Skip to main content
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • কর্পোরেট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
The Business Standard বাংলা

Friday
June 20, 2025

Sign In
Subscribe
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • কর্পোরেট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
FRIDAY, JUNE 20, 2025
‘মানুষ ভবিষ্যতের হর্তাকর্তা হতে চায়, তার একমাত্র কারণই হলো অতীতকে পরিবর্তন করা’ 

ইজেল

সৈয়দ মূসা রেজা
24 July, 2023, 05:30 pm
Last modified: 24 July, 2023, 05:46 pm

Related News

  • মিলান কুন্ডেরার চিঠি, কার্লোস ফুয়েন্তেসের উত্তর
  • আনপড়ের কুন্ডেরা
  • কুন্ডেরাকথা
  • ‘লেখক হওয়া মানে একটি সত্যকে জানা’: মিলান কুন্ডেরা — উদ্ধৃতিতে লেখকের জীবন
  • ৯৪ বছর বয়সে মারা গেলেন প্রখ্যাত লেখক মিলান কুন্দেরা

‘মানুষ ভবিষ্যতের হর্তাকর্তা হতে চায়, তার একমাত্র কারণই হলো অতীতকে পরিবর্তন করা’ 

সৈয়দ মূসা রেজা
24 July, 2023, 05:30 pm
Last modified: 24 July, 2023, 05:46 pm
ছবি: এএফপি

(মিলান কুন্ডেরার সাক্ষাৎকার নেন ক্রিশ্চিয়ানা স্যালমন। এক বসায় গোটা সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়নি। সাক্ষাৎকারে চিরকালীন অনাগ্রহী এ লেখকের সাক্ষাৎকারটি ১৯৮৩ হেমন্তে কয়েক দফা বৈঠকের ফল। প্রকাশিত হয় প্যারিস রিভিউতে। দক্ষিণ প্যারিসের সেইন নদীর বা পাশে মন্তপারনাসের এক অ্যাটিক অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা চিলেকোঠা বাসায় নিজ দপ্তর বসে তার আলাপচারিতা হয়। দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত ঘরের তাকগুলো দর্শন এবং সংগীতবিদ্যার বই দিয়ে ঠাসা। টেবিলের ওপর রয়েছে পুরোনো কালের টাইপরাইটার। বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিকের লেখালেখির ঘরের আদল নয়। বরং একজন ছাত্রের পড়ার ঘর হলে বেশি মানানসই হতো। দেয়ালে ঝুলছে পাশাপাশি দুটো ছবি। একটি তার বাবা; যিনি পিয়ানোশিল্পী ছিলেন। অন্যটি চেক সংগীতকার লিওস জান্যাসেকের। চেক এই সংগীতকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন মিলান কুন্ডেরা। 

ব্যতিক্রমধর্মী লেখকের সাক্ষাৎকারটিও মোটের ওপর গৎ মেনে এগোয়নি। আলাপচারিতা হয়েছে ফরাসি ভাষায়। ব্যবহার করা হয়নি টেপরেকর্ডার। তার বদলে ব্যবহার হয়েছে টাইপরাইটার, কাঁচি এবং আঠা। ধীরে ধীরে অনেক কাটছাঁট আর বাদ দেওয়া কাগজের স্তূপ জমে ওঠে। বেশ কয়েকবার আগাগোড়া খতিয়ে দেখা হয়। তারপর জন্ম নেয় এ সাক্ষাৎকারের লিখিত রূপ। এই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো এখানে—

কুন্ডেরার সে সময় সদ্য প্রকাশিত বই 'দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিং' বের হওয়া মাত্রই হু হু করে বিক্রি হচ্ছিল। হঠাৎ করে খ্যাতির চূড়াবাসী হওয়াকে কেন্দ্র করে অস্বস্তির চোরা কাঁটাতে ভুগছিলেন কুন্ডেরা। 'সাফল্য ভয়াবহ বিপর্যয়। নিজ বসতবাটিতে আগুন ধরে যাওয়ার চেয়েও খারাপ। খ্যাতির দাবাগ্নিতে জ্বলে-পুড়ে যায় আত্মার বসতগৃহ' বলে মন্তব্য করেছেন (ইংরেজ ঔপন্যাসিক, কবি ও ছোটগল্পকার) ম্যালকম লোরি। সে বক্তব্যের সাথে অবশ্যই একমত হয়তো হতেন কুন্ডেরা। নিজ উপন্যাস নিয়ে পত্র-পত্রিকাতে যেসব মন্তব্য প্রকাশিত হচ্ছিল, সে সম্পর্কে ক্রিশ্চিয়ানার প্রশ্নের জবাবে মিলান কুন্ডেরা বলেন, 'আমাকে নিয়ে মাত্রাছাড়া বাড়াবাড়ি হচ্ছে।' অনেক সমালোচকই লেখকের কাজকে কেন্দ্র করে কলম চালান না। বরং খোদ লেখক, তার ব্যক্তিসত্তা, রাজনৈতিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত জীবনের বাক্স-পেটরা হাতড়ানোর প্রবণতা রয়েছে। এমন হীনপ্রবণতাই হয়তো কুন্ডেরাকে নিজ সম্পর্কে মুখ খোলা থেকে যতটা সম্ভব বিরত রেখেছে। 'লে নুভেল অবজারভেতর' বা 'দ্য নিউ অবজারভার'-এ ঔপন্যাসিক এবং গীতিকারের পার্থক্য তুলে ধরেন তিনি একটি বাক্যে। তিনি লিখেছেন, 'নিজেকে নিয়ে বাকচাতুর্য প্রকাশ করতে অনীহাই ঔপন্যাসিক এবং গীতিকারের মধ্যে তফাৎ রচনা করে।' 

নিজেকে নিয়ে কথা বলার অনীহার পর সাহিত্যকর্ম এবং সাহিত্য-বিন্যাস এবং ধরন মনোযোগের কেন্দ্রে উঠে আসে। জমে ওঠে খোদ উপন্যাস নিয়ে কথকতা।

