বৃক্ষবন্দনা: অনূদিত বৃক্ষকবিতা

'তোমাকে না কিসের গল্প বলবো বলেছিলাম। গাছের না মানুষের?' এই পঙ্ক্তিগুলো পূর্ণেন্দু পত্রীর। শামসুর রাহমান একটি কবিতা পেতে দয়াবান বৃক্ষের কাছে হাত পাতেন। নজরুল চেনান লিচুগাছ: 'পুকুরের ঐ কাছে না/ লিচুর একগাছ আছে না? হোথা না আস্তে গিয়ে/ এ্যা বড় এক কাস্তে নিয়ে/'। রবীন্দ্রনাথের 'তালগাছ' কবিতা দিয়ে আমাদের অনেকেরই গাছ চেনা শুরু- 'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে/উঁকি মারে আকাশে। বটবৃক্ষ নিয়েও তিনি লিখেছেন গাছ। গাছালির নান্দীপাঠ করবেন বলেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন 'বৃক্ষবন্দনা'। উইলিয়াম শেকসপিয়র লিখেছেন 'আন্ডার দ্য গ্রিনউড ট্রি', গোলাপ গাছ শিরোনামে কবিতা লিখেছেন উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, আপেল গাছ ডরোথি পার্কারের কবিতার শিরোনাম। বিষবৃক্ষ বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস হতে পারে কিন্তু উইলিয়াম ব্ল্যাক একই নামে কবিতা লিখেছেন 'পয়জন ট্রি'। রবার্ট ফ্রষ্টের কবিতার নাম 'ট্রি অ্যাট মাই উইন্ডো', এজরা পাউন্ডের কবিতা 'দ্য ট্রি'; এডওয়ার্ড লিয়ারের ছড়াতে ও ছবিতে 'দেয়ার ওয়াজ অ্যান ওল্ডম্যান ইন অ্যা ট্রি', ওয়াল্ট হুইটঅ্যানের কবিতা 'সঙ অব দ্যা রেডউড ট্রি', 'পাতাও গাছ' এডনা সেইন্ট মিলের কবিতা: 'ক্রিসমাস ট্রি' নিয়ে কে কবিতা লিখেন নি সেটা গবেষণার বিষয় হতে পারে; উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকারে লিখেছেন 'দ্যা মেহগনি ট্রি'। কার্ল স্যাপিরোর কবিতা 'জলপাই গাছ'; 'নিঃসঙ্গ খেজুর গাছের প্রস্ফোটন' স্যামুয়েল টেয়লর কোলরিজের কবিতা; 'পামেলার বাগানের গাছ' নিয়ে লিখেছেন এডউইন আর্লিংটন রবিনসন। সিগফ্রিড সামুনের কবিতা 'বৃক্ষ ও আকাশ'। দিনভর এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
জলপাই হোক কি আখরোট, জাফরান কি যবদানা, কাজুবাদাম কি নাশপাতি, আম কিংবা গন্ধরাজ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন সংস্কৃতিতে তাদের প্রিয় বৃক্ষের বন্দনা করেছেন তাদের শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। রিপ ভ্যান উইঙ্কল একটি বৃক্ষেরই নিচে শুয়ে পড়ে কুড়ি বছর ঘুমিয়েছিলেন। বাংলার লোকগানে 'বটবৃক্ষের ছায়া বন্ধুর ভালোবাসার মতোই', পাবলো নেরুদা স্বপ্নে দেখেন তিনি এবং তার প্রেমিকা পাশাপাশি বৃক্ষের মতো বেড়ে উঠছেন। অজস্র উদাহরণ থেকে মাহমুদ দারবিশ, হাইনেরিখ হাইনে, জালালউদ্দিন রুমি, হাফিজ, নাজিম হিকমত ও নেরুদার একটি করে বৃক্ষকবিতা অনূদিত হলো।

