নিলামে দুনিয়ার সবচেয়ে দামি ১০ ভাস্কর্য

মানবসভ্যতার প্রাচীন প্রস্তরযুগ থেকেই শিল্পকলার প্রতি মানুষের ছিল অসীম আগ্রহ। সেই সময়ের গুহাচিত্র এবং পাথরের তৈরি নানা শিল্পকর্ম প্রমাণ দেয়, মানুষ শুরু থেকেই ছিল সৃষ্টিশীল ও রুচিশীল।
তার পরে হাজার বছর ধরে মানুষ চাইছে এসব শিল্পকর্ম নিজের সংগ্রহে রাখতে। আর সেই সুযোগ নিয়েই গড়ে উঠেছে ক্রিস্টি'স এবং সোথবি'সের মতো বড় বড় নিলাম প্রতিষ্ঠান; ক্রেতাদের সামনে নিয়ে আসছে শ্বাসরুদ্ধকর নিলামযুদ্ধ। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই শৌখিন ও রুচিশীল মানুষ বেছে নেয় নিজের সেরা সংগ্রহ।
বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পবাজারেও অনেক উত্থান পতন হয়েছে। কখনো কখনো এক রাতের মধ্যেই রেকর্ড দামে শিল্পকর্ম বিক্রি হয়েছে। যেমন, ২০১৭ সালে নিলাম প্রতিষ্ঠান ক্রিস্টি'স যীশুখ্রিস্টকে নিয়ে করা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির পেইন্টিং 'সালভাদর মানডি' বিক্রি করে রেকর্ড ৪৫০.৩ মিলিয়ন ডলারে!
অন্যদিকে, যখন ভাস্কর্যকলা খুব বেশি পরিচিতিতে পৌঁছায়নি, তখন ১১টি ভাস্কর্য মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রির ঘটনাও ঘটেছে।
আজ আমরা জানাব নিলামে বিক্রি হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে দামি ১০টি ভাস্কর্যের কথা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কিনে নিয়েছেন এসব ভাস্কর্য এবং অনেক সময় অনেকে গোপন রেখেছেন নিজের নাম-ঠিকানা।

'এল'অম অ ডুয়িট' ('L'Homme au doigt')
(১৯৪৭), আলবার্তো গিয়াচোমেত্তি
মূল্য: ১৪১.৩ মিলিয়ন ডলার
বিক্রির স্থান ও সময়: ক্রিস্টি'স নিউইয়র্ক, ২০১৫
ক্রেতা: স্টিভেন এ. কোহেন
ছয় ফুট লম্বা,ব্রোঞ্জের তৈরি এই ভাস্কর্যে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি দূরে আঙুল লক্ষ্য করে দাঁড়িয়ে আছেন। শিল্পকর্মটি ১৯৭০ সাল থেকে জনচক্ষুর আড়ালে রয়েছে এবং নিজের মূল্য বাড়িয়ে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে মানুষের বিপর্যস্ত মনের অবস্থা বুঝাতে সুইস শিল্পী আলবার্তো গিয়াচোমেত্তি এই ভাস্কর্য বানান। গিয়াচোমেত্তিই একমাত্র ভাস্কর যার শিল্পকর্ম ১০০ মিলিয়নের বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।
দার্শনিক জ্যা পল সাঁর্ত্রে এই ভাস্কর্য নিয়ে মন্তব্য করেন, 'প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এই অবয়ব যেন বুশেনওয়াল্ডের মাংসহীন কংকাল শহীদদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকার। কিন্তু পরক্ষণেই এক নতুন উপলব্ধি আসবে, এটি আসলে যেন স্বর্গের দিকে এক নব উত্থান নির্দেশ করছে।'

'এল'অম ক্যুই মার্শে ই' ('L'Homme qui marche I')
(১৯৬০), আলবার্তো গিয়াচোমেত্তি
মূল্য: ১০৪ মিলিয়ন ডলার
ক্রেতা: লিলি সাফরা
তালিকার দ্বিতীয় স্থানেও রয়েছে একই সুইস শিল্পীর আরেকটি ভাস্কর্য। সোথবি'স লন্ডন এটি নিলামে বিক্রি করে ২০১০ সালে। কিনে নেন বিলিওনিয়ার সমাজসেবিকা লিলি সাফরা।
গিয়াচোমেত্তির এই ভাস্কর্যই ছিল প্রথম ভাস্কর্য যা প্রথম সোথবি'স এ ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি দামে বিক্রি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে এমন একটি অস্থির মানবাত্মার পরিচয়, যে সর্বদা সংগ্রাম করে যাচ্ছে। কখনো শান্তিতে থাকতে পারছে না। এর এবড়োখেবড়ো ভূতল বিভিন্ন আলোতে বিভিন্ন রকমভাবে জ্বলজ্বল করে যেন বাস্তবতার অস্থায়ী রূপকে দেখিয়ে দিচ্ছে।