প্রশ্ন: আপনি নিজেই স্বীকার করেছেন আধুনিক সাহিত্যের অন্য লেখকদের চেয়ে ভিয়েনিজ ঔপন্যাসিক রবার্ট মুসিল এবং হারমান ব্রকের কাছাকাছিই রয়েছেন। ব্রক মনে করতেন, যেমনটি আপনিও মনে করেন যে মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের কাল ফুরিয়ে গেছে। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন, এর বদলে 'বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক' উপন্যাসের যুগ এসেছে। ('বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক' বা 'পলিহিস্ট্রিক্যাল' বলতে এমন উপন্যাসকে বোঝায়, যা একমাত্র বিষয়ধারা বা বিষয়ভিত্তিক গণ্ডি-আবদ্ধ নয়। বরং বিভিন্ন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। এই উপন্যাস যা সময় বা স্থানের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে না। বরং মানুষের অভিজ্ঞতার বিভিন্ন দিক অনুসন্ধান করে।) 

মিলান কুন্ডেরা : মুসিল এবং ব্রক উপন্যাসকে ব্যাপক দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন। উপন্যাসকে সর্বোচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক সংশ্লেষণ হিসেবে দেখেছেন তারা। বিশ্বাস করতেন, উপন্যাসের রয়েছে কৃত্রিম শক্তিমত্তা, যার জোরে একাধারে কবিতা, কল্পগাথা, দর্শন, শ্লীলতা লঙ্ঘনকারী এবং প্রবন্ধের মতো সব ধারাকে এক করতে পারে। আরও বিশ্বাস করতেন, উপন্যাসই মানুষের ভরসার শেষ ভূমি, যেখানে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্বজগৎকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। উপন্যাসই কেবল বলতে পারে এমন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করেছেন তারা। ব্রক মনে করেন, জীবনের অর্থ অনুধাবনে, বাস্তবতার প্রকৃতি নির্ণয়ে এবং মানবিক অভিজ্ঞতাকে উপলব্ধিতে সহায়তা করে উপন্যাস। তিনি একে অস্তিত্বের প্রতি ঔপন্যাসিক জ্ঞান হিসেবে বর্ণনা করেন। 

প্রশ্ন: দ্য নিউ অবজারভার সাময়িকীতে দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। এতে ফরাসি পাঠকেরা ব্রককে নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন। একাধারে আপনি ব্রকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন, আবার তাকে সমালোচনাও করছেন। প্রবন্ধটির সমাপ্তি বাক্যে আপনি বলেন, 'সব মহৎ কাজই (কারণ, তা মহৎ বলেই) আংশিক অসম্পূর্ণ।' 

কুন্ডেরা: ব্রক আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন। তিনি আমাদের নতুন শিল্পবিন্যাস বা ফর্মের সম্ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন। তার কাজ অসম্পূর্ণ, কিন্তু এটি এখনো আমাদের শিল্পের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সাহায্য করেছে, যা মৌল বা মূলক, জটিল এবং আনন্দপূর্ণ। তার অসমাপ্ত কাজের মধ্য দিয়ে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে আমাদের নতুন শিল্পবিন্যাসের প্রয়োজন রয়েছে। এই বিন্যাসের মধ্যে পড়ছে, (১) আধুনিক জীবনের জটিলতাগুলো স্পষ্টতর করে দেখানোর স্বার্থেই গুরুত্ব নেই এমন সবকিছুকে সরিয়ে ফেলা, (২) দর্শন, গল্প এবং স্বপ্নকে একত্র করার জন্য 'ঔপন্যাসিক সুরমিশ্রণ বা নভেলিস্টিক কাউন্টারপয়েন্ট' ব্যবহার করা; (৩) একটি উপন্যাসসুলভ প্রবন্ধকে ব্যবহার করা, যা আনন্দপূর্ণ এবং সবকিছু উত্তর তার ভান্ডারে আছে বলে দাবি করে না। (ওপন্যাসিক সুরমিশ্রণ বা নভেলিস্টিক কাউন্টারপয়েন্ট বলতে অনেকগুলো গল্পধারাকে একত্রে মিশ্রণ বোঝানো হয়েছে। এ মিশ্রণের মধ্য দিয়ে একে অন্যের প্রতিধ্বনি এবং বক্তব্য প্রকাশ করবে। এ শব্দগুচ্ছ সংগীতের জগৎ থেকে ধার করা হয়েছে।)

প্রশ্ন: এই তিন বিষয়ই আপনার গোটা শৈল্পিক কর্মসূচিকে ধারণ করেছে বলে মনে হচ্ছে। 

কুন্ডেরা: মনুষ্য জীবনের বিচিত্র দিকগুলো উপন্যাসে প্রকাশ করার জন্য নিজ ধারণাকে সংক্ষেপে উপস্থাপনে দক্ষ হতে হবে। নাহলে উপন্যাসের বিস্তার বাড়বে এবং মূল লক্ষ্য থেকে সরে যাবে। দীর্ঘ অসম্পূর্ণ উপন্যাস যেন সুবিশাল এক দুর্গ, যা একনজরে দেখা সম্ভব নয়। কিংবা এক যন্ত্রসংগীতের আসর, যা চলছে ৯ ঘণ্টা ধরে। একটি উপন্যাস কত বড় হতে পারে, তার সীমা থাকা দরকার। উপন্যাস শেষ করার পর যেন সূচনার কথা পাঠক মনে করতে পারেন। যদি তা না হয়, তবে উপন্যাসের কলেবর এতই বিশাল যে 'স্থাপত্যগত স্বচ্ছতা'কে হারিয়েছে। 

