চরের পতিত জমিতে সূর্যমুখীর হাসি
কুড়িগ্রামে প্রথমবারের মতো পতিত জমিতে সূর্যমুখী চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন চাষিরা। এই চাষের ফলে একদিকে যেমন আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে পতিত অনাবাদি জমিকে কাজে লাগিয়ে লাভবান হচ্ছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সূর্যমুখী থেকে পাখির খাবারের পাশাপাশি কোলস্টরেলমুক্ত তেল উৎপাদন করে ক্ষতিকর পামওয়েল ও সয়াবিনের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রেহাই পাবেন ভোক্তারা। এই ধারণা থেকে চর ও দ্বীপচরগুলোতে কৃষিবিভাগ প্রণোদনার মাধ্যমে ব্যাপক জমিকে চাষাবাদের আওতায় আনতে পারলে পাল্টে যেতে পারে এই এলাকার চিত্র।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার চর মাধবরাম গ্রামে সাত একর জমিতে সূর্যমুখী চাষ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১২ বিঘায় চাষ করছেন কুড়িগ্রাম পৌরসভার পুরাতন পোস্ট অফিস পাড়ার বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দিক (৬০)। বাকি ৯ বিঘায় এলাকার ৯ জন কৃষক সূর্যমুখী চাষ করছেন।
সূর্যমুখী চাষ শুরুতে কেউ বুঝে উঠতে না পারলেও যখন হলুদ বর্ণের ফুল ফুটাতে শুরু করে, তখন থেকে অনেকে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে, আবার কেউবা সূর্যমুখীর সফল চাষ দেখতে ছুটে আসেন। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ দর্শণার্থী সূর্যমুখী দেখতে চর মাধবরাম গ্রামে আসেন।
আবু বকর সিদ্দিক জানান, আমি কয়েক বছর ধরে চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত। ২০১১ সাল থেকে প্রতিবছর চরের পতিত জমিতে তিন থেকে চার মাসের জন্য লিজ নিয়ে কলা, বাঁধা ও ফুলকপি চাষাবাদ করে আসছি। এতে খরচের তুলনায় লাভ অনেক কম হতো।
তিনি আরও বলেন, আমি কুড়িগ্রাম সদর কৃষি বিভাগ থেকে সূর্যমুখীর প্যাসিফিক হাইসান-৩৩ (হাইব্রিড) জাতের বীজ ও রাসায়নিক সার বিনামূল্যে সংগ্রহ করেছি। এবারই প্রথম কৃষি বিভাগের পরামর্শে ও সহযোগিতায় সূর্যমুখী চাষ করেছি। গত বছরের নভেম্বর মাসে সারি করে বীজ রোপন করেছি। তিন মাসের মধ্যে ফুল আসা শুরু হয়। আসা করছি চার মাসের মধ্যেই ফলন পাওয়া যাবে।
ঠিকাদারির পাশাপাশি কৃষিকাজ করা এই ব্যক্তি জানান, এখন পর্যন্ত ১২ বিঘা জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ বাবদ তার খরচ হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। তবে ফসল কর্তন ও মারাইয়ের জন্য কত খরচ হতে পারে, তা তার জানা নেই। প্রায় ৫ বিঘা জমির সূর্যমুখী ফসল কাটার সময় হয়েছে। কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সূর্যমুখী মারাইয়ের যন্ত্র কেনার জন্য তিনি এরই মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করেছেন।
কৃষি কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, সূর্যমুখীর প্রতি চাকে প্রায় ১৩০০ বীজ থাকবে। কিন্তু এখানকার সূর্যমুখী গাছের উচ্চতা প্রায় সাত ফুট। প্রতি চাকে বীজ রয়েছে দুই থেকে আড়াই হাজার। একে তাই বাম্পার ফলন বলাই যায়।
মাধবরাম গ্রামের কৃষক আবদুর রহিম (৬৫) বলেন, সূর্যমুখী চাষে খরচ অল্প এবং পরিশ্রমও কম। যদি দেখি বাজারজাত করা সহজ, তাহলে আগামী মৌসুমে চরে কয়েক বিঘা জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করব।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, সূর্যমুখীর বাজারজাত করার ব্যাপারে লক্ষ্মীপুরের একটি সূর্যমুখী তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ করেছি। তারা সূর্যমুখী বীজ কিনতে আগ্রহী। সূর্যমুখীর স্বাভাবিক ফলন বিঘা প্রতি ছয় থেকে দশ মণ, তবে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে সূর্যমুখীর ফলন দশ মণের বেশি আশা করছি।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান প্রধান জানান, জেলায় ১৬টি নদ-নদীর পায় পাঁচ শতাধিক চর রয়েছে। এসব চরে কৃষি বিভাগ পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিবন্ধকতা সহনশীল ফসল চাষাবাদ করে পতিত জমিগুলোকে চাষাবাদের আওতায় আনার কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, চলতি বছর সদর উপজেলার সাত একরের পাশাপাশি জেলাব্যাপী ৫৭ একর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে সূর্যমূখী চাষ করা হচ্ছে। ফলনও হয়েছে বাম্পার। সূর্যমূখীকে সয়াবিনের বিকল্প তেল হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতে কোলস্টেরল কম। এছাড়া পশু-পাখির খাবার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। আশা করা যায়- সূর্যমুখীর চাষ চর অঞ্চলের কৃষি উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
