‘আমরার পুয়ায় বিশ্বজয় করছে’

সিলেটের ওসমানীগরের তাজপুর বাজার থেকে বালাগঞ্জের তিলকচানপুর গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। এই সড়কের দুই পাশে অসংখ্য মানুষের ভিড়। এক কিশোরকে বরণ করে নিতে জড়ো হয়েছেন তারা।
যারা জড়ো হয়েছেন তাদের অনেকেই কিশোরটির নাম জানেন না। সড়কের পাশে দাঁড়িয়েই একজন আরেকজনের কাছ থেকে নাম জেনে নিচ্ছিলেন। আর তার চেহারা তো চিনেন না বেশিরভাগ লোকই।
তারা কেবল এইটুকুই জানেন, এই এলাকার এক ছেলে বিশ্বকাপ জয় করে এসেছে। সে বাড়ি ফিরছে আজ। তাকে বরণ করে নিতেই জড়ো হয়েছেন সবাই।
তাজপুর এলাকায় সড়কের পাশে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বৃদ্ধ আছকর আলী। কেন দাঁড়িয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরার পুয়ায় (ছেলে) বিশ্বজয় করছে। সে আইজ আইব (আসবে)। তারে দেখতে আইছি (আসছি)।’
এই ‘আমরার পুয়া’ হচ্ছে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় তানজিম হাসান সাকিব। সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার বালাগঞ্জ সদর ইউনিয়নের তিলকচানপুর গ্রামের গউছ মিয়া ও সেলিনা পারভীনের ছেলে তিনি। বিশ্বকাপ জয় করে বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজ বাড়িতে ফিরেন তিনি।
আছকর আলীর সঙ্গে আলাপের কিছুক্ষণ পরই মানুষের হৈ-হুল্লোড় আর মোটরসাইকেলের কান ঝালাপালা করে হর্ন শোনা গেল। শতাধিক মোটর সাইকেলের বহর দেখা গেল সড়কে। এই বহরেরই একটি মোটরসাইকেলের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সদ্য সদ্য গোঁফ ওঠা এক ক্রিকেটার।
গলায় ফুলের মালা আর হাতের বিজয় চিহ্নই জানিয়ে দিল তিনি সেই বিশ্বজয়ী ছেলে, যে বেড়ে ওঠেছে এই গাঁয়েরই ধুলোমাটিতে।
সাকিবের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে গেল। আগে থেকেই পাড়া-প্রতিবেশী জড়ো হয়েছেন বাড়িতে। মোটর সাইকেল শোভাযাত্রা বাড়িতে পৌঁছাতেই করতালি আর 'সাকিব সাকিব' স্লোগানে তাকে বরণ করে নেওয়া হলো। বাংলাদেশের নামে স্লোগানও হলো কিছুক্ষণ।
সবাই নিজেদের মতো করে উদযাপনে ব্যস্ত। আলাদা করে কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নেই। সাকিবের বাবা-মা তো শত শত অতিথিদের খাতির যত্ন করইে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তার ওপর আছে সেলফির আবদার। এতসব ডিঙিয়ে তাদের কাছে পৌঁছানোই ছিল দায়।
তার আগে এলাকাবাসীদের কাছ থেকেই জেনে নেওয়া গেল কিছু তথ্য। কাতার প্রবাসী গউছ মিয়া আর গৃহিনা সেলিনা পারভীনের চার সন্তানের তৃতীয় সাকিব। পড়েছেন স্থানীয় বালাগঞ্জ ডিএন স্কুলে। এরপর চলে ঢাকার সাভারে বিকেএসপিতে।
সাকিবের সহপাঠী আলাউদ্দিন জানান, সাকিব সারাদিনই ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকত। বাড়িতে বকা দিলেও লুকিয়ে খেলার মাঠে চলে যেত।
এলাকাবাসী আর সহপাঠীদের কাছ থেকে এ রকম খুঁটিনাটি তথ্য জেনে নেওয়ার ফাঁকেই দেখা মিলল গউছ মিয়ার। ছেলেকে বরণ করতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন তিনি।
গউছ জানান, ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ছিল সাকিব। সারাক্ষণ খেলাধুলা নিয়ে থাকত। এ জন্য অনেকসময় তারা রাগ করেছেন; বকা দিয়েছেন। কিন্তু যখন দেখলেন খেলাধুলার প্রতিই তার সব আগ্রহ, তখন বিকেএসপিতে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নেন।
ছেলের বিজয়ে গর্বিত এই বাবা বলেন, আজ সাকিবরা পুরো দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তারা পুরো দেশের সন্তান।
এলাকার এই উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসায় আপ্লুত সাকিবও। তিনি বলেন, ''এলাকার মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এলাকার মানুষ দেশের মানুষকে আনন্দ দিতে পেরেছি; এটাই আমাদের সার্থকতা।"
সাকিব বলেন, "ফাইনালে উঠার পর আমাদের দলের সবাই জয়ের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। ম্যাচের আগের দিনও টিম মিটিংয়ে জয় ভিন্ন অন্য কিছু নিয়ে আমরা ভাবিনি।"
বৃহস্পতিবার সিলেটে সাকিবকে ঘিরে উৎসবটা শুরু হয় আসলে সকাল থেকেই। সকাল থেকেই ক্রীড়াপ্রেমীদের অনেকে জড়ো হন সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
দুপুর দেড়টার দিকে সাকিবকে বহনকারী বিমানবন্দর এসে পৌঁছালে তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়।
ওই সময় উপস্থিত ছিলেন সাকিবের এলাকা সিলেট-৩ আসনের সাংসদ মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েস।
তিনি জানান, বিজয়ী দলের সব সদস্যকে সিলেট এনে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।