প্রশ্ন: আপনার 'দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং' সাত পরিচ্ছদে বিভক্ত। যদি প্রতি পরিচ্ছেদকে নিয়ে আরও সরাসরি লেখা হতো, তাহলে আপনি সাতটি আলাদা আলাদা উপন্যাস লিখতে পারতেন। 

কুন্ডেরা: সাতটি স্বতন্ত্র উপন্যাস লিখলে সবচেয়ে গুরুত্বের বিষয়ই হারিয়ে যেত। আমি হয়তো 'আধুনিক বিশ্বজগতে মনুষ্য অস্তিত্বের জটিলতা'ই তুলে ধরতে পারতাম না। পরোক্ষে বলা বা সংক্ষেপে বলার শৈলী আবশ্যিক। এ শৈলী থাকলে একজন লেখক কোনো কিছুর কেন্দ্রে চলে যেতে পারেন। এ শৈলীকে চেক সংগীতকার লিওস জান্যাচেকের কাজের সাথে তুলনা করা চলে। সংগীতকে এর নানা প্রয়োজনীয় উপাদান থেকে মুক্ত করেছিলেন তিনি। এটি ছিল এক বিপ্লবাত্মক ঘটনা। উপন্যাসকে অপ্রয়োজনীয় শৈলী বা লিপিকৌশল এবং শব্দ-ব্যঞ্জনামুক্ত হওয়া উচিত। এর বদলে মানুষের অভিজ্ঞানের অপরিহার্য উপাদানগুলোর দিকে মনঃসংযোগ করা উচিত। 

সংগীতকাররা মৌলিক ভাবনা ছাড়াই কেবল ব্যাকরণ অনুসরণ করে সংগীত রচনা করতে সক্ষম হতেন। জান্যাচেক সংগীতকারদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক বা মাথার 'কম্পিউটার'কে ধসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। উপন্যাসগুলোও 'প্রযুক্তি' এবং বিধিবিধান বা নিয়মের অনুগমনে জর্জর হয়ে লেখকের কাজ করে। আমার উদ্দেশ্য উপন্যাসগুলোকে ঔপন্যাসিক কৌশল এবং শব্দ-ব্যঞ্জনার স্বয়ংক্রিয়তা থেকে মুক্তি দেওয়া। 

প্রশ্ন: ঔপন্যাসিক কেন উপন্যাসে নিজ দর্শন সরাসরি বা পরোক্ষে প্রকাশের অধিকার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইবেন?

কুন্ডেরা: কারণ, ঔপন্যাসিকের কোনো দর্শন নেই। অনেকেই চেখভ, কাফকা বা মুসিলের দর্শনের কথা বলে থাকেন। কিন্তু তাদের লেখালেখিতে একখণ্ড সুসঙ্গত দর্শন বের করে দেখান তো! উপন্যাস রচনা করেন যেসব দার্শনিক, তারা ছদ্ম ঔপন্যাসিক ছাড়া আর কিছুই নন। উপন্যাসের রূপ-কাঠামোর মধ্য দিয়ে নিজ চিন্তাধারা চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন মাত্র। 'এককভাবে যা উপন্যাস আবিষ্কার করতে পারে', তা ভলতেয়ার বা কামু কখনোই করতে পারেননি। 

একমাত্র ব্যতিক্রম 'জ্যাক লে ফ্যাটালিস্ট' উপন্যাসের লেখক দিদেরো। এই উপন্যাসে নিজ দার্শনিক ধারণাগুলোকে কৌতুকপূর্ণ লিখনশৈলীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন দিদেরো। ফল হয়েছে, এমন এক উপন্যাস যা একাধারে মজার এবং চিন্তাকে উসকে দিতে সক্ষম। 

ফ্রান্সে এ উপন্যাস তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। ফরাসিরা কাজের চিন্তাধারাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তারা দার্শনিক চিন্তাধারা নিয়ে পড়তে চায় বটে কিন্তু এমন উপন্যাস পড়তে চায় না, যা কৌতুক এবং হাস্যরসে ভরপুর।

এ সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, তার লেখার যে ধারা তৈরি করেছেন, তা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখনো সে কাজে সফলতা আসেনি। 

অতীত-বর্তমান নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে মিলান কুন্ডেরা তার বইয়ে বলেন, আমি সব সময় এ কথাগুলো পছন্দ করি, ভবিষ্যৎ নিশ্চিত, শুধু অতীতই অপ্রত্যাশিত। 

ভালো ভবিষ্যৎ তৈরি করতে চায় বলে মানুষ সব সময় চিৎকার-চেঁচামেচি করে। এটা সত্য নয়, ভবিষ্যত হলো একটি উদাসীন শূন্যতায় ভরপুর, যার কারোর প্রতি কোনোই আগ্রহ নেই। অতীত জীবনে পরিপূর্ণ, আমাদের বিরক্ত করতে, উত্তেজিত করতে এবং অপমান করতে, ধ্বংস করতে বা নতুন করে রংচং লাগাতে প্রলুব্ধ করতে আগ্রহী। মানুষ ভবিষ্যতের হর্তাকর্তা হতে চায়, তার একমাত্র কারণই হলো অতীতকে পরিবর্তন করা।

২. 
এদিকে ১৯৮৫-এর মে মাসে প্যারিসে মিলান কুন্ডেরার সাক্ষাৎকার নেন নিউইয়র্ক টাইমসের ওলেগা কারলিসলি। সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে কারলিসলি বলেন, ১৯৬০-এর দশকে লাতিন আমেরিকার জন্য গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, ১৯৭০-এর দশকে রাশিয়ার জন্য আলেকজান্ডার সোলঝিনিৎসিন যা করেছেন, ১৯৮০-এর দশকে চেকের জন্য সে কাজই সম্পন্ন করেন মিলান কুন্ডেরা। তৎকালীন পূর্ব ইউরোপকে পশ্চিমের পাঠক জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরেন তিনি। এতটাই গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এ কাজ করেছেন, তার আবেদন বিশ্বজনীন হয়ে গেছে। তিনি সত্য এবং অন্তর্মুখী স্বাধীনতার আহ্বান জানান। এ ছাড়া সত্যের পরিচয় উন্মোচন করা সম্ভব নয়। সত্যের এমন অন্বেষণে আমাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তার লেখার এই ভাবধারাই তাকে সমালোচকদের কাছ থেকে প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে। সাক্ষাৎকারে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লেখক হওয়া মানে সত্যপক্ষের প্রচারণা চালানো নয়। বরং সত্যকে তালাশ করে বের করা। 

