লড়াকু পাখি কোড়ার বিদায় চোখের জলে

অনেকদিন আগের কথা। তখন বর্ষাকাল। একজন শিকারি বন্দুক কাঁধে এগিয়ে যাচ্ছিলেন পাট খেতের পাশ দিয়ে। হঠাৎ তার কানে গুরু গম্বীর 'ঢুব ঢুব' শব্দ ভেসে এলো। এটা একটা বিশেষ পাখি। তিনি কাঁধ থেকে একনলা বন্দুকটা নামিয়ে চেম্বারে একটা চার নাম্বার কার্তুজ ভরে ফেললেন। এবার দাঁড়িয়ে থেকে পাখিটার অবস্থান সম্পর্কে ভাবতে লাগলেন। থেমে থেমে ডেকে চলেছে পাখিটা। পাট খেতের উত্তর পাশের আমন ধানখেত থেকে তার ডাক ভেসে আসছে। পাখিটার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য তিনি তিনটি রাস্তা ব্যবহার করতে পারেন। তবে পুব আর পশ্চিম দিক দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, জায়গাটা খোলা প্রান্তর। ওদিক দিয়ে এগিয়ে গেলে সাথে সাথে পাখিটার নজরে পড়ে যাবেন তিনি। তাই শিকারি গুড়ি মেরে এগিয়ে চললেন বুকসমান পাট খেতের ভেতর দিয়ে। এতে একটা বিশেষ সুবিধা রয়েছে-একেবারে ধানখেতের কাছাকাছি না যাওয়া পর্যন্ত পাখিটা কিছুতেই তাকে দেখতে পাবেনা।
এভাবে এগিয়ে যেতে যেতে এক সময় তিনি পাট খেতের ফাঁক দিয়ে আমন ধানখেত দেখতে পেলেন। বন্দুকের হ্যামার টেনে খুব সাবধানে আরও কিছুটা জায়গা পার হয়ে ধানখেতের সীমানার একেবারে কাছে এসে চুপ মেরে বসে পড়লেন। 'ঢুব ঢুব' শব্দটা এখন খুব কাছ থেকে আসছে, ঠিক যেন কানে এসে লাগছে। বন্দুকধারী শিকারিদের কাছে এই পাখির দেহের যে অংশটির অস্তিত্ব সবার আগে ফাঁস হয়ে যায়, তা হচ্ছে মাথার শিরস্ত্রাণের মতো লাল অংশ। তা সহজেই শিকারির চোখে পড়ল। সাথে সাথে তিনি বন্দুক কাঁধে তুলে গুলি করলেন।
গুলির শব্দের ঠিক সঙ্গে সঙ্গে পাটখেত থেকে একটা লোক সোজা পানি ভেঙে ছুটে এলো গুলি খেয়ে পড়ে থাকা পাখির দিকে। শিকারি তখন ভাবছেন লোকটা কি তার শিকার করা পাখি ছিনিয়ে নেবে? লোকটা মৃত পাখির পাশে গিয়ে সেটাকে হাতে তুলে দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে শিকারির মেজাজ তখন চরমে। বন্দুকের ব্যারেল সোজা লোকটার দিকে তাক করে তাকে কাছে আসার জন্য ইঙ্গিত করলেন। লোকটা আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল, যেন শিকারির কথা তার কানেই যায়নি। ধীরে ধীরে তার মৃত পাখি ধরা হাত দুটো চলে এলো বুকের কাছে। তারপর মৃত পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে এসে দাঁড়াল শিকারির সামনে। শিকারির মাথায় তখন চিন্তার ঝড়, কোথাও কোনো ভুল হয়ে গেল না তো? লোকটা কাছে এসে দাঁড়াতেই শিকারি দেখতে পেলেন, তার দুচোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। বিদ্যুৎচমকের মতো শিকারি বুঝে ফেললেন ঘটনাটা।
তিনি যেমন একজন শিকারি, তেমনি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাও একজন পাকা শিকারি। নিজের ভুল বুঝতে পেরে শিকারি এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলেন। নিজের অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলেন বারবার। লোকটা অনেকক্ষণ পর শুধু বলল, 'সর্বনাশ যা হওয়ার হইয়া গেছে এখন ক্ষমা চাইয়া কী হইব?'
