‘সংস্কৃতির রাজধানী’তে নেই বিনোদন কেন্দ্র

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সূর্যমুখী কিন্ডার গার্টেনের প্রথম শ্রেণির ছাত্র ওয়াহেদুল ইলহাম অধীর। বিনোদনের খোরাক হিসেবে তার সঙ্গী স্মার্টফোন আর ল্যাপটপ। স্কুল শেষে বাসায় ফিরেই বসে পড়ে এই দুই ডিভাইস নিয়ে। মাত্র ছয় বছর বয়সী অধীর এরই মধ্যে ডিভাইসগুলো চালনায় বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। বাসার বাইরে গিয়ে খেলাধুলা না করলেও স্মার্টফোনের গেমে মত্ত থাকে সে। এর বাইরে ল্যাপটপের মাধ্যমে ইউটিউবে কার্টুন দেখেও সময় কাটে তার।
অধীর জানায়, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত তাকে স্কুলে থাকতে হয়। এরপর বাসায় ফিরে গোসল করে খাওয়া সেরেই বসে পড়ে ল্যাপটপ নিয়ে। কিছু সময় ইউটিউবে কার্টুন দেখে এরপর আবার বসে স্মার্টফোনে গেম খেলতে। তার কলেজপড়ুয়া এক চাচাতো বোনের কাছ থেকে স্মার্টফোন ও ল্যাপটপ চালনা শিখেছে সে। তবে বাইরে ঘুরতে যেতে অনেক ভালো লাগে তার। কিন্তু শিশুদের জন্য ঘুরে-বেড়ানোর তেমন জায়গা কিংবা শিশু পার্ক ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে না থাকায় বাইরে খুব একটা বের হয়না সে।
সারাক্ষণ বাসার ভেতরে স্মার্টফোন আর লেপটপ নিয়ে পড়ে থাকায় সঠিকভাবে তার মেধা ও মানসিক বিকাশ ঘটছে না বলে মনে করছেন অধীরের বাবা-মা। শহরে শিশুদের জন্য পার্ক কিংবা সুষ্ঠু বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তার এই স্মার্টফোন ও ল্যাপটপের আসক্তিও কাটাতে পারছেন না তারা।
অধীরের বাবা আরশাদুল ইসলাম বলেন, শিশুদের জন্য ঘুরে-বেড়ানোর তেমন জায়গা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে নেই। তাই অধীরকে নিয়ে বাইরে খুব একটা যাওয়া হয়না। তার বয়সী অন্য ছেলে-মেয়েদের শারীরিক গঠন আরও ভালো। কিন্তু বাইরে গিয়ে খেলাধুলা না করায় ওর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছেনা।
অধীরের মা শাফকাত আরা জ্যোতি বলেন, স্মার্টফোন-ল্যাপটপের প্রতি অধীরের নেশা কিছুতেই কাটাতে পারছিনা। খাওয়া-ঘুম ভুলে সারাক্ষণ পড়ে থাকে স্মার্টফোন-ল্যাপটপ নিয়ে। মাঝে-মধ্যে বাইরে ঘুরতে যেতে চায় কিন্তু ভালো কোনো জায়গা না থাকায় নিয়ে যেতে পারি না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মাহফুজা আকতার জানান, শহরের শিশুরা পর্যাপ্ত খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ পাচ্ছে না। তারা এখন স্মার্টফোন-কম্পিউটারে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এতে করে তাদের মেধা ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য খেলাধুলা-বিনোদনে শিশুদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

যদিও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বলা হয়ে থাকে 'সংস্কৃতির রাজধানী'। কারণ দেশের অন্য যে কোনো জেলা শহরের চাইতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক চর্চাও অনেক বেশি। কিন্তু সংস্কৃতির এতো বিকাশের পরও শহরে তেমন কোনো বিনোদন কেন্দ্র নেই। বিশেষ করে পৌরসভা এলাকায় শিশুদের জন্য নেই কোনো শিশু পার্ক। ফলে স্কুল শেষে বাড়িতে বসেই সময় কাটাতে হয় শিশুদের।
জানা গেছে, ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা। সাড়ে ১১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ পৌরসভায় প্রায় দুই লাখ মানুষের বসবাস। কিন্তু পৌর এলাকার শিশুদের জন্য কোনো বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠেনি আজও। বছর বছর বাজেট করেও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ শিশুদের জন্য তৈরি করতে পারেনি কোনো পার্ক। আর শহরের অবকাশ এলাকায় জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে থাকা 'ফারুকী পার্কটি' প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শিশুদের রাইডগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় স্কুল শেষে বাড়িতে বসেই সময় কাটে শিশুদের। তবে প্রতি অর্থবছরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার বাজেটে শিশু পার্ক তৈরির জন্য অর্ধ বরাদ্দ থাকে।