১৯৮০ সালে দশকে প্রকাশিত তার 'দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং'-এ আধুনিক কালে সংস্কৃতির মৃত্যুর বিষয়কে তুলে ধরেন। 

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্যারিসই হয়েছে মিলানের স্থায়ী ঠিকানা। নিজ ভূমি থেকে উৎখাত হলে উদ্দীপনা হারান লেখক। এমন প্রচলিত কথাকে ভুল বলে প্রমাণ করেন মিলান। বইয়ের পর বই লেখেন। এর মধ্য দিয়ে যৌবন দিনের চেকোস্লোভাকিয়ার বিশদ চিত্র, কিংবদন্তিতুল্য প্রতিরূপ এবং কামোত্তেজক ভূমি হিসেবে ফুটিয়ে তোলেন দেশটিকে। 

ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় তার অনাপস কঠোর মনোভাব তার সাফল্যের প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছে। কিংবদন্তির নির্মাতারা এবং রহস্য সৃষ্টির হোতারা কখনোই নিজ প্রকৃতি উন্মোচনে সম্মত হন না। 

ওলেগা কারলিসলিকেও সাক্ষাৎকার স্বভাবসুলভ দোনোমোনো করেছেন তিনি। নিজ স্বদেশভূমিতে সোভিয়েত আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন না বলে বন্ধুরা আগেভাগেই সতর্ক করেছিলেন কারলিসলিকে। এবারে হুঁশিয়ারিকে পাত্তা না দিয়েই মরিয়া হয়ে তখন নিজ রুশ পরিচয় তুলে ধরেন কারলিসলি। তার দাদা ছিলেন রাশিয়ার খ্যাতিমান নাট্যকার নিলনয়েড আদ্রিইয়েভ—এ পরিচয় দেওয়ায় কাজ হলো। তরুণ বয়সে তার নাটক পড়েছেন এবং ভালো লেগেছে বলে জানান মিলান কুন্ডেরা। সাক্ষাৎকারের তারিখ দেন। পরে আবার চিঠি লিখে কারলিসলিকে জানান যে নিজ সম্পর্কে কথা বলতে তার তীব্র অনীহা রয়েছে। এটি হয়তো রোগের পর্যায়েই পড়ে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে লেখক অসহায়। এ প্রসঙ্গ দিয়ে যদি সাহিত্য নিয়ে আলাপচারিতা করতে চান, তবে সাক্ষাৎকার দিতে দ্বিধা নেই। 

প্রশ্ন: ৪৬ বছর থেকে আপনি ফ্রান্সে বসবাস করছেন। নিজেকে অভিবাসী, ফরাসি, চেক বা সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রহীন ইউরোপীয় মনে হয়?

কুন্ডেরা: ১৯৩০-এর দশকে জার্মান বুদ্ধিজীবীরা যখন স্বদেশভূমি ছেড়ে আমেরিকার পথে পাড়ি জমান, তারা নিশ্চিত ছিলেন একদিন ফিরে আসবেন নিজ দেশের মাটিতে। বিদেশে অবস্থানের সময়টা নেহাত সাময়িক বলেই মনে করতেন তারা। অন্যদিকে আমার স্বদেশে ফেরার কোনো আশাই নেই। চূড়ান্তভাবে ফ্রান্সেই থাকতে হবে। কাজেই আমি আর অভিবাসী নই। ফ্রান্স এখন আমার সত্যিকার স্বদেশভূমি। 

এ ছাড়া নিজ ভূমি থেকে উৎখাত হয়েছি—সে রকম কোনো বোধও নেই। হাজার বছর ধরে চেকোস্লোভাকিয়া পশ্চিমের অংশ ছিল। এখন এটি পূর্বের সাম্রাজ্যের অংশ। প্যারিসের বদলে প্রাগেই আমি অনেক বেশি বাস্তুচ্যুত বা বাস্তুহারা বলে অনুভব করেছি। 

প্রশ্ন: কিন্তু এখনো আপনি চেক ভাষায়ই লেখেন?

কুন্ডেরা: রচনা বা নিবন্ধ ফরাসি ভাষায় আর উপন্যাস চেক ভাষায় লিখি। কারণ, আমার জীবন অভিজ্ঞতা এবং আমার কল্পনার শেকড় গেঁথে আছে প্রাগের বোহেমিয়াতে। 

প্রশ্ন: আপনার অনেক আগেই 'মিলোস ফোরম্যান দ্য ফায়ারম্যানস বল'-এর মতো চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চেকোস্লোভাকিয়াকে পশ্চিমের ব্যাপক মানুষের গোচরে নিয়ে এসেছেন। 

কুন্ডেরা: প্রাগের চেতনা বলতে আমি যা বোঝাই, মিলোস এবং অন্য চেক চলচ্চিত্রকার আইভান পাসের এবং জানা নেমি, তাকে সত্যিই পুনরুজ্জীবন করেছেন। মিলোস যখন প্যারিসে পা রাখলেন, সবাই বেশ হতবাক বনে গেলেন। এমন খ্যাতনামা এক চলচ্চিত্রকারের কোনো নাক-উঁচু ভাবই নেই, তা কীভাবে হতে পারে? প্যারিসের (শত বছরের প্রাচীন বিপণিকেন্দ্র) গ্যালারি লাফায়েতের একজন সেলসগার্লও সেখানে স্বাভাবিক আচরণ কাকে বলে জানেন না। ফোরম্যানের সরল আচরণ একধরনের উসকানি হয়ে উঠল।

প্রশ্ন: প্রাগের চেতনা বলতে আপনি কী বোঝাতে চেয়েছেন?