জালালউদ্দিন রুমীর উইজডম ট্রি সিরিজ
জালালউদ্দিন রুমী
বৃক্ষ যদি হাঁটতে পারত
ওহ্, বৃক্ষ যদি হাঁটতে পারত
পায়ে ও ডানায় ভর দিয়ে চলত
তাহলে কুঠারের আঘাতের ভোগান্তি হতো না
কিংবা সইতে হতো না করাতের যন্ত্রণা!
প্রতিটি রাতে সূর্য যদি
হেঁটে চলে না যেত
প্রতিদিন সকালে তাহলে পৃথিবী
কেমন করে আলোকিত হতো?
আর সমুদ্রের পানি যদি
আকাশ পর্যন্ত না উঠত
তাহলে স্রোতধারা ও কোমল বৃষ্টি
কেমন করে গাছের চারা দ্রুত বড় করে তুলত?
যে বিন্দুটি নিজের বাড়ি
সাগর ছেড়ে চলে যায় ফিরে আসে
দেখতে পায় অপেক্ষায় থাকা একটি শামুক
মুক্তো হয়ে গেছে।
ইউসুফ কি তার বাবাকে ছেড়ে যায়নি
বেদনা অশ্রু এবং হতাশায়
এমন একটি যাত্রায় তিনি কি পাননি
রাজত্ব এবং সৌভাগ্য সম্পদ অঢেল?
নবী কি মদিনার মতো দূরের জায়গায়
হিজরত করেন নি বন্ধু?
সেখানে তিনি নতুন রাজত্ব পেয়েছেন
শত জমিন তিনি শাসন করেছেন।
তোমার সাফরে যাবার পায়ের অভাব
তাহলে নিজের ভেতরেই সফর করো
চুনি পাথরের খনির মতো সূর্যরশ্মি
পেয়ে যাবে; তাই ছেপে দাও।
নিজেকে ছাড়িয়ে? এ সফর তোমাকে
নিয়ে যাবে নিজের ভেতর
এ সফরে ধূলি বদলে
খাঁটি স্বর্ণ হয়ে যাবে।

নাজিম হিকমত
আখরোট গাছ
আমার মাথায় মেঘের বুদ্বুদ, আমার ভেতরে বাইরে সাগর
আমি গুলহেন পার্কে একটি আখরোট গাছ
একটি বৃদ্ধ আখরোট গাছ, গ্রন্থি থেকে গ্রন্থি, টুকরো থেকে টুকরো
এটা তুমিও অবহিত নও, পুলিশও জানে না।
আমি গুলহেন পার্কে একটি আখরোট গাছ
আমার পাতাগুলো ক্ষীপ্রগতির পানির ভেতরে মাছের মতো
আমার পাতাগুলো ঊর্ধ্বমুখী, সিল্কের রুমালের মতো
তোলো, মুছে ফেলো, আমার গোলাপ, তোমার চোখের অশ্রু
আমার পাতাগুলো আমার হাত, আমার আছে এক লক্ষ
আমি এক লক্ষ হাত দিয়ে তোমাকে স্পর্শ করি, আমি ইস্তাম্বুলকে ছুঁই
আমার পাতাগুলো আমার চোখ, আমি বিস্ময়ে তাকাই
আমি এক লক্ষ চোখ দিয়ে তোমাকে দেখি, আমি ইস্তাম্বুলকে দেখি
এক লক্ষ হৃদপিন্ডের মতো স্পন্দন হয়, আমার পাতার স্পন্দন
আমি গুলহান পার্কে একটি আখরোট গাছ
এটা তুমিও অবহিত নও, পুলিশও জানে না।

পাবলো নেরুদা
গাছটি এখানেই, এখনো বিশুদ্ধ পাথরে
গাছটি এখানেই এখনো বিশুদ্ধ পাথরে
গভীর সাক্ষ্য, কঠিন সুন্দর
লক্ষ লক্ষ বছরের স্তর থেকে স্তরে
অ্যাগেট, কর্নেলিয়ান, জেমস্টোন
বৃক্ষ ও বৃক্ষরস নির্বাক করে রেখেছে
যতক্ষণ না স্যাঁতস্যাঁতে দুর্নীতি
গাছের গুঁড়িতে প্রবেশ করেছে
সমান্তরাল অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে
জীবন্ত পাতা, নিজেদের ঝরিয়ে দিয়েছে
যখন খুঁটি উল্টে দেওয়া হয়
অরণ্যে আগুন, ধুলির মেঘের দাবদাহ
মহাজাগতিক ভষ্মের আচ্ছাদন ঘিরে ফেলেছে
তখন থেকে সময় ও লাভা, এই উপহার সৃষ্টি করেছে-
আলোকসঞ্চারী প্রস্তর।
হাইনেরিখ হাইনে
তালগাছ
একটি নিঃসঙ্গ ফার বৃক্ষ
উত্তরের পর্বত শিখরে
সাদা কম্বলের নিচে ঘুমোয়
বরফ ও তুষারে ঢাকা।
তার স্বপ্ন তাল গাছের
দূর প্রাচ্যভূমিতে যে কাঁদে
নিঃশব্দে এবং সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ
জ্বলন্ত মরুবালুতে!

