চাষ ছাড়াই সরিষার আবাদ, সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচন

''ষোল চাষে মুলা, তার অর্ধেক তুলা, তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান।'' প্রচলিত এই খনার বচনের সঙ্গে নতুন যুক্ত হলো সরিষার নাম। চলতি বছর মাগুরায় জমিতে কোনো চাষ ছাড়াই আবাদ হয়েছে বিনা সরিষা-১০। স্বল্প জীবনকালীন ও উচ্চ ফলনশীল এই সরিষার আবাদে কৃষরা একটি বাড়তি ফসল ঘরে তুলে অধিক লাভবান হচ্ছেন।
এ ছাড়া বর্তমানে দেশে ১৪ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। এই সরিষা চাষ করার মাধ্যমে দেশের বাৎসরিক ভোজ্য তেলের ঘাটতি আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে পূরণ করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) মাগুরা উপকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুশান চৌহান বলেন, ''মাগুরার অধিকাংশ জমি আমন ধান কাটার পর বোরো আবাদের আগে দুই মাসের বেশি সময় পড়ে থাকে। আর এই সময়ের মধ্যে একটি বাড়তি ফসল উৎপাদনের জন্য বিনা উদ্ভাবন করেছে স্বল্প জীবনকাল ও উচ্চ ফলশীল সরিষার একটি অসাধারণ জাত। বিনা-১০ নামে এই সরিষার জাতটি চাষ করতে জমিতে কোনো চাষ দিতে হয় না। ধান কাটার পর শূন্য চাষে জমিতে শুধু বীজ ও সার ছিটিয়ে দিলে চলে। পরবর্তী সময়ে আর কোনো সেচ বা সারের প্রয়োজন হয় না। বীজ বপনের মাত্র ৮০ থেকে ৮৫ দিনে মধ্যে এ সরিষা কৃষকের ঘরে ওঠে।
প্রতি হেক্টরে এ সরিষার ফলন কমপক্ষে ১২০০ কেজি পর্যন্ত হয় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, প্রচলিত সাধারণ জাতের চেয়ে এই সরিষার ফলন প্রায় দ্বিগুণ। এ ছাড়া স্বল্প সময়ে বিনা সরিষা-১০ চাষ করে কৃষকরা পরবর্তী সময়ে সহজেই বোরো ধান চাষ করতে পারেন। ফলে একই জমিতে একটি বাড়তি ফসল ফলিয়ে কৃষকরা অধিক লাভবান হতে পারছেন।
সুশান চৌহান বলেন, ''মাগুরা সদরের মঘি ইউনিয়নে আমন ধান কাটার পর চলতি মৌসুমে ২০ একর জমিতে বিনা সারিষা-১০ এর আবাদ হয়েছে। সকল কৃষকের ক্ষেতেই নতুন এ জাতের সরিষার বাম্পার ফলন হয়েছে।''
বিনা মাগুরা উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শম্পা রানী ঘোষ বলেন, ২০১৪ সালে বিনা সরিষা-১০ জাতটি উদ্ভাবন করে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। কিন্তু তখন এ জাতটি সাধারণ পদ্ধতিতে আবাদ করা হতো। কিন্তু চলতি বছর থেকে চাষ ছাড়াই সরিষাটির আবাদ শুরু হয়েছে।
মঘি এলাকার কৃষক ওমর আলী বলেন, আগে আমন ধান ঘরে তোলার পর বোরো আবাদের আগে দুই মাসেরও বেশি সময় আমাদের জমি পড়ে থাকতো। কিন্তু এ বছর পরমানু কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের পরামর্শ ও সহায়তায় আমন ধান কাটার পর-পরই কোনো চাষ ছাড়াই জমিতে বিনা সরিষা-১০ এর বীজ ছিটিয়ে দিই। ২০ থেকে ২৫ দিন পর জমিতে মাত্র একবার সার প্রয়োগ করি। পরে কোনো সেচ, সার ছাড়াই বিনা সরিষা ১০-এর বাম্পার ফলন হয়। প্রতিটি সরিষা গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত ফল ধরে।

আবদুর রাজ্জাক নামে ওই এলাকার আরেক কৃষক বলেন, সাধারণ সরিষার চেয়ে এ সরিষায় প্রায় দুইগুণ বেশি ফলন হয়েছে। সরিষার বীজ বিনামূল্যে সরবরাহ করেছে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। সারও দিয়েছে তারা। বীজ বপন ও শষ্য কর্তন করে বাড়িতে নিতে শ্রমিক খরচ ছাড়া আর কোথাও টাকা খরচ হয়নি। প্রায় বিনা খরচেই চাষ করেছি। উৎপাদনও দ্বিগুণ।
মাগুরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বলেন, ''বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট মাগুরা উপকেন্দ্রের সহায়তায় তারা বিনা সরিষা-১০ সম্প্রসারণে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। জমিতে কোনো চাষ ছাড়াই স্বল্প সময়ে এ জাতটির ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আগামীতে জেলায় আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এ জাতের সরিষা চাষ হবে। যা দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটাতে ভুমিকা রাখবে।''
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বীরেশ কুমার গোস্বামী বলেন, 'বাংলাদেশে বার্ষিক ভোজ্য তেলের চাহিদা ১৬ লাখ টন। সেখানে দেশে উৎপাদন হয় মাত্র দুই লাখ টন। বাকি ১৪ লাখ টন তেল বিদেশ থেকে আমদানি করতে ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। তার পরেও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ভোজ্য তেলের মধ্যে সর্বোচ্চ সয়াবিনের পরিমাণ রয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। বাকি ৭০ ভাগই ক্ষতিকারক কেমিক্যাল। যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে উচ্চ ফলনশীল বিনা-১০ জাতের সরিষার আবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে, আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে নিরাপদ ভোজ্য তেলের চাহিদা পুরণ করা সম্ভব হবে।