ধ্বংসস্তূপ থেকে অলিম্পিকে ১২ বছর বয়সী জাজা

ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখি উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে কেমন হয়? এমন কোনো দৃশ্যের বাস্তবিক উপস্থিতি না থাকলেও লেখকদের বর্ণনা পড়ে অনেকেই নিজের মতো করে একটা দৃশ্য সাজিয়ে নেন। যেখানে থাকে ধ্বংস-ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে নতুন দিগন্তের পথে এগিয়ে যাওয়ার রঙিন সব অধ্যায়। হেন্দ জাজার গল্প ফিনিক্স পাখির সঙ্গে মেলালে বাড়াবাড়ি মনে হবে?
টোকিও অলিম্পিক দিয়ে জাজার সঙ্গে যাদের পরিচয় হয়ে গেছে, তারা না ভেবেই উত্তর দিয়ে দেবেন, 'মোটেও বাড়াবাড়ি হবে না।' সিরিয়ায় বেড়ে উঠতে কতটা এবড়ো-থেবড়ো পথ পাড়ি দিতে হয়, তা কারোরই অজানা নয়। সেখানে গৃহযুদ্ধ বিদ্ধস্ত এই দেশ থেকে নিজ যোগ্যতায় অলিম্পিকে জায়গা করে নেওয়া রূপকথার চেয়ে কম কীসে!
যুদ্ধ কিংবা বিধ্বস্ত; এমন শব্দ শুনলে বেশিরভাগ মানুষ আফগানিস্তান কিংবা সিরিয়ার কথা মনে করেন। তাদের গল্প এমনই। গুলির শব্দ কিংবা স্বজন হারানোর আর্তনাদে ঘুম ভাঙে এখানকার মানুষের। কাটা বিছানো দুর্গম পাহাড় কিংবা বিস্তৃত মরুভূমি পেরিয়ে সবুজ দিগন্ত খুঁজে বের করতে যে মেহনতটা করতে হয়, তার চেয়েও বহুগুনে মেহনত করে অলিম্পিকে জায়গা করে নেন জাজা।

টোকিও অলিম্পিকে ইতিহাস গড়ে ফেলেননি সিরিয়ার এই টেবিল টেনিস কন্যা। প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়েছেন জাজা। অস্ট্রিয়ার লিউ জিয়ার বিপক্ষে সরাসরি ১১-৪, ১১-৯, ১১-৩, ১১-৫ গেমে হেরে গেছেন তিনি। প্রতিপক্ষ লিউ জিয়ার বয়স ৩৯ বছর, অর্থাৎ জাজার বয়সের তিন গুণেরও বেশি। হ্যাঁ, মাত্র ১২ বছর বয়সে অলিম্পিকে অংশ নিয়ে সবার নজড় কেড়েছেন তিনি।
টোকিও অলিম্পিকে সবচেয়ে কম বয়সী অ্যাথলেট জাজা। তার দেশের আর কোনো অ্যাথলেট এতো কম বয়সে অলিম্পিক মঞ্চে জায়গা করে নিতে পারেননি। জাজা অবশ্য ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ অ্যাথলেট নন। অ্যাথেন্সে অনুষ্ঠিত ১৮৯৬ অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন ১০ বছর বয়সী গ্রিক জিমন্যাস্ট দিমিত্রিওস লাউনদ্রাস। ১৯৭১ সালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো লাউনদ্রাসের দখলেই আছে রেকর্ডটি।
ইন্টারন্যাশনাল টেবিল টেনিস ফেডারেশনের দেওয়া তথ্যমতে জাজার জন্ম ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি। তার বর্তমান বয়স ১২ বছর ২০৫ দিন। ১৯৬৮ সালের পর সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন জাজা। সিরিয়ার এই টেবিল টেনিস কন্যার পর সবচেয়ে কম বয়সী অ্যাথলেট হিসেবে টোকিও অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন বৃটেনের ১৩ বছর বয়সী স্কেটবোর্ডার স্কাই ব্রাউন।

অলিম্পিকে সাফল্য না পাওয়ায় আক্ষেপ নেই জাজার। অলিম্পিকে অংশ নেওয়াটাই তার কাছে বিরাট অর্জন। জাজা বলেন, 'টোকিও অলিম্পিকে অংশ নিতে পারাটাই একটা অর্জন। আমাকে জেতার কথা বলা হয়নি, আমাকে বলা হয়েছে 'ভালো খেলো'। আমার ধারণা আমি ভালোই করেছি এবং এই হার থেকে শিক্ষা নিচ্ছি। আশা করি, পরের অলিম্পিকে আমার জন্য কিছু থাকবে।'
নিজের চেয়ে তিনগুণ বেশি বয়সী অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের সঙ্গে মোকাবিলা করার বিষয়টি রোমাঞ্চিত করেছে জাজাকে। তার ভাষায়, 'আমার দৃষ্টিতে আমি কিছু হলেও অর্জন করেছি। ১২ বছরের একটা মেয়ে ৩৯ বছর বয়সীর বিপক্ষে খেলছে এবং ৯ বা ১০ পয়েন্ট নিচ্ছে, এটাই অর্জন। কোনো সন্দেহ নেই, জিততেই চেয়েছিলাম এবং আরও দু-এক ম্যাচ এগোতে চেয়েছিলাম। আশা করি পরের অলিম্পিকে সেটা হবে।'

জাজার জন্ম ক্রীড়া পরিবারে। মাত্র ৫ বছর বয়সে টেবিল টেনিসে তার হাতেখড়ি! টেনিসের পথচলা শুরু হলেও পথটা ছিল একেবারেই আঁকাবাঁকা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ ছাড়াও দেশের গৃহযুদ্ধের কারণে এক বছরে দেশের বাইরে মাত্র দুই-তিনটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এরপরও দমে যাননি জাজা, নিজেকে প্রস্তুত করে গেছেন স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখবেন বলে।
গত বছর জর্ডানের আম্মানে অনুষ্ঠিত ওয়েস্টার্ন এশিয়া অলিম্পিক কোয়ালিফিকেশনে সব আলো কেড়ে নেন তিনি। টুর্নামেন্ট সেরা হয়ে টোকিও অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার টিকেট কাটেন জাজা। ফাইনালে লেবাননের মারিয়ানা সাহাকিয়ানকে ৪-৩ ব্যবধানে হারিয়ে সিরিয়ার প্রথম টেবিল টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন জাজা।