চামচঠুঁটো বাটানের অব্যাখ্যাত কাহিনী

এক শীতের সকালে, প্রথম আমি ওদের সোনাদিয়ার বালুময় সৈকতে দেখলাম, এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। ওদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই সদা চঞ্চল ভঙ্গিতে নিরন্তর ছোটাছুটি করা, সময়ে সময়ে চামচের মতো দেখতে মুখখানা বালিতে গুঁজে দেওয়া। আমি অসীম ধৈর্য্য নিয়ে ওদের গুনলাম, মোট ২২টি! এটা আমার জীবনে দেখা অন্যতম দুর্লভ এক মুহূর্ত। আর হবেই বা না কেন! কারণ, বলা হয়ে থাকে ওরা এখন মাত্র ৪০০ জোড়া টিকে আছে সারা পৃথিবীতে, আর আমি সেই ৪০০ জোড়ার পাঁচ ভাগকেই কিনা এখন ঠিক আমার চোখের সামনে মহা আনন্দে লাফিয়ে বেড়াতে দেখছি। সেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে এসেছে ওরা।
কিছুক্ষণ পর জোয়ারের পানি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করল, দ্রুত বাড়তে শুরু করল পানি। বাইন আর হারগোজা গাছগুলো ধীরে ধীরে পানির তলায় হারিয়ে গেল। আমাদের তড়িঘড়ি স্পিডবোটে ফিরতে হবে, আর থাকার উপায় নেই।
দারুণ এক খোশমেজাজে ফিরে এলাম। আমাদের তরুণ পক্ষীবিদ সায়েম ইউ চৌধুরী উত্তেজনায় রীতিমতো ফুটছে, কারণ তার সংরক্ষণ কার্যক্রম এতোদিনে ফলপ্রসু হয়েছে বলা যায়, শেষ পাখিকুলের বিলুপ্তি ঠেকানো গেছে।
তার কাজের ক্ষেত্র বিশাল—সাইবেরিয়ার চুকটকা থেকে চীন-মায়ানমার হয়ে শেষ এই সোনাদিয়ায়—এখানেই ছোট খুদে রহস্যময় পাখিটি বছরান্তে তার পরিযায়ী উড়াল সমাপ্ত করে।
তবে টিকে থাকার জন্য তাকে একেক জায়গায় এক এক রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়।
সাইবেরিয়ায় ওদের প্রজনন, ওখানেই ছানাপোনার বেড়ে ওঠাও। চারটা ডিম যদি হয়, সেখান থেকে দিন শেষে হয়তো একটি পাখিই হয়েই উড়াল দিতে পারে।
কাজেই উদ্দেশ্য ছিল ডিম সংগ্রহ, ও সেই ডিম থেকে ঘরের ভেতরেই বাচ্চা উৎপাদন করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া। যার ফলশ্রুতিতে এদের সংখ্যা ভালোই বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উড়ে চলে যাওয়ার পর তারা যে আবার, তাদের আগের জায়গায় ফিরে আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

চীন এবং মায়ানমারে এদের কোনো খাবার না দিয়ে উল্টো শিকার করা হত। বন্দুক আর জালের সাহায্যে শিকারীরা দীর্ঘ পায়ের সব জলচর পাখিকেও শিকার লক্ষ করত, এতে প্রায় বিলুপ্ত স্পুন-বিল্ড স্যান্ডপাইপার বা চামচঠুঁটো বাটানও একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতই। তাই চেষ্টাটাই ছিল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিলে কাজ করা এবং তাদেরকে বোঝানো যে এই বিপদজনক চর্চাটি তাদের পরিত্যাগ করতে হবে। তাদের বহুদিনের এই অভ্যাস ছাড়াতে যথেষ্টই বেগ পেতে হয়েছে।
এখন, এতোদিনে পরে এসে মনে হচ্ছে সাইবেরিয়া থেকে গাংশালিক নিরাপদ পথে এসে আবার নির্বিঘ্নেই ফিরে যেতে পারছে।
তাই ওই শীতের সকালে, সায়েমের তৃপ্ত বোধ করারই কথা। শত হলেও, এই রহস্যময় পাখিটি বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন পাঁচটি প্রজাতির একটি। কাজেই এরকম মুহূর্তে জীবন ও কাজ অর্থপূর্ণ হয়ে ধরা দেওয়ারই কথা। পাঁচ বছর আগেও সায়েম এবং তার পক্ষীবিদ বন্ধুরা এতেটা নিশ্চিত ছিল না। বরং তারা খানিকটা হত-বিহ্ববলই ছিল। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করার পর, আচমকা যেন আঁধার ঘনাচ্ছে। কিছু পাখি প্রজনন ক্ষেত্রে ফিরে যাচ্ছে ঠিক তেমনি শীতকালীন আবাসে ফিরেও আসছে। কিন্তু কোথাও একটা সমস্যা রয়েই গেছে। এ কথা জানিয়েছে স্পুন-বিল্ড স্যান্ডপাইপার টাস্ক ফোর্স নিউজ বুলেটিন।

'প্রজনন ক্ষেত্র এবং অন্য উড়ালপথের খবর ভালো নয়। আমাদের গত বিশ বছর ধরে সব সংরক্ষণ চেষ্টা এবং আবাসগুলোর সব রকম সুরক্ষা দেওয়া সত্বেও, মনে হচ্ছে আমরা বড়ো কোনো একটা বিষয় ধরতে ব্যর্থ হয়েছি, যার কারণে এখনও এই পাখির সংখ্যা কমতির দিকেই।'
মিসিং লিঙ্ক হতে পারে রাশিয়া, যেখানে এখনও শিকার অব্যাহত আছে। ওখানকার অবাধে ছোড়া শিকারীর গুলি প্রায় বিপন্ন স্পুন-বিল্ড স্যান্ডপাইপারকে কম বিপন্ন প্রজাতি থেকে কোনো রকম ফারাক করে না।
আর, অন্য কারণ হতে পারে জলবায়ুর পরিবর্তন। উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে পাখি হয়তো রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। অথবা বিশ্রামস্থলের খোঁজে হয়তো ওদের আরও বেশি পথ উড়তে হচ্ছে, এতেও প্রাণরস ফুরিয়ে গিয়ে হয়তো মারা পড়ছে পাখিগুলো। কিংবা এর পেছনে অন্য দূর্জ্ঞেয় কোনো কারণও থাকতে পারে।
কারণ যাইহোক, এই বিস্ময়কর পাখিটি হয়তো আরেকটি প্রজাতি হতে যাচ্ছে যে হারিয়ে যাওযার পথে।
- ইংরেজি থেকে অনূদিত
- মূল লেখা: Back to the brink: Spoon-billed Sandpiper's unanswered story