হতাশা নয়, সম্ভাবনাময় বিশ্ব খুঁজি

করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এ থমকে আছে গোটা বিশ্ব। দেশে দেশে চলছে লকডাউন। হোম কোয়ারেন্টিনের নামে তৈরি হচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও জীবিকার অনিশ্চয়তা। এসময়ে প্রতিটি মানুষের উচিত মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করা।
হোম কোয়ারেন্টিনের ফলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সম্মুখীন হতে হচ্ছে বিশাল চ্যালেঞ্জের। কর্মীরা কাজে অংশ নিতে না পারলেও মাস শেষে ঠিকই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিতে হচ্ছে বছরজুড়ে খেটে খাওয়া শ্রমিকদের পারিশ্রমিকের গুরুদায়িত্ব। আর তাই তো আমরা যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি, আমাদের প্রতিটি কর্মীর উচিত এই সঙ্কটময় সময়ে সর্বক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রোডাক্টিভিটি ধরে রাখা বা বাড়ানোর জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কর্মীরা যে যার অবস্থান থেকে যদি ঘুরে না দাঁড়ান, তাহলে মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অথনীতি।
বিশ্বের এই সঙ্কটময় অবস্থায় হোম কোয়ারেন্টিনের অস্পষ্ট সময়সীমা প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের মানসিক অবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। যেমন- রেস্টুরেন্ট মালিকরা জানেন না কবে নাগাদ স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে। পোশাকশিল্প থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বিপরীতে মালিকপক্ষকে হিসাব করতে হচ্ছে লোকসানের পরিমাণ। পোশাকশিল্প ছাড়াও পাট ও চিংড়ি রপ্তানি করেও আমাদের দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়, কিন্তু সেখানেও ব্যবসায়ীদের চোখে-মুখে অনিশ্চয়তার ছাপ।
বিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠান, যেমন- সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চগুলো স্থবির হয়ে আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন হাজার হাজার কর্মী। এই দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে কাজ না করলেও মালিকপক্ষকে গুণতে হবে কর্মীদের পারিশ্রমিক ।
স্বল্প ইনভেস্টমেন্টের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে আমাদের দেশের ই-কমার্স ব্যবসায় নিয়োজিত হাজার হাজার মানুষও বিপাকে পড়েছেন। প্রথমে শখ থেকে অনলাইন বিজনেস শুরু করলেও একটা পর্যায়ে পরিবারের আর্থিক উপার্জনের মূল খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ই-কমার্স বিজনেস। আসছে বাংলা নতুন বছর পহেলা বৈশাখ এবং ঈদকে ঘিরে তাদের বছরজুড়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা আজ পরিণত হয়েছে হতাশায়।
এতক্ষণ বললাম দেশের বাবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং মালিকপক্ষের কথা। এখন ঠিক এর বিপরীত দিকটা দেখা যাক। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কি হোম কোয়ারেন্টিন খানিকটা উপভোগ করছেন? যে সুযোগ কখনোই পাওয়ার কথা ছিল না। পরিবারের সঙ্গে আপন মনে দিনের পর দিন কাটানো, এমনকি 'ওয়ার্ক-লাইফ-ব্যালেন্স' শব্দটি নিয়ে যে বিতর্কের ঝড় চলছে বিশ্বব্যাপী। কেন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিটি কর্মীকে বুঝিয়ে দিচ্ছে না দিন শেষে পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত সময়টুকু। সব বিতর্কের অবসান হলো এই করোনাভাইরাস এবং হোম কোয়ারেন্টিনের মধ্য দিয়ে। এবার প্রমাণ হয়ে গেল কিছু কিছু সময় এই 'জয়'টাকেও বিষাদ লাগে। লকডাউনের ফলে অনিশ্চিত ঝাপসা ভবিষ্যৎ পরিবারের সঙ্গে কাটানো সময়গুলোও উপভোগ্য হয়নি; বরং কর্মীকে অসীম অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে।
আমাদের দেশের খেটে খাওয়া দিনমজুর, রিকশা, সিএনজি ও বাসচালক- এদের দিন কেটে যাচ্ছে হাহাকার করে। এদের তুলনামূলক পরিবারের সদস্য সংখ্যাও অনেক বেশি। দিন শেষে কীভাবে পরিবারের সদস্যদের মুখে তারা খাবার তুলে দিচ্ছেন, তা কে জানে? আমরা অনেকেই এ সময়ে একজন অন্যজনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি। সরকারিভাবেও নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। কিন্তু সেটা কতটুকু?
আমরা যতটুকু সাহায্য করছি, তা হয়তো একটি পরিবারের সর্বোচ্চ দশ থেকে পনের দিনের খাবারের যোগান দিবে। তাহলে বাকি দিনগুলোর খাবারের যোগান আসবে কোথা থেকে? প্রতিষ্ঠানের মালিক, কর্মী, দিনমজুর- সবাই সামনের দিনগুলোর অজানা হতাশায় আবদ্ধ হয়ে না থেকে বিশ্বের সমগ্র মানবজাতিকে খুঁজে বের করতে হবে এই অজানা আপদ থেকে বের হয়ে আসার কৌশল। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে প্রতিটি কর্মীকে, ওনারশিপ নিয়ে কাজ করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে যেতে হবে সাফল্যের চূড়ায়। কর্মীদের উচিত এখন থেকেই পরিকল্পনা করে রাখা, এই সঙ্কটময় অবস্থা কেটে উঠলে কিভাবে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা করে একযোগে কাজ করে নিজের প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে যেতে হবে সর্বোচ্চ অবস্থানে।
আঁধার কেটে গেলেই আসবে আলোকিত দিন, এটাই নিয়ম। তাই এই হোম কোয়ারেন্টিনের সময়গুলোকে অবহেলায় নষ্ট না করে প্রতিটি মানুষেরই উচিত কিছু পার্সোনাল ডেভেলপমেন্টে ব্যয় করা। যার মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়েই উপকৃত হবে। যেমন-
১. ইউটিউব দেখে এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্টের অজানা কৌশলগুলো রপ্ত করে নেওয়া এবং ইংলিশ স্পোকেনের অনলাইন কোর্সগুলো করে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানো।
২. বিভিন্ন ট্রেনিং মডিউল তৈরি করে রাখতে পারেন, যা ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে অথবা বিভিন্ন ট্রেনিং সেশনে কাজে লাগাতে পারবেন।
৩. প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, যার ফলে দক্ষতার বিচারে একজন অন্যজনের থেকে অধিক দক্ষ হতেই পারেন, শুধু কিছুটা নলেজ শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে এই অবসর সময়ে আমাদের দক্ষতা বাড়িয়ে নিতে পারি বহুগুণে।
হতাশার সময়গুলোকে দক্ষতায় পরিণত করতে পারলেই শুধু নিজের দেশ নয়, গোটা বিশ্বকেই আবার গতিময় করে তোলা সম্ভব। এই সমস্যা শুধু একটি প্রতিষ্ঠান বা দেশের নয়, বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক দুর্যোগ। আসুন আমরা সকলে একযোগে সম্ভাবনাময় বিশ্ব খুঁজি।
- লেখক: মানবসম্পদ প্রধান, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড