আক্ষেপ, হতাশায় বিশ্বকাপ মিশন শেষ বাংলাদেশের

প্রতিপক্ষ কে, সেটা ভাবার সময় কই! জিতলেই সেমি-ফাইনাল; নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার হারে এই সমীকরণ ততোক্ষণে সবার জানা হয়ে গেছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে তাই ম্যাচটি কোয়ায়ার্টার ফাইনাল। ফিঁকে হয়ে পড়া স্বপ্নের রং লাগতেই চাঙ্গা দর্শকমন। ম্যাচ শুরুর বেশ আগেই অ্যাডিলেড ওভালের বাইরে বাংলাদেশি দর্শকদের মেলা। তাদের উন্মাদনা দেখতে দেখতেই মাঠে ঢোকেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
টস জয়ে শুরু, ব্যাট হাতে শুরুটাও মন্দ ছিল না। কিন্তু আবহ পাল্টে যেতে সময় লাগলো না। হতাশার ব্যাটিংয়ের মাঝে শান্ত-আফিফরা কেবল রানচাকা ঘোরালেন। অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের বিতর্কিত আউট হয়ে থাকলো আক্ষেপ। পরে বল হাতে শুরুতেই সহজ ক্যাচ মিস, রান আউটের সুযোগও কাজে লাগানো গেল না। হতাশা, আক্ষেপ মোড়ানো ম্যাচে হার মেনে নিতে হলো সাকিব আল হাসানের দলকে। দৃষ্টিসীমায় থাকা সেমি-ফাইনাল থেকে চোখ সরিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হলো বাংলাদেশকে।
রোববার অ্যাডিলেড ওভালে সুপার লিগে নিজেদের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৫ উইকেটে হেরেছে বাংলাদেশ। এই জয়ে ভারতের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে দুই নম্বর গ্রুপ থেকে সেমি-ফাইনালে উঠলো বাবর আজমের দল। বাংলাদেশের সাফল্যের খাতায় লেখা রইলো ওই দুটি জয়ই। তাতেই অবশ্য টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেরা পারফরম্যান্স হয়ে গেছে। এবারই যে প্রথমবারের মতো মূল পর্বে দুটি ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ।
টস জিতে আগে ব্যাটিং করতে নামা বাংলাদেশ উদ্বোধনী জুটি থেকে বড় রান না পেলেও ছন্দে ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে হারিয়েছে সেই ছন্দ। সাকিবের আউটের পর তা বিধ্বস্ত অবস্থায় রূপ নেয়। নাজমুল হোসেন শান্তর হাফ সেঞ্চুরি, সৌম্য সরকার ও আফিফ হোসেন ধ্রুবর ছোট ইনিংসে ৮ উইকেটে ১২৭ রান তোলে বাংলাদেশ। জবাবে ধীর স্থির শুরুর পর মাঝে ধুঁকলেও তা কাটিয়ে উঠে মোহাম্মদ হারিস ও শান মাসুদের ব্যাটে ১১ বল (১৮.১) হাতে রেখেই জয় তুলে নেয় পাকিস্তান।
ছোট লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নামা পাকিস্তানকে শুরুতেই চেপে ধরতে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু ইনিংসের প্রথম ওভারেই সুযোগ হাতছাড়া হয়। তাসকিন আহমেদের করা তৃতীয় বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। কিন্তু সহজ ক্যাচটি ডাইভ দিয়ে নিতে গিয়ে মাটিতে ফেলেন বাংলাদেশের উইকেটরক্ষক নুরুল হাসান সোহান। যেন ম্যাচ জেতার সুযোগটাই মাটিতে ফেলেন দেন তিনি।
শুরুতেই জীবন পাওয়া রিজওয়ান পরের বলেই তাসকিনকে ছক্কা মারেন। এই শটের পর দ্রুতই উইকেটে নিজেকে মানিয়ে নেন পাকিস্তানের উইকেটরক্ষক এই ব্যাটসম্যান। রিজওয়ান স্বাভাবিক ব্যাটিং করলেও অধিনায়ক বাবর আজম টি-টোয়েন্টি মেজাজে ব্যাট চালাতে পারেননি। পাওয়ার প্লের ৬ ওভার থেকে বিনা উইকেটে ৩৫ রান পায় পাকিস্তান।
৯.৪ ওভারে ৫০ পূর্ণ হয় পাকিস্তানের, ৫৭ রানে ভাঙে তাদের উদ্বোধনী জুটি। নাসুম আহমেদের বলে মুস্তাফিজুর রহমানের হাতে ক্যাচ দেওয়ার আগে ৩৩ বলে ২টি চারে ২৫ রান করেন বাবর। পরের ওভারে আঘাত হানেন এবাদত হোসেন। ডানহাতি এই পেসারের বলে নাজমুল হোসেন শান্তর হাতে ক্যাচ দেন রিজওয়ান। ফেরার আগে ৩২ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় ৩২ রান করেন তিনি।
এরপর মোহাম্মদ নওয়াজ ও মোহাম্মদ হারিসের ব্যাটে এগোয় পাকিস্তান। নওয়াজ ধুঁকলেও মারকুটে মেজাজে ব্যাট চালান হারিস। ১১ বলে ৪ রান করা নওয়াজের বিদায়ে ভাঙে এ দুজনের ৩১ রানের জুটি। একেবারে কাছে গিয়ে থামেন হারিস। এর আগে ১৮ বলে একটি চার ও ২টি ছক্কায় ৩১ রানের মহাকার্যকর এক ইনিংস খেলেন তিনি। দুই রান দূরে থাকতে বিদায় নেন ইফতিখারও। ১৪ বলে ১৪ রানের হার না মানা ইনিংস খেলে দলকে জেতান শান। বাংলাদেশের নাসুম, সাকিব, মুস্তাফিজ ও এবাদত একটি করে উইকেট নেন।
এর আগে ব্যাটিং করতে নেমে সাবলীল শুরু করেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার নাজমুল হোসেন শান্ত ও লিটন কুমার দাস। দুজনের শারীরিক ভাষা ইতিবাচকই দেখাচ্ছিল। এরপরও অবশ্য ভালো শুরু পায়নি বাংলাদেশ। দলীয় ২১ রানে শাহনি শাহ আফ্রিদিন বলে শট খেলতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ধরা পড়েন ৮ বলে ১০ রান করা লিটন।
লিটনের বিদায়ের চাপ অবশ্য বুঝতে হয়নি বাংলাদেশকে। চাপ কাটিয়ে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন শান্ত ও সৌম্য সরকার। শুরুর তিন ওভারের মতো রানের গতি না থাকলেও স্বস্তি মেলে এই দুজনের ব্যাটে। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে ১ উইকেটে ৪০ রান তোলে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় উইকেটে ৪৭ বলে ৫২ রানের জুটি গড়েন শান্ত-সৌম্য। যদিও শুরুর মতো করে ইনিংসের শেষটা করতে পারেননি সৌম্য। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান ১৭ বলে ২০ রান করে আউট হন।
পাকিস্তানের লেগ স্পিনার শাদাব খান পরের বলেই ফিরিয়ে দেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে। ১১তম ওভারে টানা দুই বলে দুই উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে যায় বাংলাদেশ। যদিও সাকিবের আউট নিয়ে বিতর্ক আছে। টিভি রিপ্লেতে দেখা গেছে বল সাকিবের ব্যাটেই লেগেছে। কিন্তু রিভিউ নেওয়ার পরও তাকে আউট দেওয়া হয়। এ নিয়ে মাঠে আম্পায়ারদের সাথে কথা বলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি, প্রথম বলেই আউট হয়ে সাজঘরে ফিরতে হয় তাকে।
এরপর আফিফ হোসেন ধ্রুবকে নিয়ে লড়াই শুরু করেন ইনিংস উদ্বোধন করতে নামা শান্ত। আফিফের সঙ্গে ১৮ রানের জুটি গড়ে বিদায় নেন বাঁহাতি এই ওপেনার। ইফতিখার আহমেদের বলে এগিয়ে খেলতে গিয়ে বোল্ড হন শান্ত। ফেরার আগে ৪৮ বলে ৭টি চারে ৫৪ রান করেন তিনি। চলতি বিশ্বকাপে এটা তার দ্বিতীয় হাফ সেঞ্চুরি। শান্তর বিদায়ে রান তোলার গতি আরও কমে যায়। আফিফের সঙ্গে যোগ দেওয়া মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত মুরুতে সেভাবে ব্যাটে-বলে করতে পারছিলেন না। রান তুলতে সংগ্রাম করতে হচ্ছিল তাকে।
১৫.১ ওভারে ১০০ রান পূর্ণ হয় বাংলাদেশের। শুরু থেকেই ধুঁকতে থাকা মোসাদ্দেক একটু পরই সাজঘরে ফেরেন। হতাশার ব্যাটিংয়ে ১১ বলে ৫ রান করেন তিনি। এরপর ব্যাটসম্যান না থাকায় আফিফকে দেখেশুনে ব্যাট চালাতে হয়। তাসকিন আহমেদ তাকে সঙ্গ দিতে পারেননি, ৫ বলে ১ রান করে ফিরেন যান বাংলাদেশের এই পেসার।
শেষ দিকে আফিফের ব্যাটেই যা রান আসে। বোলারদের নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান ২০ বলে অপরাজিত ২৪ রান করেন। নাসুম আহমেদ ৬ বলে ৭ রান করেন। পাকিস্তানের বাঁহাতি পেসার শাহিন আফ্রিদি ৪ ওভারে ২২ রানে ৪টি উইকেট নেন। শাদাব খান পান ২টি উইকেট একটি করে উইকেট পান হারিস রউফ ও ইফতিখার।