বিশ্বকাপের যতো ঘটন-অঘটন

ফুটবল ঘটন-অঘটনেরই খেলা। আর বিশ্বকাপে তো অঘটনের পসরাই বসে বলা চলে। তুলনামূলক কম শক্তির দলগুলোর কাছে বড় বড় দলগুলোর ধরাশয়ী হওয়া নতুন কিছু নয়।
প্রতিটি বিশ্বকাপেই ঘটন-অঘটনের মেলা বসে। এ পর্যন্ত হওয়া ২১টি বিশ্বকাপ কম অঘটন দেখেনি। তবে এত অঘটনের ভিড়েও সেরা ৬ অঘটন কোনগুলো? এটি নিয়েই এই আয়োজন।
১. সেনেগাল-ফ্রান্স (২০০২ বিশ্বকাপ, গ্রুপ পর্ব, ১ম ম্যাচ) :
২০০২ বিশ্বকাপে ফ্রান্স গিয়েছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। ২০০০ সালের ইউরোজয়ী দলও ছিল ফ্রান্স। ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে টানা ৩টি আন্তজার্তিক টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হবার হাতছানি ছিল তাঁদের সামনে। ২০০২ বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট এবং সেরা দলও ছিল ফ্রান্সের।
গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে তাঁদের প্রতিপক্ষ ছিল আফ্রিকান দেশ সেনেগাল। ধারে কিংবা ভারে কোনোদিক থেকেই সেনেগাল ফ্রান্সের কাছাকাছি মানের ছিল না। সেই সেনেগালই ফ্রান্সকে হারিয়ে দেয় ১-০ গোলে। যা বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড় অঘটন বলে বিবেচিত। ম্যাচের ৩০ মিনিটে পাপা বউবা দিওপ একমাত্র গোলটি করেন। বিশ্বজয়ের মুকুট রক্ষা করতে এসে ইতিহাসের প্রথম রাউন্ডেই বাড়ির পথ ধরে ফ্রান্স।
২. ক্যামেরুন-আর্জেন্টিনা (১৯৯০ বিশ্বকাপ, গ্রুপ পর্ব, ১ম ম্যাচ) :
বিশ্বকাপে সেবার আর্জেন্টিনা এসেছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। দলে ছিলেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় ডিয়েগো ম্যারাডোনা। সেই আর্জেন্টিনাই কিনা গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই হেরে বসে আফ্রিকান সিংহ নামে খ্যাত ক্যামেরুনের কাছে।
ম্যাচের শুরু থেকেই ক্যামেরুনের পরিকল্পনা ছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে আটকানো। যার ফলে ম্যারাডোনাকে ট্যাকল করে ক্যামেরুনের দু'জন লাল কার্ড দেখেন। কিন্তু নয় জনের দল নিয়েই ম্যাচের ৬৭ মিনিটে ফ্রাঙ্কো ওমাম বিয়িকের গোল অঘটনের জন্ম দেয়। ক্যামেরুন কেবল গ্রুপ পর্বেই থেমে থাকেনি, কোয়ার্টার ফাইনালও খেলেছিল তাঁরা। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ক্যামেরুনের জয়টিকে বিশ্বকাপে আফ্রিকান কোনো দলের সেরা মূহুর্ত বলেও আখ্যা দেয়া হয়।
৩. উত্তর কোরিয়া-ইতালি (১৯৬৬ বিশ্বকাপ, গ্রুপ পর্ব, ৩য় ম্যাচ) :
ইংল্যান্ডে ১৯৬৬ বিশ্বকাপে অন্যতম ফেভারিট হিসেবেই গিয়েছিল ইতালি। গ্রুপে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিলি এবং উত্তর কোরিয়া। একমাত্র এশিয়ান দল হিসেবে সেবার বিশ্বকাপে খেলেছিল উত্তর কোরিয়া। গ্রুপ পর্বের ২ ম্যাচ শেষে পয়েন্ট দাঁড়ায় ইতালি ২, উত্তর কোরিয়া ১।
পরের রাউন্ডে যেতে ইতালির ড্র হলেই যথেষ্ট, জিততেই হতো কোরিয়াকে। তবে সে আশা স্বয়ং কোনো উত্তর কোরিয়ানও বোধোহয় করেননি। ম্যাচের ৪২ মিনিটে পাক দু ইকের গোল লিড এন দেয় উত্তর কোরিয়াকে। বাকি সময় সেটি ধরে রেখে বিশ্বকাপেরেই অন্যতম সেরা অঘটনের জন্ম দেয় তাঁরা। প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে ইতালি।
৪. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- ইংল্যান্ড (১৯৫০ বিশ্বকাপ, গ্রুপ পর্ব, ২য় ম্যাচ) :