'চ্যারিয়ট' (Chariot)
(১৯৫০) , আলবার্তো গিয়াচোমেত্তি
তালিকার তৃতীয় দামী ভাস্কর্যটিও নিজের ঘরে আনতে কার্পণ্য করেননি ধনকুবের স্টিভেন এ. কোহেন । ২০১৪ সালে ১০১ মিলিয়ন ডলারে তিনি এটি কেনেন সোথবি'স নিউইয়র্ক থেকে এবং বলাই বাহুল্য, এটিও আলবার্তো গিয়াচোমেত্তিরই।
যে রাতে ভাস্কর্যটি বিক্রি হয়, সেটি ছিল তখনো পর্যন্ত কোনো ভাস্কর্যের জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দাম। রথের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীর পরাবাস্তব চিত্র এটি, যে আসলে নড়াচড়া করতে পারছে না। গিয়াচোমেত্তি এই ভাস্কর্যের ছয়টি ভার্সন তৈরি করেন, যার বাকিগুলো নিউইয়র্ক, জুরিখ ইত্যাদি জায়গার জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

'র্যাবিট' ('Rabbit')
(১৯৮৬), জেফ কুনস
এই ভাস্কর্যের মালিকও হয়েছেন স্টভেন এ. কোহেন; কিন্তু সে রাতে তার হয়ে নিলামে ছিলেন রবার্ট মানুচিন, তিনি এটি কিনেছেন ৯১ মিলিয়ন ডলারে।
শিল্পী জেফ কুনকে নিয়ে বহু বিতর্ক থাকায় কেউ কেউ এই চিত্রকর্মকে ভাবেন স্রেফ নীরস-প্রাণহীন কিছু; আবার কেউ কেউ বলেছেন, এটি ভোগবাদী সমাজ-সংস্কৃতিকে ব্যঙ্গ করা এক চিত্র। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, জেফ কুন পৃথিবীকে দেখার ভঙ্গি বদলে দিতে চেয়েছিলেন।

'লা জ্য ফিয়ে সফিস্টিক'(Portrait de Nancy Cunard)
(১৯২৮-৩২), কনস্টানটাইন ব্রানকুসি
২০১৮ সালে ৭১.২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হওয়া এই ভাস্কর্য ১৯৫৫ সাল থেকেই শুধু এর বিক্রেতার কাছে ছিল; অর্থাৎ যিনি এটি কিনেছেন, তিনিই দ্বিতীয় ব্যক্তি- যার কাছে ভাস্কর্যের হাতবদল হয়। ব্রানকুসির এই ভাস্কর্য আসলে একজনের আদলে করা, তিনি ব্রিটিশ বংশের কিউনার্ড- যিনি কবি লুইস আরাগন ও এজরা পাউন্ডের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং একইসঙ্গে দুজনের সঙ্গেই প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন।
শিল্পীর মতে, তিনি এই কাজের মধ্য দিয়ে একটি আধ্যাত্মিক প্রভাব খোঁজার চেষ্টা করেছেন।

'তেতে' ('Tête')
(১৯১১-১২), অ্যামেদিও মোদিগলিয়ানি
মোদিগলিয়ানি একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাথরের ভাস্কর্য বা মূলত পাথরের মাথাসদৃশ ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। 'তেতে' তারই একটি। তার বাকি ভাস্কর্যগুলোও জগদ্বিখ্যাত এবং বিশ্বের নানা গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
ওয়েলশ আর্টিস্ট অগাস্টাস জন এই ভাস্কর্য সরাসরি শিল্পীর কাছ থেকে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, 'এই পাথরের মাথাটি আমার ওপর অদ্ভুত প্রভাব ফেলেছিল। কিছুদিন আমি এক ধরনের হ্যালুসিনেশনে ভুগতাম, রাস্তায় চলমান যে কাউকে দেখলেই মনে হতো এই ব্যক্তিই হয়তো এই মাথা বানানোর মডেল ছিল। মোদি কি বাস্তবতার এক নতুন গোপন দ্বার খুলে দিতে চেয়েছিলেন?'
মোদিগলিয়ানির এই ভাস্কর্য বিক্রি হয়েছে ৭০.৭ মিলিয়ন ডলারে। সোথবি'সের তথ্যানুযায়ী, শিল্পী এতটাই গরিব ছিলেন, তাকে এই ভাস্কর্য তৈরির পাথর সংগ্রহ করতে হয়েছিল প্যারিসিয়ান কনস্ট্রাকশন সাইট থেকে।