কুন্ডেরা: কাফকার 'দ্য ক্যাসেল' এবং জারোস্লাভ হাসকের 'দ্য গুড সোলজার শোইক' সেই চেতনায় পরিপূর্ণ। বাস্তবের এক অসাধারণ অনুভূতি। সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে দেখা এক অসাধারণ বাস্তবতা। এই গল্পগুলো ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবশেন করে, ইতিহাসের আভাস দেয়, যা নিচ থেকে সাদামাটা মানুষের চোখ দিয়ে দেখা। 

এসব কাজগুলো যথার্থই সহজ অথচ গভীর শৈলীর সাথে চিন্তাধারাকেও উসকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। জীবনের বিমূর্ত বা অযৌক্তিক পর্বগুলো লেখার উজ্জ্বল প্রতিভা রয়েছে লেখকদের। পাকা হাতে হতাশাবাদের অসীম বিষয়কে রসিকতার সঙ্গে মিশেল দিয়ে স্বতন্ত্র এক পরিবেশ তৈরি করেন। এ শৈলী তাদের গোটা লেখাজুড়েই রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চেক অভিবাসী ভিসা চাইছেন। কর্মকর্তা জানতে চাইলেন, কোথায় যেতে চান? জবাবে মানুষটি বলল, কোথায় এটা কোনো ব্যাপারই না। কর্মকর্তা তাকে একটা ভূগোলক দিয়ে বলল, পছন্দ করে জানাও। 

মানুষটি অনেকক্ষণ ধরে গোলকটি আস্তে আস্তে ঘোরালেন। তারপর বললেন, আপনাদের কাছে আর কোনো ভূগোলক নেই?

প্রশ্ন: প্রাগে আপনার শেকড় পোঁতা আছে। এ ছাড়া সাহিত্যবিষয়ক আর কোন ভালোবাসা আপনার লেখার জগৎকে তৈরি করেছে?

কুন্ডেরা: প্রথমত, ফরাসি ঔপন্যাসিক রাবেলাইস ও দিদেরো। আমার মনোজগতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা, ফরাসি সাহিত্যের রাজা রাবেলাইস। এবং দিদেরোর 'জ্যাক লে ফাটালিস্ট' রাবেলাইসের চেতনাকে ১৮ শতকে নিয়ে যান। দিদেরো একজন দার্শনিক—এ সত্য ভোলা যাবে না। এই উপন্যাসটিকে দার্শনিক-আত্মিক আলোচনার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এটা ব্যঙ্গাত্মক নাটক। সর্বকালের মুক্ত উপন্যাস। স্বাধীনতা এখানে উপন্যাসে রূপ নিয়েছে। আমি সম্প্রতি একে নাটক হিসেবে রূপান্তর করেছি। 'জাঁক অ্যান্ড হিজ মাস্টার' হিসেবে ম্যাসাচুসেটের কেমব্রিজে নাটকটি মঞ্চস্থ করেন সুসান সনটাগ। 

প্রশ্ন: আপনার চেতনার অন্যান্য শেকড় কী? 

কুন্ডেরা: আমাদের শতাব্দীর মধ্য ইউরোপীয় উপন্যাস। কাফকা, রবার্ট মুসিল, হারমান ব্রক, উইটোল্ড গোমব্রোভিচ। এই ঔপন্যাসিকেরা আন্দ্রে মারলে যাকে 'লিরিক ইলিউশন' বলে অভিহিত করেছেন, তার প্রতি আশ্চর্যজনকভাবে অবিশ্বাসী। পশ্চিমের ক্রমাবনতি নিয়ে বেদনা প্রকাশ করেছেন। আবেগের ঘন রাগে সে বেদনা প্রকাশ করা হয়নি বরং উপহাসের মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটেছে। সাহিত্যের জগতে আমার অমূল্য উৎসধারা হয়েছে আধুনিক চেক কবিতা। 

আধুনিক চেক কবিতার বিশিষ্ট এক ব্যক্তিত্ব ইয়ারোশ্লাভ সাইফার্ত। আমার ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা। তার কবিতা আমার সৃজনশীলতা বিকাশে অনস্বীকার্য প্রভাব ফেলেছে। নোবেল কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত নানা ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু চেক কবিতার জগৎকে সাইফার্ত দারুণভাবে প্রভাবিত করেছেন। মর্যাদাপূর্ণ নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে তাকে স্বীকৃতি দেওয়ায় আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্প্রদায় তার কাজকে গভীর মর্যাদা দিয়েছে। 

অবশ্য পুরস্কারটি দিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বলা হয়, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত কবির সাথে হাসপাতালে দেখা করে এ পুরস্কার পাওয়ার খবর দেন। কবি সাইফাটত রাষ্ট্রদূতের দিকে অপলক অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, এ বিপুল টাকা দিয়ে এখন আমি কী করব?

