প্রযুক্তির ছোঁয়াবিহীন, সম্পূর্ণ হাতে তৈরি ভিন্ন মাত্রার কাঠের ঘর

মাত্র সাড়ে ৪ লক্ষ টাকায় ৩ রুমের বাড়ি, তাও আবার কাঠের, ভেবেছেন কখনো? হ্যাঁ, এও সম্ভব।
দোতলার বারান্দায় বসে সকালে পাখির গুনগুন গান শুনতে শুনতে এক কাপ চা যেন অমৃত সুধা! ভাবলেও খুব একটা ভুল হবে না। দোতলা ঘরগুলো ইউরোপ-আমেরিকান বিলাসী ডুপ্লেক্স বাসার তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়।
ঘরের জানালা থেকে জেলের মাছ ধরা ও বিলের পানিতে আকাশের প্রতিবিম্ব বিমুগ্ধকর, এ যেন স্বপ্নের আবাস!
এই ঘর তৈরিতে লাগে না কোনো ইঞ্জিনিয়ার; স্থানীয় ঘরের ব্যবসায়ীরা বংশ পরম্পরায় এই ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন প্রায় চার যুগেরও বেশিকাল ধরে।

বিভিন্ন কাঠ, টিনের মান ও ঘরের পরিমাপ অনুযায়ী নিপুণ হাতের কারুকাজ খচিত পরম যত্নে বানানো কাঠের জানালা, দরজা, মেঝে ও ছাদ বিশিষ্ট একেকটি ঘরের মূল্য পড়বে দেড় থেকে বিশ লাখ টাকা।
মাওয়া ঘাট থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার পুবে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলা। দেশের কিছু কিছু জায়গায় এমন ঘর নির্মাণ হলেও লৌহজংয়ের কারিগররা সুনাম কুড়িয়ে অক্ষুন্ন রেখে চলেছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন বাড়ি নজর কাড়লেও এর সিংহভাগ তৈরি হয় লৌহজংয়ে। এই ঘরগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য- জানালা, দরজা, দেয়াল কাঠামো, মেঝে কিংবা ছাদ- ঘরের প্রত্যেকটি অংশ আসবাবপত্রের মতো আলাদা আলাদা খুলে দেশের যেকোনো প্রান্তে বহন করে নেওয়া যায় খুব সহজে।
'এই ঘরগুলো আমরা এখানে বানিয়ে বিক্রি করি। ক্রেতা তার স্থান মতো নিয়ে যান; প্রয়োজনে আমাদের মিস্ত্রিরা গিয়ে সেট করে দিয়ে আসেন,' বলেন ঘর ব্যবসায়ী আব্দুর রব ব্যাপ্যারী।

লৌহজংয়ে শুধু যে স্থানীয় কারিগররা কাজ করেন, তা নয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কারিগররা এখানে ভিড় করেন, স্থানীয় প্রবীণ কারিগরের কাছ থেকে মানসই ঘর তৈরির শিক্ষা নেওয়ার জন্য।
'সাত বছর আগে গোপালগঞ্জ থেকে এখানে আসি। বিভিন্ন প্রবীণ মিস্ত্রির কাছ থেকে আমরা কাজ শিখছি,' বলেন কাঠের ঘরের মিস্ত্রি ভবতোষ দাস।
এই ঘর তৈরির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা। ঘর তৈরির যাবতীয় কাঁচামাল, যেমন কাঠ ব্যবসায়ী, কাঠ মিস্ত্রি, টিন ও স্টিল ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ী ও ঘর নির্মাণ শ্রমিক।

'এইসব ঘর নির্মাণে কাঠের তুলনায় চল্লিশ ভাগ টিন লাগে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের টিনের ডিলাররা সরাসরি আমাদের দোকানে টিন দিয়ে যান। অন্যদিকে, নন-ব্র্যান্ডেড টিন ঢাকার কেরাণীগঞ্জ, নয়াবাজার থেকে আমরা নিয়ে আসি,' বলেন টিন ব্যবসায়ী শামীম ব্যাপারী।
বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারিতে কাঠের ঘর ব্যবসায় নাকাল অবস্থা। এমনিতেই এ পরিস্থিতিতে মানুষের কাছে টাকা কম। এরই মাঝে গত তিন সপ্তাহের ভারি বর্ষণে তলিয়ে গেছে লৌহজংয়ে বয়ে চলা পদ্মা নদীর বুকে বিশ বছর আগে জেগে ওঠা চর।

এর ফলে যারা নিঃস্ব ছিলেন, তারা আরও নিঃস্ব হয়ে গেছেন। পুরানো ঘর ভেঙে কোনোভাবে জীবন বাঁচিয়ে নদীর এপারে, লৌহজংয়ের বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ী ঘর বাঁধছেন অনেকেই।
এর প্রভাব পড়েছে ঘর ব্যবসায়ীদের ওপরও। তারা বলছেন, লকডাউনে বিগত তিন মাস ধরে তারা দোকান খুলতে পারেননি। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রায় সবারই মন্দা অবস্থা থাকায় কেউ বাজারে আসছেন না; এর মাঝে বন্যা পরিস্থিতি যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

নিত্য নতুন হাজারও ঝড় ঝাপটা ও প্রতিকূলতার মাঝে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকেন আমাদের নদী ও সাগর উপকূলবর্তী মানুষেরা। তেমনি বাঙালির এই নিপুণ সৌন্দর্যে ঘেরা কাঠের ঘর তৈরি শিল্প বেঁচে থাকুক যুগ-যুগান্তর।