গত ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্ধবছরের প্রতি বাজেটেই শিশু পার্ক নির্মাণের জন্য এক কোটি টাকা করে বরাদ্দ রাখে পৌরসভা। শহরের পুরাতন জেলখানা রোডের পরিত্যক্ত জেলখানা ভবনের ২.৬৩ একর জমিতে শিশু পার্ক করতে চায় পৌরসভা। কিন্তু সেই জায়গায় আজও পার্ক করতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ। অবশ্য পরিত্যক্ত এই ভবনে সদর মডেল থানার ১নং ফাঁড়ির কার্যালয় রয়েছে।
সরকারি এ জায়গাটি পেতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠিও লিখেছে পৌর কর্তৃপক্ষ। যদিও ওই জায়গায় শিশু পার্ক নির্মাণের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ নেই। কারণ নিষ্কণ্টক এক একর জায়গা হলেই কেবল সরকারি খরচে পার্ক তৈরি করে দেওয়া হবে বলে পৌর কর্তৃপক্ষকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
তবে জলখানার জায়গাটি পেলে পৌরসভার রাজস্ব আয়ের খাত থেকে শিশু পার্ক নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজের ব্যয় মেটানো হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য জেলখানার জমির পেছনে পড়ে না থেকে পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে বিকল্প জায়গায় পার্ক নির্মাণে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য বলেন, প্রতিবারই পৌরসভার বাজেটে শিশু পার্ক তৈরির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু শিশু পার্ক আর হয় না। ফলে শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় তাদের সঠিক শারীরিক বিকাশ হচ্ছে না। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে মনস্তাত্বিক বৈকুল্যতা দেখা দিচ্ছে। তাই শিশুদের জন্য সুষ্ঠু বিনোদনের ব্যবস্থা করতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য পৌর মেয়রের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সিভিল সার্জন ডা. শাহ আলম বলেন, শিশুদের সঠিক বিকাশে খেলাধুলা ও বিনোদন খুবই প্রয়োজন। কিন্তু শহরের অনেক স্কুলেই খেলার মাঠ নেই। তাই শিশুরা ঠিকমতো খেলাধুলা করতে পারেনা। আর বাইরেও শিশুদের নিয়ে ঘুরে-বেড়ানোর তেমন জায়গা নেই। এর ফলে বাড়িতে বসে শিশুরা স্মার্টফোন-কম্পিউটারে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর মেয়র নায়ার কবির বলেন, আমরা পুরাতন জেলখানা ভবনের জমিতে শিশু পার্ক করার জন্য জমিটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে চেয়েছি। জেলা পুলিশও ফাঁড়ির জন্য ১৫ শতাংশ জায়গা চেয়েছে। পার্কের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে আমরাও পুলিশ ফাঁড়ির জন্য ১৫ শতাংশ জায়গা পুলিশকে দিয়ে বাকি জায়গাটি পার্কের জন্য দেওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু জমি আমরা এখনও বুঝে পাইনি। সেজন্য শিশু পার্ক নির্মাণ কাজও আটকে আছে।
তিনি আরও বলেন, যদি এই জমি না পাই তাহলে শহরের তিতাসপাড়া এলাকায় পৌরসভার নিজস্ব জমি রয়েছে। বিকল্প হিসেবে সেখানেই পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। আর শিশু পার্কের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ নেই। যদি জায়গা পাই তাহলে পৌরসভার রাজস্ব আয়ের খাত থেকেই পার্কের নির্মাণ ব্যয় মেটানো হবে।