বেলুন ডগ ('Balloon Dog (Orange)'
(১৯৯৪-২০০০), জেফ কুনস
মূল্য: ৫৮.৪ মিলিয়ন
দশ ফুট উঁচু এবং এক টন ওজনের এই ভাস্কর্য পাঁচ টুকরোর একটি সিরিজের অংশ, শুধু এর রঙের ভিন্নতা বাদে।
এটির মালিক ছিলেন একজনই- সংগ্রাহক ও ম্যাগাজিন প্রকাশক পিটার ব্রান্ট। পিটার এটি কিনেছিলেন লন্ডন গ্যালারি থেকে।
জেফ কুন তার এই ভাস্কর্য প্রসঙ্গে বলেন, 'এটি একটি আশাবাদী শিল্পকর্ম, এক রকম বেলুন- যা হয়তো জন্মদিনের পার্টিতে আপনি দেখে থাকবেন। কিন্তু এর ভেতরে রয়েছে অন্য এক জিনিস, হয়তোবা এর সেক্সুয়ালিটি।'

লা মিউজ এনডর্মি ('La muse endormie')
(১৯১৩), কনস্টানটাইন ব্রানকুসি
ব্রানকুসির এই একই জাতীয় শিল্প 'স্লিপিং মিউজেস' শিকাগো ও প্যারিসের জাদুঘরে রয়েছে। এর মধ্যে ১৯১৩ সালে নিউইয়র্কে বিখ্যাত আর্মোরি শোতে একটি প্রদর্শিত হয় এবং সেসময় সংবাদপত্রে সবচেয়ে বেশি আসে ব্রানকুসির নাম।
৫৭.৪ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হওয়া ব্রানকুসির এই শিল্পকর্ম নিয়ে আর্ট হিস্টোরিয়ান ক্যারোলা গিডিয়ন-ওয়েলকার বলেন, "'লা মিউজ এনডর্মি' ব্রানকুসির শিল্পসম্ভারে একটি বড় রকমের বিরতি ছিল। এটি দেখে বোঝা যাবে, তার কাজের মনস্তাত্ত্বিক উদগম এখানে এসে একেবারে বদলে গেছে। এই ভাস্কর্য দেখে মনে হবে যেন কেউ খুব শান্তিতে চোখ বুজে আছে, যেন বুদ্ধের হাসির মতো স্নিগ্ধ একটি ব্যাপার।"

দ্য গিনল লায়নেস (The Guennol Lioness)
সিরকা, (৩০০০-২৮০০ খ্রিস্টপূর্ব)
আমাদের তালিকায় সবচেয়ে পুরনো যে ভাস্কর্য রয়েছে, সেটি এই তিন ইঞ্চি লম্বা লাইমস্টোন ভাস্কর্য, যা গিনল লায়নেস নামে পরিচিত। ১৮ মিলিয়নে বিক্রি হবে ধারণা করা হলেও এর দাম এসেছিল ৫৭.২ মিলিয়ন ডলার।
ছোট এই শিল্পকর্ম বেশ অদ্বিতীয়। এর পুরো ধড় ডানে ঘুরানো এবং পা ও মাথা সামনের দিকে ঘুরানো। এর শক্তিশালী পেশীতন্ত্র ও অজানা এক উৎপত্তি এটিকে অদ্ভুত ও অনন্য এক শিল্পে পরিণত করেছে।

গ্রান্দে তেতে মিনচে ('Grande tête mince')
(১৯৫৫), আলবার্তো গিয়াচোমেত্তি
দুজন মালিকের কাছ থেকে হাতবদল হয়ে তারপরে এই ভাস্কর্য ক্রেতার কাছে পৌঁছায় এবং ২০১০ সালে ৫৩.৩ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
বেনামি ও বিমূর্ত ভাস্কর্য ছাড়া গিয়াচোমেত্তি সত্যিকার মানুষের আদল খুব কমই বানিয়েছেন। এর মধ্যে আছেন তার ভাই ডিয়েগ, স্ত্রী অ্যানেট এবং আর দুয়েকজন কাছের মানুষ। তাই তার এই শিল্পকর্মকে ধরা হয় একটি আবেগীয় ব্যাপার হিসেবে।
শিল্পী এর প্রসঙ্গে বলেন, 'আমি নিজে কোনোদিন মস্তিষ্কের সকল শক্তি একটি পোর্ট্রেট বানানোর পিছনে দিতে সফল হতাম না।'
- সিএনএন থেকে অনুবাদ: খুশনূর বাশার জয়া