শিকারির কষ্ট শিকারিই বোঝে। লোকটাকে বুঝিয়ে কিছুটা শান্ত করলেন তিনি। আলাপ-পরিচয়ে জানা গেল লোকটার বাড়ি পাশের থানা শিবপুরে। নাম তার ছাও মিয়া। পাখিটা তার সন্তানের মতোই প্রিয় ছিল। একজন কৃষকের কাছ থেকে একটা কোদাল নিয়ে শিকারি পাখিটাকে মাটিতে পুঁতে রাখলেন। প্রায় জোর করে ছাও মিয়াকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। তার কাছ থেকে শুনলেন প্রিয় পোষা পাখিটির কাহিনি।
পাখিটির নাম 'কোড়া'-ইংরেজিতে বলা হয় 'ওয়াটার কক'। পোষা কোড়া দিয়ে জংলি কোড়া শিকার দেশের শিকার ঐতিহ্যের একটি অংশ ছিল। এ পদ্ধতিতে শিকারের জন্য প্রথমে কোড়ার বাসা থেকে সদ্য ফোটা বাচ্চা সংগ্রহ করে সেটাকে বড় করে শিকারের কাজে ব্যবহার করা হতো। ছাও মিয়া কিন্তু বাচ্চা সংগ্রহ করেননি, তিনি সংগ্রহ করেছিলেন ডিম। ছোট্ট একটা মাটির কৌটার ভেতর তুলো ভরে, সেই তুলোর উপর ডিম রেখে, ডিমসুদ্ধ কৌটাটা বেঁধে রেখেছিলেন নিজের পেটের সঙ্গে।
ছাও মিয়ার শরীরের উত্তাপে ডিমের ভিতর কোড়ার বাচ্চাটি আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠতে থাকে। অবশেষে ২৩ দিন পর ডিম ফুটে বেরিয়ে এলো কুচকুচে কালো কোড়ার ছানা। ছাও মিয়ার তখন সে কী আনন্দ! এই ২৩ দিন তিনি একবারের জন্যও গোসল করেননি, শুধুমাত্র বাচ্চা জন্মের অপেক্ষায়। তুলতুলে বাচ্চাটাকে তিনি নিজের সন্তানের মতোই বড় করে তুলেছিলেন। আর আদর করে নাম রেখেছিলেন 'আদুরী'। শিকারি অবাক হয়ে যান লোকটার কথা শুনে।
দিনের পর দিন ছাও মিয়া আদুরীর গলার ডাক শোনার অপেক্ষায় থাকতেন। কারণ কোড়া বড় হয়ে যখন ডাকতে শিখে তখনই তাকে শিকারের কাজে ব্যবহার করা হয়।
পুরুষ কোড়া লড়াকু জাতের পাখি। যেকোনো বিল বা হাওরে একাধিক কোড়া থাকতে পারে। কিন্তু ডাকতে পারবে শুধুই একজন, যে সবচেয়ে শক্তিশালী। অন্য কেউ ডেকে উঠলেই শুরু হয়ে যায় ভয়ানক যুদ্ধ। যেমন ধরা যাক, বিলে একটি কোড়া ডাকছে, ঠিক সে সময় অন্য আরেকটি কোড়া এসে একটু দূরে বসে ডাকতে শুরু করল। প্রথম কোড়াটি তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে নতুন পাখিটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কোড়াদের এই লড়াকু স্বভাবের সুযোগ নিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষ পোষা কোড়া দিয়ে বুনো কোড়া শিকার করে আসছে।
নিজেদের পোষা কোড়া ডাকতে শেখার পর তাকে শিকারের কাজে ব্যবহার করা হয়। পোষা কোড়াকে নিয়ে জংলি কোড়া থাকার সম্ভাব্য স্থানে ছেড়ে দেয়া হয়। পোষা কোড়া ডাকতে শুরু করলেই জংলি কোড়া ছুটে এসে তাকে আক্রমণ করে। শুরু হয়ে যায় ভীষণ লড়াই। এই যুদ্ধে দুই কোড়াই ব্যবহার করে থাকে তাদের পায়ের নখ। নরসিংদী আর গাজীপুর অঞ্চলে তাদের পায়ের নখের এই যুদ্ধকে বলা হয় 'চঙ্গল'। চঙ্গলের চরম পর্যায়ে দুই কোড়ার পায়ের নখ পরস্পরের সঙ্গে শক্ত করে আটকে যায়। তখন এরা 'টেক টেক' শব্দে ডাকতে শুরু করে। এই ডাক ওত পেতে থাকা শিকারির কানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে এসে দুটো কোড়াকেই ধরে ফেলে।