প্রশ্ন: রাশিয়ার সাহিত্য নিয়ে এখন আপনি কী ভাবছেন? এখনো দেশটির সাহিত্যকে আপনি অপছন্দ করেন? ১৯৬৮-এর রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে দেশটির সাহিত্য আপনার অপছন্দের হয়ে ওঠে।

কুন্ডেরা: আমি তলস্তয়কে খুব পছন্দ করি। তিনি দস্তয়েভস্কির চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। তলস্তয়ই প্রথম, সম্ভবত, মানুষের আচরণে অযৌক্তিক ভূমিকা উপলব্ধি করেন। মানুষের মূর্খতাবোধ দিয়ে পরিচালিত ভূমিকা, কিন্তু বেশির ভাগই একটি অবচেতন বোধ দিয়ে পরিচালিত মানুষের ক্রিয়াকলাপ; যা একধারে দায়িত্বহীন, অনিয়ন্ত্রিত এবং নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য।

প্রশ্ন: 'বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং'-এ বাবাকে নিয়ে ভালোবাসার ভাষায় কথা বলেছেন।

কুন্ডেরা: আমার বাবা একজন পিয়ানোবাদক ছিলেন। আধুনিক সংগীতের প্রতি তার আবেগ ছিল—স্ট্রাভিনস্কি, বার্টোক, শোয়েনবার্গ, জান্যাসেকের জন্য। শিল্পী হিসেবে লিওস জ্যানাসেকের স্বীকৃতির জন্য তিনি খুব কঠিন সংগ্রাম করেছেন। জ্যানসেক আকর্ষণীয় আধুনিক সুরকার। অতুলনীয়। তাকে শ্রেণিবদ্ধ করা অসম্ভব। দস্তয়েভস্কির উপন্যাস অবলম্বনে শ্রমশিবির কঠোর পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর অপেরা 'ফ্রম দ্য হাউস অফ দ্য ডেড', কাফকার 'দ্য ট্রায়াল' বা পিকাসোর 'গুয়ের্নিকার' মতোই আমাদের শতাব্দীর মহান এবং ভবিষ্যদ্বাণীমূলক কাজ।

এই কঠিন সংগীত আমার বাবা কনসার্ট হলগুলোতে পরিবেশন করেছেন। হলগুলো সে সময় প্রায় খালিই থাকত। স্ট্র্যাভিনস্কির কথা শুনতে অস্বীকার করেছেন এবং চাইকোভস্কি বা মোৎসার্টের প্রশংসায় মেতে উঠেছে, একটি খুদে বালক হিসেবে আমি সে মানুষদের ঘৃণাই করতাম। আধুনিক শিল্পের প্রতি আমার অনুরাগকে ধরে রেখেছি। এটাই আমার বাবার প্রতি আমার বিশ্বস্ততা। কিন্তু আমি তার সংগীতশিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করি। সংগীত পছন্দ করি, সংগীতশিল্পীদের পছন্দ করতাম না আমি। আমি সংগীতশিল্পীদের মাঝে জীবন কাটানোর কথা ভাবতে গেলে বাক্যহারা স্তব্ধ হয়ে যাই।

আমার স্ত্রী এবং আমি যখন চেকোস্লোভাকিয়া ছেড়ে চলে যাই, তখন আমরা সাথে খুব কম বইই নিতে পেরেছি। এগুলোর মধ্যে জন আপডাইকের 'দ্য সেন্টার' ছিল একটি বই, যা আমার মনের গহন গভীরের কিছু স্পর্শ করেছিল—অপমানিত, পরাজিত পিতার জন্য এক বেদনাদায়ক ভালবাসা।

প্রশ্ন: ফ্রান্সে নির্বাচনের আগেভাগে সব রাজনৈতিক দল তাদের পোস্টার লাগায়। সবখানে একই স্লোগানই দেখা যায়। তা হলো সুন্দর ভবিষ্যতের স্লোগান। সব পোস্টারেই হাসিখুশি, খেলায় মেতে ওঠা শিশুদের ছবিও সাথে দেওয়া হয়। 

কুন্ডেরা: দুর্ভাগ্যের বিষয়টি হলো—আমাদের, মানুষের ভবিষ্যৎ মানে শৈশব নয়, বুড়ো বয়স। কোনো সমাজের সত্যিকার মানবিক রূপটি প্রকাশ পায় বুড়োদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে। কিন্তু বুড়ো বয়সে আমরা যে একমাত্র ভবিষ্যতের মুখোমুখি হই, তা কোনো দিন প্রচারণার কোনো পোস্টারে দেখানো হবে না। ডান বা বাম কারো পোস্টারে তার দেখা মিলবে না। 

প্রশ্ন: তাহলে ডান ও বামের মধ্যে তেমন কোনো ঝগড়াঝাঁটি, বিবাদ-বিসংবাদের অস্তিত্ব নেই?

কুন্ডেরা: একনায়কতন্ত্রের সাম্রাজ্যই আমাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। খোমেনি, মাও, স্ট্যালিন—তারা ডান না বাম? একনায়কতন্ত্র ডানও নয়, বামও নয়। এই সাম্রাজ্যের মধ্যে উভয়ই বিলীন হয়ে যাবে। 

আমি কোনো দিনই ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলাম না। কিন্তু স্ট্যালিনের সন্ত্রাসের সময় চেক ক্যাথলিকদের নির্যাতিত হতে দেখে তাদের প্রতি গভীরতম সংহতি অনুভব করি। তাদের সাথে আমার পার্থক্য সৃষ্টি করেছে ঈশ্বরে বিশ্বাস। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা কিসের ভিত্তিতে সংহতি প্রকাশ করছি। প্রাগে তারা সমাজন্ত্রবাদী এবং পুরোহিতদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভ্রাতৃত্বের জন্ম হয়। 

