বিধ্বস্ত ইংল্যান্ড ম্যারাডোনাকে যেভাবে আর্জেন্টিনার দেবতা বানিয়ে দিল!

ফুটবলের ইতিহাসে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে কিংবদন্তি ম্যারাডোনার মতো সাফল্য কেউ ছুঁতে পারেনি- একথা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে।
পেলেকে ম্যারাডোনার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরা হয়। সহ-খেলোয়াড়দের সঙ্গে মিলে তিনবার ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন এই সেরা খেলোয়াড়। কিন্তু ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যারাডোনার সহ-খেলোয়াড়দের নাম অনেকে মনেই করতে পারে না। এর কারণ হয়তো তিনি একাই ছিলেন এই একশ।
বছরের পর বছর ফুটবলের মাঠে একাই একশ ছিলেন তিনি, আর ছিলেন চমৎকার কৌশলবিদ।
জার্মানির বিপরীতে খেলার সময় তার দুর্দান্ত পাস সেবার আর্জেন্টিনাকে জিতিয়েছিল। আর সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপরীতে ম্যারাডোনা নিজেই করেছিলেন দুই গোল।
তবে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপরীতে খেলা সেই ম্যাচটি মনে হয় ম্যারাডোনার খেলোয়াড় জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্মারক হয়ে থাকবে।
উনবিংশ শতক ও বিংশ শতকের শুরুর দিকটা পর্যন্ত কাগজে-কলমে না হলেও আর্জেন্টিনা ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ। উপনিবেশের সৌজন্যেই আর্জেন্টিনায় ফুটবল খেলার সঙ্গে পরিচয় করানো হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে আর্জেন্টিনায় ফুটবল নিয়ে আসে ঔপনিবেশিক ইংল্যান্ড। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সমাজের উঁচু শ্রেণির বিনোদনের রূপ পালটে সকল স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে গেল ফুটবল। নিচের স্তরের মানুষদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল এই খেলা। ম্যারাডোনা ছিলেন এই শ্রেণির মানুষ।
আর এই খেলাকে নিজেদের করে নেওয়ার পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেল আর্জেন্টিনার নাম। এতদিন আড়ালে থাকা দেশটির দিকে যেন এই প্রথমবারের মতো নজর পড়ল বিশ্ববাসীর।
আর এভাবে নিচ থেকে উঠে আসার গল্প যেন ম্যারাডোনার নিজেরই। ইতালির শরনার্থী আর আদিবাসী আমেরিকান- এই পূর্বসুরিতা রক্তে নিয়ে জন্ম ম্যারাডোনার। বুয়েন্স আইয়ের্স এর দরিদ্র অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন তিনি। সেই পরিবেশ থেকেই পূনর্জন্ম নিয়ে উঠে এলেন খ্যাতির চূড়ায়।
আর এরপর ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে যেভাবে ইংল্যান্ডের বিপরীতে দুইতা গোল করেন ম্যারাডোনা, এরপর থেকে আর্জেন্টিনার সমস্ত নাগরিকের চোখে যেন এক দেশপ্রেমী হিরো হয়ে উঠেন তিনি।
প্রথম গোলটা ছিল বিখ্যাত 'হ্যান্ড অফ গড' বা ঈশ্বরের হাত নামের গোলটি, যেখানে ইংল্যান্ডের গোলপোস্টে বলটা পৌঁছে দেওয়ার আগে ম্যারাডোনা একটা হাত ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু সেটা লক্ষ্য করেননি রেফারি।
আর এর ৫ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যেই দ্বিতীয় গোলটা করেন ম্যারাডোনা। মাঠের মাঝখান থেকে ইংল্যান্ডের গোলপোস্টে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত বলটা যেন ম্যারাডোনার পায়ের সঙ্গেই বাধা ছিল, একবারের জন্যও পাছাড়া না করে একাই দিয়ে বসলেন আশ্চর্য সেই গোল।
বিবিসি রেডিওতে ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন বায়রন বাটলার। ঠিক যেন ম্যারাডোনার গতির সঙ্গে তাল রেখেই- 'ম্যারাডোনা, একটা পাঁকাল মাছের মতো বেঁকে যেন বেরিয়ে এলেন বিপদ থেকে। ছোট্টখাট্ট মানুষটা প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডার টেরি বুচার এর মুখোমুখি, পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এবার মুখোমুখি সেন্টার ব্যাক টেরি ফেনউইককেও ছেড়ে এলেন, পায়ের বল তার কাছে ছাড়ানোর উপায় নেই কারও। এজন্যই দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড় ম্যারাডোনা, ইংল্যান্ডের প্রতিরক্ষা বলয়কে একেবারে ধ্বসে দিয়েছেন তিনি।'
এদিকে ম্যারাডোনার করা এই দুই গোলকে ঔপনিবেশিক ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এক দেশপ্রেমী প্রতিশোধ বলেই ধরে নিলেন আর্জেন্টিনার দেশবাসীরা। প্রথম গোলটা যেন বলছে 'ক্ষমতা ওদের হাতে থাকলেও আমরাই বেশি বুদ্ধিমান'। আর দ্বিতীয় গোলের ব্যাখ্যা যেন ছিল 'আমরাই সেরা'।
এই দুই গোলের কারণে সহযোদ্ধাদের চোখে ঈশ্বরের আসন পেয়ে গেলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু এই 'ঐশীপ্রাপ্তি' খুব মঙ্গলের ছিল না, পরবর্তীতে এজন্য ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল ম্যারাডোনাকে।
সূত্র: বিবিসি