আদুরী প্রথম ডাকতে শিখেছিল ৮ মাস বয়সে। পুরোপুরি ডাক শিখতে তার আরো কয়েক মাস লাগল। সে ডাক শেখার পর ছাও মিয়া অপেক্ষা করতে থাকে বর্ষাকালের জন্য। কারণ বর্ষার সময় বিল-হাওরে কোড়া সবচেয়ে বেশি ডাকাডাকি করে থাকে। এজন্য অনেকে এদেরকে বর্ষা ঋতুর পাখি বলে থাকেন।

দেখতে দেখতে বর্ষাকাল এসে গেল। এক সকালে ছাও মিয়া খাঁচাবন্দি আদুরীকে নিয়ে শিকারে বেরিয়ে গেলেন। প্রথম দিনই আদুরী তিনটি বিল থেকে পরপর তিনটি জংলি কোড়াকে পাকড়াও করেছিল। গত তিন বছরে ছাও মিয়া আদুরীর সাহায্যে দেড়শর অধিক জংলি কোড়া শিকার করেছেন। আদুরী ছিল এক দুর্দান্ত শিকারি পাখি। সে কখনো কোনো বুনো কোড়ার কাছে পরাজিত হয়নি। ছাও মিয়া কাছে যাওয়ার আগপর্যন্ত সে কোনো জংলি কোড়াকে চঙ্গলমুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়নি।
বুনো কোড়ার খবর পেয়ে আজ দুপুরে সে এদিকে এসেছিলেন আদুরীকে নিয়ে। আমনের খেতে বুনো কোড়ার অবস্থান টের পেয়ে আদুরীকে খাঁচা থেকে বের করে ধান খেতে ছেড়ে দেন। তারপর পাট খেতে চুপ মেরে বসে থাকেন চঙ্গলের 'টেক টেক' শব্দ শোনার আশায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে চঙ্গলের শব্দের বদলে ছাও মিয়ার কানে ভেসে আসে বন্দুকের গুলির আওয়াজ। মারাত্মক ভুল ঘটে গেছে-আদুরীর ডাক আজ জংলি কোড়ার বদলে ডেকে এনেছে এক বন্দুকধারী শিকারিকে। পাটখেত থেকে বেরিয়ে ধানখেতে পা রাখতেই ছাও মিয়া দেখতে পেলেন আমনের সবুজ বুকে কালো মানিকের মতো মরে পড়ে আছে তার আদরের আদুরী।
সেই সন্ধ্যায় বাড়ির বারান্দায় বসে ছাও মিয়ার পোষা কোড়ার কাহিনি শুনে বন্দুকধারী শিকারিটি রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ২৩ দিন নিজের পেটের উত্তাপ দিয়ে আদুরীকে ডিমের খোলস থেকে পৃথিবীর আলোয় এনেছিলেন মানুষটি। বিষয়টা আসলেই অনেক কষ্টের, বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে ওঠে বন্দুকধারী শিকারির মন। কিন্তু ছাও মিয়া তাকে একবারের জন্যও এ বিষয়ে দোষারোপ করলেন না। এটাকে তিনি আদুরীর নিয়তির লিখন হিসেবে ধরে নিয়েছেন। তবু সন্তানহারা পিতার মতো ডুকরে কেঁদে উঠলেন মানুষটি। তারপর একসময় বিদায় নিয়ে চলে গেলেন নিজ বাড়ির উদ্দেশে।
ছাওমিয়া চলে যাওয়ার পর হারিকেনের আলোয় বন্দুকধারী শিকারির চোখ পড়ল বারান্দার কোনায় রাখা একটা জিনিসের ওপর। আদুরীর শূন্য খাঁচা। ধানখেত থেকে খাঁচাটা সঙ্গে করে এনেছিলেন ছাও মিয়া। তিনি কি ইচ্ছে করেই খাঁচাটা এখানে রেখে গেছেন? শূন্য খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে নিজের ভুলের মাশুল দেওয়ার একটা চিন্তা আসে শিকারির মনে।
একজন লোককে ময়মনসিংহের এক বাজারে পাঠিয়ে একটা শিকারি কোড়া জোগাড় করে আনেন তিনি। তারপর কোড়াটাকে খাঁচায় ভরে এক সকালে গিয়ে হাজির হন ছাওমিয়ার বাড়িতে। খাঁচার দিকে তাকাতেই বৃদ্ধ শিকারির চোখ ছল ছল করে উঠল। তিনি কিছুতেই নতুন কোড়া নিতে চাইলেন না। তবু অনেক অনুনয়-বিনয় করে শিকারিটি খাঁচাসুদ্ধ পাখিটি তার হাতে তুলে দিলেন। খাঁচাটা হাতে নিয়ে তিনি বললেন, 'আমি আর কোনোদিন শিকার করুম না, অনেক পাখি মারছি, তাই এত বড় কষ্ট পাইলাম, আপনিও শিকার ছাইড়া দেন।'
এখন আর আমনের চাষ হয় না, এসেছে হাইব্রিড ইরি ধান। বর্ষা আসে বর্ষা যায়, কিন্তু কোড়ার ডাক আর শুনতে পাওয়া যায় না।