হাফিজ
বৃক্ষগৃহ
আলো
কোনো একদিন তোমাকে কেটে খুলে দেবে
এমনকি যদি তোমার জীবন খাঁচাতেও থাকে।
স্বর্গীয় বীজ, নিয়তির মুকুট
লুকোনো এবং উর্বর সমতলে বপণ করা
যার খেতাব তুমি ধরে আছো।
ভালোবাসা নিশ্চয়ই তোমাকে মেলে দেবে বিস্তীর্ণ
শেকলমুক্ত প্রস্ফোটোম্মুখ নতুন ছায়াপথ
এমনকি যদিও তোমার মন এখন বিনষ্ট খচ্চর।
জীবন দান করা উজ্জলতা চলে আসবে
বন্ধুর পারিতোষক এসে যাবে
আবার নিজের দিকে তাকাও
আমি জানি একদিন তুমিই ছিলে সৃষ্টির এতোসব
বিস্ময়ের সম্ভ্রান্ত অতিথিসেবক।
তোমার শরীরের পবিত্র ফাঁটল থেকে
একটি ধনুক জাগে প্রতিটি রাতে
তোমার আত্মা আল্লাহর দিকে নিক্ষেপ করে
দেখ সুন্দর মাতাল একজন গাইছে
ভালোবাসার চন্দ্রশোভন প্রান্ত থেকে
তিনিই মহাবিশ্বের যা কিছু চালাচ্ছেন
আরন্যক উৎসব বৃক্ষগৃহে একটি অঙ্গে
তোমার হৃদপিন্ডে।

মাহমুদ দারবিশ
মারিয়ার স্মৃতি
নিঃশব্দে কুলগাছের নিচে একদিন
নীল চাঁদের সেপ্টেম্বরে
আমি তাকে ধরে রেখেছি, আমার নীরব পান্ডুর ভালোবাসা
আমার বাহুতে, সুন্দর প্রিয় স্বপ্নের মতো
আমাদের উপরে ছিল গ্রীষ্মের আকাশ
একটি মেঘ আমার দৃষ্টিকে টানে
ভীষণ সাদা এবং অনেক উপরে
যখন আমি উপরে তাকাই মেঘ আর সেখানে নেই।
সেই মুহূর্তের পর থেকে অনেক সেপ্টেম্বর
পাল তুলে এলো, স্রোতে ভেসে গেল।
সন্দেহ নেই গাছটি কাঠের জন্য কাটা পড়ে গেছে-
আমার স্বপ্নের কী হলো যদি জিজ্ঞেস করো
আমি বলব: এখন আর স্মরণ করতে পারছি না
যদিও তোমার মনে কী আছে আমি নিশ্চয়ই জানি না।
তবুও তার মুখ সত্যিই আমার মনে পড়ছে না।
আমার শুধু মনে পড়ে বহু বছর আগে চুমো খেয়েছিলাম।
যদি আকাশের সেই সাদা মেঘ না থাকত
চুমোটাও বহু আগে বিস্মৃত হতো
আমি যদি মেঘটাকে চিনতাম, যদি চিনে রাখতে পারতাম চিরদিন
একেবারে বিশুদ্ধ সারা রঙের মেঘ, এতো উঁচুতে।
সম্ভবত কুলগাছ এখনো সেখানে আছে, প্রস্ফুটিত হচ্ছে
সম্ভবত সেই নারীর এখন ছ'জন সন্তান
কিন্তু কেউ সাদা মেঘ মুহূর্তের জন্য বিকশিত হয়েছিল
যখন উপরে তাকালাম নীলের মধ্যে অন্তর্নীল হয়ে গেল।