অলিম্পিকের উজ্জ্বল চাঁদের আড়ালে যত কলঙ্কের কালি

মহামারির মাঝেও গত সপ্তাহে টোকিওতে পর্দা উঠলো ৩২তম গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের। 'গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ' হিসেবে খ্যাত এই বৈশ্বিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে গিয়ে জাপান সরকারকে গুণতে হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৭০ কোটি টাকা। এই মহারণে বিশ্বের ২০৬টি দেশ থেকে অংশগ্রহণ করবে ১১ হাজারেরও বেশি ক্রীড়াবিদ।
বলা বাহুল্য, আধুনিক অলিম্পিকের স্বপ্নদ্রষ্টা পিয়ের ডি কুবেরত্যাঁর যে প্রাথমিক প্রস্তাবনা ছিল, তা থেকে এখন অনেক দূরে সরে এসেছে এই মহারণ। সেটা কিন্তু এক অর্থে ভালোই। কারণ অলিম্পিকের প্রাথমিক প্রস্তাবনা ও প্রথমদিকের অলিম্পিক আসরগুলোর গায়ে লেগে আছে বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্যসহ আরও নানান কালিমা।
বর্ণিল অলিম্পিকের কলঙ্কজনক অতীত অধ্যায়গুলো থেকে থেকে একটু ঘুরে আসা যাক-
সেইন্ট লুইস প্রহসন:
প্রথমদিকের অলিম্পিক ছিল শুধুই শ্বেতাঙ্গদের খেলা। সে সময়ে বিশ্বের সিংহভাগ অশ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রই ছিল ইউরোপিয়ান দেশগুলোর উপনিবেশে। স্বাভাবিকভাবেই অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করার কোন সুযোগ পেতো না কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদরা।
১৯০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেইন্ট লুইসে অলিম্পিকের তৃতীয় আসর যখন চলমান, তখন অশ্বেতাঙ্গদের অ্যাথলেটীয় সক্ষমতা নিয়ে প্রথমবারের মতো প্রশ্ন তুলে নৃবিজ্ঞান সমাজ। কৃষ্ণাঙ্গরা জন্মগতভাবেই ভালো অ্যাথলেট, নৃতত্ববিদদের এমন অনুমান প্রমাণ (পড়ুন ভুল প্রমাণ)-এর জন্য অলিম্পিকের পাশাপাশি সেইন্ট লুইসে আয়োজিত হয় আরেকটি ছোট আসর। যেটার নাম দেয়া হয়, অ্যানথ্রপলজি (নৃবিজ্ঞান) গেমস।
খাতায় কলমে একটি প্রগতিশীল প্রকল্প হলেও, সেবার অ্যানথ্রপলজি গেমসের নামে যা হয়েছিল তা যেকোনো উৎকৃষ্ট প্রহসনকেও হার মানাবে।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ লোকজনকে ধরে আনা হল, যারা জীবনে কখনো অলিম্পিকের কোন ইভেন্ট দেখেওনি। সাঁতার প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত করার হল এমন ব্যক্তিদের- যারা সাঁতারই জানে না।
মধ্য আফ্রিকার কিছু বামন পিগমিকে ধরে আনা হল, এবং তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় ৫৬ পাউন্ড ওজনের হ্যামার। এবং গেমস শেষে শ্বেতাঙ্গ বিচারকরা রায় দিলেন, কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য অলিম্পিক না।
অলিম্পিক যখন নাৎসি প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার:
এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, বর্তমানে বৈশ্বিকভাবে অলিম্পিকের যে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা- সেটা সম্ভব হয়েছে টেলিভিশনের জন্য। টিভি না থাকলে অলিম্পিক 'গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ' হিসেবে আখ্যায়িত হতো কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে যে বিষয়টি অনেকেই জানেন না, সেটি হচ্ছে টিভিতে অলিম্পিককে জনপ্রিয় করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি রেখেছিল এডলফ হিটলারের একটি প্রোপাগান্ডা সিনেমা।
সময় ১৯৩৬। এবার অলিম্পিক আয়োজিত হচ্ছে বার্লিনে। নতুন প্রযুক্তি হিসেবে টেলিভিশন সবে জার্মানদের হাতে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। জার্মানির তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান এডলফ হিটলার এই মহারণকে দেখলেন বৈশ্বিকভাবে তার নাৎসি দর্শন প্রচারের একটি সুযোগ হিসেবে। অলিম্পিককে ক্যামেরাবন্দি করতে হিটলার দায়িত্ব দেন কিংবদন্তি জার্মান নির্মাতা রিনি রিফেনস্টাইলকে।
রিফেনস্টাইল অলিম্পিকের পুরো আসরকে নিয়ে তৈরি করেন 'অলিম্পিয়া' নামের একটি সিনেমা। নান্দনিক কারুকার্যে করা এই চলচ্চিত্রটি বৈশ্বিকভাবে নাৎসি দর্শন প্রচারে যেমন ভূমিকা রেখেছিল, তেমনি ভূমিকা রেখেছিল অলিম্পিকের গল্প দেশে দেশে পৌঁছে দিতে।
'নারীদের জন্য না অলিম্পিক'?