৩. 
কুন্ডেরা সেই সব বিরল সৌভাগ্যবান সাহিত্যিক ব্যক্তিদের অন্যতম, যারা মৃত্যুর আগেই নিজ দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহাসিক বিজয় প্রত্যক্ষ করেছেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তিকে রক্ষার ব্রত নিয়ে কলম ধরেছিলেন। বিষয়টি আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, বিহ্বল হয়ে তাই প্রত্যক্ষ করে গেছেন তিনি। সোভিয়েত গোষ্ঠীর ভিন্নমতাবলম্বী দ্বিতীয় প্রজন্মের লেখকদের অন্যতম কুন্ডেরা। এবং এ শ্রেণির লেখকদের মধ্যে বহুল পঠিতও। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার তার ললাটে জোটেনি। এটা পুরস্কারটির জন্য কলঙ্কের একটি রাজতিলক আঁকা হয়ে থাকল। এমন কথাই বলেন আনহাড ওয়েবসাইটে প্রকাশিত 'মিলান কুন্ডেরাস লাস্ট জোক' শিরোনামের নিবন্ধে ডেভিড স্যামুয়েল। কুন্ডেরার পরলোকগমনের পরে লেখা হয় এ নিবন্ধ। তিনি আরও বলেন, কুন্ডেরার লেখা কেন পাঠককে টানবে, তারও পরিচয়-চিহ্ন এখানেই ফুটে উঠেছে। ভূরাজনৈতিক এবং সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই নোবেল পুরস্কারের রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। খ্যাতিমান লেখক মিলান কুন্ডেরাকে নোবেল কমিটি উপেক্ষা করার কারণ সহজেই বোঝা যায়। প্রথমত রাজনীতিতে কোনো কালেই গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েননি কুন্ডেরা। বরং ব্যক্তিগত আবেগ, আকাক্সক্ষা এবং শখ, ইচ্ছাকে অনুসরণের স্বাধীনতা রক্ষার দৃঢ় বিশ্বাসবোধ থেকে চালিত হয়েছে তার লেখা। রাষ্ট্রের সেবায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যক্তিজীবনের ওপর রাষ্ট্রের উপনিবেশ স্থাপনের তৎপরতায় নিয়োজিত আমলাতান্ত্রিক উদ্যোক্তাদের বিরোধিতায় তিনি তীব্রতা প্রকাশ করেছেন। কুন্ডেরার দৃষ্টিভঙ্গিকে ডান ও বাম উভয় পক্ষের সমালোচকেরা তিরবিদ্ধ করেছেন। তাদের চোখে কুন্ডেরার অবস্থানকে প্রায় অনৈতিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। আরও বিশ্রী হলো, তাকে আগাগোড়া বুর্জোয়ার কাতারে ফেলে দেওয়া। বামদের পছন্দের তালিকায় রয়েছেন চে গুয়েভারার মতো ব্যক্তিত্ব। ডানেরা ঝুঁকেছেন সোলঝিনিৎসি পাঠে। কুন্ডেরা ছিলেন অবিচল। তিনি একা থাকার মৌলিক মানবাধিকারে জোর দিয়েছিলেন। কুন্ডেরা কখনোই নিজেকে রাজনীতির মানুষ হিসেবে দেখেননি। কিংবা দেখেননি নীতিবাদী, উদার, রক্ষণশীল হিসেবে। নিজ লেখা সাড়া জাগানো চিত্রনাট্য হয়ে উঠবে, সে কামনার ছিটেফোঁটার স্পর্শও তার ছিল না। 

তিনি ছিলেন নিপাট ঔপন্যাসিক। নন্দনতত্ত্বের সর্বোচ্চ স্বরূপ হিসেবে তিনি দেখেছেন উপন্যাসকে। তার কাছে উপন্যাস ছিল সৌন্দর্য এবং শিল্প প্রকাশের সবচেয়ে বড় উপায়। তিনি একে শক্তিশালী সৃষ্টি হিসেবে দেখেছেন। এই সৃষ্টি, ব্যক্তির অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তাভাবনাকে ধারণ করে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায়। কুন্ডেরার ভাবনায়, উপন্যাসের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি, প্রজ্ঞা এবং অবস্থান রয়েছে, যা রাজনীতি, ধর্ম, মতাদর্শ, নৈতিক মতবাদ বা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করে। 

উপন্যাসে তার বিশ্বাসকে কেউ কেউ নেহাত সাবেকি কালের বলেও মনে করতে পারেন। 

কুন্ডেরার যুগান্তকারী উপন্যাস 'দ্য জোক' চেক ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে। উপন্যাসে প্রাগের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লুডভিকের গল্প বলা হয়েছে। প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত এক সহপাঠী লুডভিককে উপেক্ষা করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে লুডভিক একটি মশকরা করে। এতে তার গোটা জীবনের মোড় ঘুরে যায়। লুডভিক মারাত্মক পরিণতির মুখে এসে দাঁড়ায়। তার জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। 

ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এল লুডভিককে মশকরা করার দায়ে তলব করা হয় আদর্শবাদে উজ্জীবিত কিন্তু রসিকতা জ্ঞানহীন নেতাদের সামনে। লুডভিক যে মশকরা করেছিল, তাকে আপত্তিকর হিসেবে গণ্য করা হয়। সহপাঠীদের কেউ এ সময়ে তার পক্ষে মুখ খোলার মতো সৎ সাহস দেখায় না। পরিণামে লুডভিককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। সত্যিই এক দুঃখজনক পরিস্থিতি, অসময়ে একটি কৌতুক নিয়ে আসে কী গুরুতর পরিণতি!

কাহিনিকে পরিচিত মনে হচ্ছে? হতেই পারে। এমন ঘটনাবলি অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছি। কমিউনিস্ট শাসনের আওতায় দশকের পর দশক ধরে এমন অনেক গল্পের জন্ম হয়েছে। কিন্তু কুন্ডেরা লুডভিকের পরের পর্বও তুলে ধরেন। 

