মারকুটে কালিম পাখি পোষ মানানোর গল্প

কালিম পাখি। ইংরেজি নাম Purple Swamp Hen। জলাভূমির পাখি হলেও বিচরণ জল-ডাঙা উভয় স্থানেই। আর এ পাখির আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, একটু চেষ্টা করলে পোষ মানানো যায়; আর একবার পোষ মেনে গেলে কালিম পাখি কখনোই উড়ে চলে যায় না।
ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায় চাইরা বিল এলাকায় বংশ পরম্পরায় বনের এই পাখিকে পোষ মানিয়ে হাঁস-মুরগীর মতো লালন পালন বিক্রি করছেন অনেকে। হাঁস-মুরগীর সঙ্গেই নির্বিবাদে ঘুরে বেড়ায় ওরা বাড়ির আশপাশে এবং নিয়মিত ডিম থেকে বাচ্চাও ফুটায়। দারুণ সুদৃশ এই পাখি বিত্রিও হয় চড়া দামে।
কালিম পাখি মারকুটে স্বভাবের। দেখতে চকচকে নীলচে বেগুনি। আলতা রঙের কপাল ও মাথা। আর আলতা রঙের পা ও লম্বাটে আঙুল। এদের মূল খাদ্য উদ্ভিদ-গুল্মের কচি পাতা, ব্যাঙের পোনা বা ছোট মাছ। মাথায় আলতা রঙের রক্ষা কবচের জন্য অনেকেই মজা করে এই পাখিকে তুলনা করে রোমান যোদ্ধাদের সঙ্গে।
কালিম পাখি খুবই দুঃসাহসী ও লড়াকু। প্রচলিত আছে, শিকারিদের ছোড়া গুলি এক পায়ে লাগলেও উড়ে পালাতে পারে ওরা। এই চমৎকার পাখিকে পোষ মানিয়ে বংশ পরম্পরায় লালন পালন করছে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কদমতলি গ্রামের চাইরা বিল এলাকারার ১০-১২ টি পরিবার।

এক সময় ময়মনসিংহের পাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেঁষা শেরপুরের নালিতাবাড়ী পাহাড়ি এলাকায় এই পাখির অবাধ বিচরণ ছিল। কিন্তু এখন আর দেখা মিলে না। অনেকের ধারণা, ওরা অতিথি পাখি। তবে কালিম মূলত জলাভূমির পাখি, আর ওরা আমাদের দেশীয় জলচর পাখি।
অবাধ শিকার, চারণ ভূমির দূষণে ওরা এখন বেশ কোণঠাসা। অবশ্য হাওরাঞ্চলে কিছু কালিমের দেখা মেলে ।
ময়মনসিংহে যারা এই পাখি লালনপালন করছেন তাদেরই একজন মনসুর আলী। তিনি জানান, তার দাদা ও বাবা এই পাখি পুষতেন। বাড়ির পাশে চাইরা বিল নামে পরিচিত বিলে এই পাখির আগমন বহুকাল ধরেই। সেখান থেকে ধরে এনে পোষ মানাতেন তারা। এরপর লালনপালন করা হতো।
৬৫ বছর বয়সের মনসুর আলী আরও বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকে এসব দেখছেন। বাবার কাছে শিখেছেন, কীভাবে পোষ মানাতে হয় বদমেজাজি বলে পরিচিত এই পাখিকে। তিনি বলেন, 'পোষ মানার পর বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় কালিম পাখির সঙ্গে। তখন যেখানেই থাকুক না কেন, ডাক দিলেই ওরা উড়ে আসে।'
পুরো গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এই পাখি লালনপালন করেন মূলত নারীরা।
স্থানীয় গৃহিণী রুমেলা খাতুন বলেন, হাঁস-মুরগীকে যে খাবার দেওয়া হয়, একই খাবার কালিম পাখিও খায়। সকালে বের হয়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আবার সন্ধ্যায় বাড়ি চলে আসে এই পাখি।
প্রজনন মৌসুমে দুই পুরুষ পাখির মধ্যে যখন লড়াই বাঁধে, তখন কপালে কপালে তাদের টক্কর লাগার শব্দ শোনা যায় বহু দূর থেকেও। বর্ষাকালই কালিম পাখির প্রধান প্রজনন ঋতু। 'জোড়' না মিললে বা ভালো সঙ্গী না পেলে এরা ডিম পাড়ে না। প্রচলিত আছে, স্ত্রী কালিমের মন জয় করে তবেই পুরুষ কালিমকে অন্তরঙ্গ হতে হয়। আর স্ত্রী কালিমের মন জয় করার জন্য শারীরিক কসরত দেখাতে হয় পুরুষ কালিমকে।
গ্রামের অপর গৃহিণী হাসিনা আক্তার বলেন, কালিম পাখি বছরে তিনবার ডিম দেয়। একসঙ্গে ৮ থেকে ১২টি ডিম দেয় ওরা।
'এই পাখি আমরা যারা পালি, তারা ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রিও করি। বয়স বিবেচনায় একেকটি পাখি ২ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। একেবারে ছোট বাচ্চা পাখি সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা বিক্রি হয়,' জানান হাসিনা আক্তার। 'এসব পাখি মানুষ শখে কেনে, বাড়িতে বা রিসোর্টে পালার জন্য।'

স্থানীয় গৃহিণী কবিতা আক্তার বলেন, 'এই পাখি লালনপালন করে গ্রামের মেয়েরাই। এতে আমাদের বাড়তি আয় হয়। আমরা নিয়মিত যত্ন করি, খাবার দেই। এই পাখি পোষা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।'
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জলাভূমি থেকে পাখিটি আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। বন্য প্রাণী আইনে পাখি ধরা-মারা-বিক্রি ও পোষা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। বিষয়টি তাদের নজরে আনা হলে পাখি পালনকারী রুমেলা খাতুন বলেন, 'এটি অপরাধ কি না, জানি না; তবে বংশগত ধারাবাহিকতায় এই কাজ করছি আমরা। আমাদের কাছে হাঁস, মুরগীর মতোই এই কালিম পাখি। বাচ্চা ফোটানোর পর আমরা বাচ্চাদের বড় করি, বিক্রি করি।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে পোষ মানিয়ে যাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে পাখির সম্পর্ক ভিন্ন মাত্রার। তাই সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, 'যারা বনের পাখি লালনপালন করছে, অনেকটা পারিবারিক ঐতিহ্যকে ভর করে তাদের সচেতন করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, বন্য প্রাণির নিরাপত্তা যেন মানুষের কারণে হুমকিতে না পড়ে। প্রয়োজনে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।'