১৯৫০ বিশ্বকাপে শৌখিন দল পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপ আর দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল পরাশক্তিদের বিপক্ষে লড়াই করতে পারবে না বলেই ভেবেছিল তাঁরা। গ্রুপ পর্বের ১ম ম্যাচে স্পেনের কাছে ৩-১ গোলের হার। ২য় ম্যাচে তাঁরা মুখোমুখি ইংল্যান্ড এর। ইংল্যান্ড তখন স্বীকৃতভাবেই বিশ্বের সেরা দল। সেই দলকেই কিনা মার্কিনিরা হারিয়ে দেয় ১-০ গোলে! ম্যাচের প্রথম ১৫ মিনিটেই ইংল্যান্ড গোলমুখে ৬টি শট নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের গোলকিপার ফ্র্যাংক বোরগি অসাধারণ কয়েকটি সেভ করেন। ৩৭ মিনিটে জো গাটজেনস এর গোলই ম্যাচের একমাত্র গোল হিসেবে রয়ে যায়। ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ড তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্র এমনকি ব্রাজিলিয়ান সমর্থকরাও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে এমনটি ঘটেছে। প্রতি গ্রুপ থেকে মাত্র একটি দল পরের পর্বে যেতে পারতো বিধায় ইংল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। পরের ৪০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি।
৫. জার্মানি- ব্রাজিল (২০১৪ বিশ্বকাপ, সেমি-ফাইনাল):
আর এক ধাপ পেরোলেই নিজেদের আঙ্গিনায় বিশ্বকাপ ফাইনাল! এর চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কিছু হতে পারে না। ব্রাজিলের সামনেও সেদিন এসেছিল এই সুযোগ। প্রতিপক্ষ জার্মানি। যদিও দলের প্রাণভোমরা নেইমার এবং অধিনায়ক থিয়াগো সিলভাকে ছাড়াই খেলতে নামে ব্রাজিল। তবুও তাঁদের সমর্থরা মাঠে এসেছিলেন দারুণ কিছুর প্রত্যাশা নিয়ে। প্রথম ১০ মিনিট দু'দলই ছন্নছাড়া ফুটবল খেলে। এরপরই কর্নার থেকে টমাস মুলারের গোল যেন বাঁধ ভেঙ্গে দেয়।
এরপর ২৩ মিনিটে মিরোস্লাভ ক্লোসার ইতিহাস গড়া গোল (বিশ্বকাপে এক খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বেশি গোল) থেকে ২৯ মিনিটে সামি খেদিরার গোল। এই ৬ মিনিটে যেন সুনামি বয়ে যায় ব্রাজিলের উপর দিয়ে। এই সময়ের মধ্যেই গোল হয় ৪টি! অর্থাৎ ৩০ মিনিটেই জার্মানি এগিয়ে যায় ৫-০ গোলে! এরপর দ্বিতীয়ার্ধে আরো দু'টি গোল করে জার্মানরা। ম্যাচের ৯০ মিনিটে অস্কারের গোল ব্রাজিলিয়ানদের কষ্ট আরো বাড়িয়েছিল কেবল। ১৯৫০ এর মারাকানাজোর পর আরেকবার নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ থেকে কান্না নিয়ে বিদায় নেয় ব্রাজিল। যা ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ইতিহাসেরই সবচেয়ে বাজে পরাজয়।
তবে এই ম্যাচটির প্রেক্ষাপট অন্য ম্যাচগুলোর মতো নয়। সেমিফাইনালের মতো জায়গায় জিততে পারে যে কেউ। কিন্তু ম্যাচের স্কোরলাইনই এটিকে সেরা অঘটনের তালিকায় রাখতে বাধ্য করেছে।
৬. মেক্সিকো-জার্মানি (২০১৮ বিশ্বকাপ, গ্রুপ পর্ব, ১ম ম্যাচ):
২০১৪ বিশ্বকাপের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে রাশিয়ার বিশ্বকাপে আসে জার্মানি। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে জার্মানদের প্রতিপক্ষ ছিলো মেক্সিকো। ম্যাচে শুরু থেকেই দারুণ উজ্জীবিত মেক্সিকান ওয়েভের সামনে খেই হারিয়ে বসে জার্মানি। ৩৪ মিনিটে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে চাকি লোজানোর গোলে এগিয়ে যায় মেক্সিকো। এরপর শত চেষ্টা করেও ম্যাচে ফিরতে পারেনি জার্মানি। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে হারের পর শেষ ম্যাচেও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ২-০ গোলে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় জোয়াকিম লো'র শিষ্যরা। আগের দুই বিশ্বকাপের মতোই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের গ্রুপ পর্বে বাদ পড়ার ধারাও বজায় রাখে জার্মানি।
কাতার বিশ্বকাপেও অঘটন ঘটার সম্ভাবনা বেশ প্রবল। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের কন্ডিশনে এশিয়ান দলগুলো জাদু দেখাতেই পারে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান এমনকি স্বাগতিক কাতারও কোনো বড় দলকে রুখে দিয়ে বিশ্বকে চমকে দিতে নিশ্চয়ই প্রস্তুত।