সফল জীবনের পথ থেকে দুঃখজনকভাবে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয় লুডভিককে। পরবর্তী বছরের পর বছর ধরে তার ক্ষোভ জমতে থাকে। বিশেষ করে জেমেনেক নামের এক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তার উপচে পড়া ক্ষোভ জমে। লুডভিককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়ার জন্য খুবই সক্রিয় ছিল সে। প্রাগে ফিরে এসে জেমেনেকের স্ত্রীর সাথে পরকীয়ায় জড়ায় লুডভিক। কিন্তু এতে কোনো আনন্দ পায় না লুডভিক। বরং জেমেনিকের সাথে বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে এ ঘটনার ইতি টানতে হয়। এর কারণটি হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা মনেই করতে পারে না জেমেনিক। লুডভিক তখন বুঝতে পারে, অতীতের তিক্ততা বয়ে বেড়ানোয় কোনো মানে নেই। বোধ জন্মে, অতীতে যা ঘটেছে, তাকে আর কখনোই ঠিক করা যাবে না। অপরাধী এবং তার অপরাধে শিকার উভয়ই একে অন্যকে ক্ষমা করে দেওয়াটা গভীরভাবে মানবিক। কিন্তু নায়কের জয় এবং খলনায়কের পরাজয়ের ভাবধারায় পুষ্ট মানসিকতার মানুষের কাছে এ কাহিনি তৃপ্তিদায়ক হয়নি। অথচ চেকোস্লোভাকিয়ার তৎকালীন মানুষের জীবনে অন্যায় এবং পরাজয় অতি স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। কুন্ডেরা যে পরিসমাপ্তি টেনেছেন, তা সে সময়ের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। বেঁচে থাকার অংশ হিসেবে মানুষকে তখন কঠোর বাস্তবতাকে মেনে নিতে হতো। 

স্মৃতি এবং ভুলে যাওয়ার ধারণায় আজীবন বিমোহিত থেকেছেন কুন্ডেরা। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে 'দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং' বইটি প্রকাশিত হয়। ভিন্নমতের সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য শ্রেষ্ঠ বই হয়ে ওঠে এটি। এতে সাতটি পরস্পরের সম্পর্কযুক্ত গল্প দিয়ে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগ করে ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়। এই আখ্যানগুলো ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক ঘটনাগুলো ব্যক্তিগত ভুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত। এসবই জাদুবাস্তবতার ইঙ্গিতসহ আধুনিকতাবাদী শৈলীতে পরিবেশিত হয়েছে।

অন্য পুস্তক থেকে এ বইটিকে আলাদা করে তুলেছে আবেগপূর্ণ এবং স্পষ্টভাবে অ-সোভিয়েত যৌন দৃশ্যাবলির সাথে গুরুতর বিশ্ব সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যযুক্ত উপাদানগুলোর নিখুঁত সংমিশ্রণ। ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষার এই সাহসী চিত্রায়ণ ডান এবং বাম উভয় রক্ষণশীল ব্যক্তিদের হতবাক করেছিল।

কুন্ডেরাকে অনুপ্রাণিত করেছিল সে শিল্পভাবনা, তা বাস্তব নয়। ঠিক যেমন মনে রাখা বা ভুলে যাওয়ার গল্পগুলো কূটকাহিনিমালা হয়ে দেখা দিতে পারে। কুন্ডেরার বইগুলো নতুন এক বিশ্ব, আমাদের চলতে সহায়তা করবে। নতুন বিশ্বে পশ্চিমারা পূর্বের বিধিনিষেধাবলিকে আঁকড়ে ধরছে। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এক রসিকতা হয়ে উঠেছে এটি। মজার কিন্তু বিদ্রুপের বলেই একে মনে করতেন কুন্ডেরা।

Related Topics

টপ নিউজ

কুন্দেরা / মিলান কুন্দেরা / মিলান কুন্ডেরা / কুন্ডেরা

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.

MOST VIEWED

  • শিক্ষার্থী ভিসা ফের চালু করল যুক্তরাষ্ট্র, তবে আনলক করা থাকতে হবে সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল
  • যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও ইরানের একটি সরকারকে উৎখাত করেছিল, কী পরিণতি হয়েছিল তার
  • যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে না জড়ানোর অনুরোধ পাকিস্তান সেনাপ্রধানের
  • ইসরায়েলিদের ‘সামরিক ও গোয়েন্দা এলাকা’ এড়িয়ে চলার আহ্বান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
  • ‘দক্ষিণ সিটির মেয়রের মেয়াদ শেষ, শপথ নেওয়ার সুযোগ নেই’: উপদেষ্টা আসিফ
  • সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম গ্রেপ্তার

Related News

  • মিলান কুন্ডেরার চিঠি, কার্লোস ফুয়েন্তেসের উত্তর
  • আনপড়ের কুন্ডেরা
  • কুন্ডেরাকথা
  • ‘লেখক হওয়া মানে একটি সত্যকে জানা’: মিলান কুন্ডেরা — উদ্ধৃতিতে লেখকের জীবন
  • ৯৪ বছর বয়সে মারা গেলেন প্রখ্যাত লেখক মিলান কুন্দেরা

Most Read

1
আন্তর্জাতিক

শিক্ষার্থী ভিসা ফের চালু করল যুক্তরাষ্ট্র, তবে আনলক করা থাকতে হবে সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল

2
আন্তর্জাতিক

যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও ইরানের একটি সরকারকে উৎখাত করেছিল, কী পরিণতি হয়েছিল তার

3
আন্তর্জাতিক

যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে না জড়ানোর অনুরোধ পাকিস্তান সেনাপ্রধানের

4
আন্তর্জাতিক

ইসরায়েলিদের ‘সামরিক ও গোয়েন্দা এলাকা’ এড়িয়ে চলার আহ্বান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

5
বাংলাদেশ

‘দক্ষিণ সিটির মেয়রের মেয়াদ শেষ, শপথ নেওয়ার সুযোগ নেই’: উপদেষ্টা আসিফ

6
বাংলাদেশ

সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম গ্রেপ্তার

EMAIL US
contact@tbsnews.net
FOLLOW US
WHATSAPP
+880 1847416158
The Business Standard
  • About Us
  • Contact us
  • Sitemap
  • Privacy Policy
  • Comment Policy
Copyright © 2025
The Business Standard All rights reserved
Technical Partner: RSI Lab

Contact Us

The Business Standard

Main Office -4/A, Eskaton Garden, Dhaka- 1000

Phone: +8801847 416158 - 59

Send Opinion articles to - oped.tbs@gmail.com

For advertisement- sales@tbsnews.net