শুধু বর্ণবাদী আদর্শ না, অলিম্পিকের প্রাথমিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল নারীবিদ্বেষী দর্শন থেকেও। ডি কুবেরত্যাঁ নিজ মুখে বলেছিলেন, অলিম্পিক শুধু পুরুষদের জন্যই। এবং অংশগ্রহণের জন্য পুরুষদের সবচেয়ে বড় পুরষ্কার হচ্ছে নারীদের ভদ্র করতালি।
তারপরও শুরুর দিকে সাঁতার, ডাইভিং ও টেনিসের মতো কিছু ইভেন্টে নারীদের অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হতো। ১৯২৮ সালে প্রথমবারের মতো ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু নারীরা বেশিদূর দৌড়াতে পারবে না, এই চিন্তা থেকে তাদের দৌড় প্রতিযোগিতা সীমিত রাখা হয় ২০০ মিটার পর্যন্ত।
২০০ মিটারের বেশি দৌড়াতে নারী অ্যাথলেটদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৬৮ সালের অলিম্পিক পর্যন্ত। প্রমীলা দৌড়বিদরা প্রথম ম্যারাথনে নামার সুযোগ পেয়েছে ১৯৮৪ সালে।
প্রথমদিককার অলিম্পিকের অনেক কুকীর্তি জানা গেলো। তবে এসব পড়ে বর্তমান আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি বা আইওসি-কে কিন্তু আবার সাধু সংঘ ভেবে বসবেন না। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার জন্য এই সংস্থার নাক কাটা গিয়েছে বেশ কয়েকবার। বড়সড় দুর্নীতির জন্য আইওসি সর্বশেষ শিরোনাম হয়েছিল নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে, সল্ট লেক সিটি কেলেঙ্কারির জন্য।
সল্ট লেক সিটি একটি মার্কিন শহর, যেখানে আয়োজিত হয়েছিল ২০০২ শীতকালীন অলিম্পিক। এই অলিম্পিক আয়োজনের জন্য সল্ট লেক অর্গানাইজিং কমিটির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঘোষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছিল আইওসির সদস্যদের বিরুদ্ধে।
তবে এই কেলেঙ্কারির পর স্বচ্ছতার প্রশ্নে নিজেদের কিছুটা গুছিয়ে এনেছে আইওসি। কিন্তু বর্তমানে বড় বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে অলিম্পিক আসরগুলোই।
প্রতিটি আসর আয়োজনের জন্য আয়োজক শহরগুলো সুবিশাল সব প্রকল্প হাতে নেয়। ওইসব প্রকল্পের অর্থের জোগান দিতে গিয়ে প্রায় সময়ই বড়সড় অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখ দেখতে হয় আয়োজক দেশগুলোর। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আয়োজক শহরের দরিদ্র জনতা।
কেননা, যখন একটি শহর অলিম্পিকের মতো কোন আসর আয়োজন করে, সে শহরে জীবনযাত্রার খরচ আকাশচুম্বী হয়ে যায়। আর শহরে অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ঝাঁকিটাও সবসময় যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের উপর দিয়েই। ২০০৮ অলিম্পিকের অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারের প্রয়োজনে বেইজিংয়ের প্রায় ১০ লাখ লোককে গৃহচ্যুত করেছিল চীন সরকার।
বেইজিংয়ের গৃহহীনদের জন্য যদিও বিকল্প ব্যবস্থা করেছিল সরকার, কিন্তু অনেক দেশ সেটাও করে না। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় যখন অলিম্পিক আয়োজিত হয়েছিল, তখন স্থানীয় প্রায় ২৫ হাজার গৃহহীন উদ্বাস্তুকে শহর থেকে বের করে দিয়েছিল আয়োজক কমিটি। ২০১৬ রিও অলিম্পিকের সময় ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষকে শহরচ্যুত করেছিল ব্রাজিল সরকার।
আয়োজক শহর গণ-নির্বাসনের মাধ্যমে সাধারণত চেষ্টা করে শহরকে বাস্তুহীন, নেশাখোর ও ভ্যাগাবন্ডমুক্ত করতে। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টার কারণে পার্শ্ববর্তী শহরগুলোয় অপরাধের হার সবসময় অনেক বেড়ে যায়। তাই এই গণ-নির্বাসন যেমন আয়োজক শহরের ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, একই সাথে নষ্ট করছে পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর পরিবেশকেও।
- সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক