াবাড়ির বাইরে থেকে এই মিষ্টি কিনলে পোড়াবাড়ি চমচমের নামটাই পাবেন, স্বাদ পাবেন না। দেশের বিভিন্ন এলাকার দোকানদাররা পোড়াবাড়ি চমচমের মিষ্টির নামটা নিয়ে ব্যবসা করে।
তবে তিনি পোড়াবাড়ির মিষ্টির যে 'অরিজিনাল' স্বাদ আর নেই তা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'দুধের কেজি ৯০ টাকা, চিনি ১০০ টাকা। অন্যান্য খরচ তো রয়েছে। দুইজন কারিগর নিয়ে আমরা নিজেরাই তৈরি করে বিক্রি করি। প্রতিকেজি চমচম বিক্রি করি ২০০ টাকা কেজি। অরিজিনাল স্বাদ নিয়ে আসলে চমচমের কেজি পড়বে ৪৫০ টাকা। আবার দুধের সেই স্বাদ না থাকার কথাও স্বীকার করেন তিনি।'
তার কারখানায় কারিগরের কাজ করেন মোহাম্মদ আবু সাইদ। তিনি জানান, আগে তিনি চমচম তৈরি করে টাঙ্গাইল শহর ও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করতেন। ফেরি করে বিক্রি করায় এখন আর পোষায় না। তাই গত ১৫/২০ বছর ধরে তিনি কারখানায় কারিগরের কাজ করছেন।
গদনচন্দ্র গৌড় নামে পোড়াবাড়ির আরেক কারখানার মালিক জানান, তিনি পোড়াবাড়িতে মিষ্টি তৈরি করলেও বিক্রি করেন না। চাহিদা অনুযায়ী টাঙ্গাইল, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে চমচম তৈরি করে সরবরাহ করেন।
তার দাবি, তিনি মান অক্ষুণ্ণ রেখে চমচম তৈরি করেন। এজন্য তার চমচম পাইকারি বিক্রি হয় ২৫০ টাকা কেজি। দুধ, চিনি ও ময়দা দিয়ে চমচম তৈরির পর তাতে তিনি দুধ জ্বাল দিয়ে তৈরিকৃত মাওয়া ছিটিয়ে দেন। তিনি জানান, ১৫ কেজি দুধ জ্বাল দিয়ে আধা কেজির মতো মাওয়া পাওয়া যায়। পরে মাওয়া গুঁড়া করে চমচমের উপর ছিটিয়ে দিতে হয়। অনেকে মাওয়া না ছিটিয়ে বিস্কিট গুঁড়ো করে ছিটিয়ে দেন।

তবে পোড়াবাড়ির চমচমের জন্য এখন বিখ্যাত টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজার। এলাকাটি মিষ্টি বিক্রির স্থান হিসেবে বিখ্যাত। সেখানে প্রায় অর্ধশতাধিক মিষ্টির দোকান রয়েছে। যেখানে চমচম তৈরি হয়।
পাঁচআনী বাজারের গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডারের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, লোহার বড় বড় সাতটি কড়াইয়ে চলছে মিষ্টি তৈরির কার্যক্রম। দুধ থেকে ছানা কেটে নিয়ে এসে লোহার কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে মিষ্টি। নিখিলপাল নামের এক কারিগর বলেন, তারা টাঙ্গাইলের পাকুল্লা, ছিলিমপুর, লাউহাটী ও পোড়াবাড়ি থেকে দুধ কিনে নিয়ে আসেন। প্রতিদিন ২০ থেকে ৪০ মণ দুধ লাগে। প্রতিদিন মিষ্টি তৈরি হয় ২০ মণের মতো। তিনি ২৫ বছর কারিগর হিসেবে এই কারখানায় কাজ করছেন। পোড়াবাড়ীতে তিনি ১০ বছর কাজ করেছেন।
পাঁচআনী বাজারে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ জয়কালী মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি। প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৩৯ সাল থেকে মিষ্টি তৈরি করে বিক্রি করছে। তাদের কারখানায় ৩০ থেকে ৪০ জন কারিগর রয়েছেন। চর এলাকা থেকে দুধ আসে তাদের কারখানায়। গড়ে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ মণ মিষ্টি তৈরি করে তারা।
এদিকে টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি এবংজয়কালী মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্ত্বাধিকারী স্বপন ঘোষ জানান, সমিতির অধীনে ২৫০টি মিষ্টির দোকান রয়েছে। আর সবমিলিয়ে টাঙ্গাইল জেলায় ১০০০টির মতো মিষ্টির দোকান রয়েছে যেখানে চমচম বিক্রি হয়। তারা ৩০০ টাকা কেজিতে চমচম বিক্রি করেন।