বাংলায় ঘোড়া আসে কোথা থেকে!

প্রাচীন ভারতের মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত-এ রয়েছে সমুদ্র থেকে ঘোড়ার উত্থানের কাহিনি। এ ছাড়া ঘোড়ার উৎপত্তির আরেকটি পৌরাণিক কল্পকথাও উত্তীর্ণ হয়েছে মহাকালের পরীক্ষায়। সেই কল্পকথা অনুযায়ী, ঘোড়ার আগমন ঘটেছে স্বর্গ হতে। মূলত ভারতীয় সাহিত্যের শালিহোত্রা বা অশ্বশাস্ত্র ঘরানার কিংবদন্তিতে ঘোড়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে আকাশ থেকে নেমে আসা ডানাওয়ালা জন্তু বা পঙ্খীরাজ হিসেবে।
এসব কিংবদন্তির অধিকাংশ সংস্করণে বলা হয়েছে, ঘোড়ার স্বর্গীয় পূর্বপুরুষেরা তাদের ডানা হারিয়েছে শালিহোত্রার হাতে। দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের উপকার করে তাকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে তিনি স্বর্গীয় ঘোড়াদের ডানা ছেঁটে দেন, যাতে করে ওই ঘোড়ারা ইন্দ্রের রথ টানতে এবং তার সৈন্যদলে যোগদান করতে পারে।
এদিকে কিংবদন্তির অন্য আরেক সংস্করণে ঘোড়ারা ছিল পাজি, উচ্ছৃঙ্খল ও বন্য। তাই ইন্দ্র একপর্যায়ে তাদের ওপর যারপরনাই বিরক্ত হয়ে ওঠেন, তাদের ডানা ছিঁড়ে ফেলেন এবং চিরদিনের জন্য তাদের নির্বাসিত করেন মর্ত্যলোকে।
এভাবেই কিংবদন্তিতে ঘোড়ার আগমন ঘটে সমুদ্র ও স্বর্গ দুই জায়গাতেই এবং এভাবেই যেন ইঙ্গিত করা হয় যে এই দুই স্থানের কোনো একটি থেকেই ঘোড়া আবির্ভূত হয়েছে ভারতবর্ষে।
কতটুকু সত্যতা রয়েছে এসব কিংবদন্তি বা উপকথার? ভারতীয় উপমহাদেশের 'বাস্তব' ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ অঞ্চলে অধিকাংশ ঘোড়াই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে, আরব সাগর পাড়ি দিয়ে। এ ছাড়া কিছু কিছু ঘোড়া এসেছে স্থলপথেও, মধ্য এশিয়া থেকে।
তবে ভারতের বিভিন্ন অংশ ঘোড়া আমদানি কিংবা নিজেরাই ঘোড়া উৎপাদন শুরুর আগে, তৎকালীন অতীতে উপমহাদেশে ঘোড়ার অস্তিত্বের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এ অঞ্চল থেকে বন্য ঘোড়ার আদিম বংশধরেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০০ সালের আগেই। টিকে ছিল কেবলই ভারতীয় বন্য গাধা, যাকে উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম ভারতের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ঘুডখুর বা ঘোড় খোর।
পরবর্তী সময়কার ঘোড়ার আগমনের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষায় কথা বলা ইন্দো-আর্যদের, যাদের হাত ধরে বিবর্তিত হয়েছে সংস্কৃত ভাষা। এই ইন্দো-আর্যরা উত্তর ও পশ্চিম থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উপমহাদেশে আসতে থাকে খিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে।
এরও আগে ব্রোঞ্জ যুগ, হরপ্পা কিংবা ইন্দু ভ্যালি সভ্যতায় ঘোড়ার অস্তিত্বের খুব কমই সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে। হরপ্পার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে পাওয়া গেছে অনেক পোড়ামাটির ফলক, যেগুলোতে খোদাই করা রয়েছে হরেক রকমের প্রাণীর আকৃতি। কিন্তু ঘোড়ার কোনো প্রকার চিহ্নই সেগুলোতে ছিল না।
পোড়ামাটির কিছু খেলনা, মূর্তি, দাঁত ও হাড়ের ধ্বংসাবশেষে ঘোড়ার আকৃতি পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু তাতেও এ ধারণার খুব একটা পরিবর্তন ঘটে না যে অন্তত হরপ্পা যুগের শেষ দিকের আগপর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে খুব বেশি ঘোড়া পাওয়া যেত না বা পালন করা হতো না।
তবে এর পরবর্তী সময়কালে ঘোড়ার যেসব নিদর্শন চোখে পড়ে, সেগুলো সম্ভবত ছিল গোড়ার দিককার মাইগ্রেশন অথবা হরপ্পা, মধ্য এশিয়া এবং ইরান/পারস্যের মানুষের একত্র হওয়ার ফলাফল।
উত্তর প্রদেশের সানাউলিতে সাম্প্রতিক খননের ফলে শক্ত চাকাসহ খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৮০০ সালের সময়কার তিনটি রথের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো সম্ভবত ঘোড়া দিয়ে টানা হতো।
এসব নতুন আবিষ্কার ভারতবর্ষে ঘোড়ার ইতিহাসের ওপর নতুন করে আলোকপাত করছে বটে, কিন্তু ভারতীয় ব্রোঞ্জ যুগে ঘোড়ার অস্তিত্বের প্রেক্ষাপট এখনো বিকাশমান অবস্থায় রয়েছে।
ইন্দো-আর্যদের মাধ্যমে অবশ্য গোটা চিত্রটি আরও বেশি পরিষ্কার হয়ে ওঠে, কেননা ঘোড়া ও কাঠের স্পোকের চাকাসহ ঘোড়ায় টানা রথ ছিল তাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যখন ইন্দো-আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে স্থানান্তর শুরু করে, তত দিনে হরপ্পা সভ্যতা পড়তির দিকে। এদিকে ঘোড়া ও রথকে নিজেদের প্রধান বাহন ও যুদ্ধযান হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে ইন্দো-আর্যরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমগ্র উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং নিজেদের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে।
ঘোড়ার ব্যবহারে ব্যাপক অবদানের পাশাপাশি ইন্দো-আর্যদের আরেকটি বিশাল সাফল্য হলো ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদের সমন্বয়ে রচিত বেদ, যেটিকে বিবেচনা করা হয় হিন্দুদের সর্বপ্রাচীন লিপিবদ্ধ গ্রন্থ হিসেবে। এই বেদের মাধ্যমেই সূচনা ঘটে ভারতবর্ষে একের পর এক প্রাচীন গ্রন্থ ও মহাকাব্য সৃষ্টির, যেগুলো প্রথমে মৌখিকভাবে ছড়াত এবং পরবর্তীতে লিখিত আকারে সংরক্ষিত হয়। এভাবেই সৃষ্টি হয় বৈদিক ধর্ম এবং পরবর্তীতে হিন্দুত্ববাদের মূল ভিত্তি।

সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ ঋগ্বেদেও ফুটে ওঠে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে ঘোড়ার গুরুত্ব। এ ব্যাপারটি হয়তো আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আপনাদের অনেকের কাছেই বিস্ময়কর লাগবে যে এখানে ঘোড়ার উল্লেখ ঘটেছে ২১৫ বার, এটা গরুর উল্লেখের চেয়েও ৩৯ বার বেশি।
ঋগ্বেদের শ্লোকে ঘোড়াকে অভিহিত করা হয়েছে বেদিক সমরনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে এবং ঘোড়ায় টানা রথের ধ্রুপদি যুদ্ধ দৃশ্যেরও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এখানে। ঘোড়ার ভূমিকাকে মহিমান্বিত রূপে উপস্থাপিত এ শ্লোক পাঠ করতেন পুরোহিতরা। যোদ্ধারা লড়াইয়ে নামার ঠিক আগে এ শ্লোক পাঠের মাধ্যমে তারা যোদ্ধাদের মাথা স্পর্শ করে আশীর্বাদ করতেন।
এ ছাড়া বৈদিক ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় যজ্ঞ অনুষ্ঠানগুলোর একটি, অশ্বমেধ যজ্ঞ। এ যজ্ঞ বেশ কঠিন, যা খুব বীর রাজারাই কেবল করতেন। একটি সুলক্ষণযুক্ত তেজি ঘোড়া নির্বাচন করা হতো এবং অনেক সৈন্য দিয়ে সেটিকে ছেড়ে দেওয়া হতো। ঘোড়াটি বিভিন্ন রাজ্যের মধ্য দিয়ে যেত। যে রাজ্য সেটির পথ রোধ করত তাদের সাথে যুদ্ধ শুরু হতো। এভাবে সব রাজ্য বীর রাজার বশ্যতা মানলে ঘোড়াটিকে আবার দেশে ফিরিয়ে এনে তাকে দেবতাদের উদ্দেশে বলি দেওয়া হতো। রামায়ণ ও মহাভারত এ যজ্ঞটিকে অমর করে তুলেছে।
ঘোড়াকে বলি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। হয়তো দুজন বলবান পুরুষ ঘোড়াটিকে ধরে রাখত এবং আরেকজন জল্লাদ এসে ঘোড়াটিকে হত্যা করত। অনেক সময় আবার শ্বাসরোধের মাধ্যমেও ঘোড়াটিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হতো।
এ ক্ষেত্রে প্রধান রানীকে একটি উত্তেজনাপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হতো। মৃত ঘোড়ার পাশে একটি আচ্ছাদনের নিচে তাকে শুয়ে থাকতে হতো, যেন তিনি পশুটির সঙ্গে প্রতীকীভাবে একাত্ম হতে পারেন।
বলাই বাহুল্য, ঘোড়াটির পক্ষে জানার কোনো উপায়ই ছিল না যে এমন নির্মমভাবে মৃত্যুবরণের ফলাফলস্বরূপ সে স্বর্গবাসী হবে, দেবতাদের নিকট অনুনয় করবে যেন তারা রাজার ওপর আশীর্বাদ বর্ষণ করেন এবং রাজাকে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দেন।
এই যে ঘোড়াকে পৌরাণিক কাহিনি বা মহাকাব্যের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্রের জায়গা দেওয়া, এটি প্রাচীন ভারতে শুরু হয়েছিল বটে; কিন্তু এর আবেদন পরবর্তী সময়েও এতটুকু ফিকে হয়নি। বরং এ চর্চা ক্রমে বেড়েছে। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছে ঘোড়া। শিল্প-সাহিত্যে ঘোড়ার উপস্থিতি ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একই সমান্তরালে যুদ্ধের অন্যতম প্রধান অস্ত্র হিসেবেও এর কার্যকারিতা হয়েছে আকাশচুম্বী।

সাধারণ যুগের শুরু পর্যন্ত ঘোড়ার রথ ছিল ভারতীয় যুদ্ধক্ষেত্রের মহাগুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু এমন দৃশ্যপটে পরিবর্তন আসে সপ্তম শতকে, যখন সরাসরি ঘোড়ার পিঠে চেপে রণক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়।
অশ্বারোহী যোদ্ধারা ছিল ভারতের প্রথম বড় সাম্রাজ্য, অর্থাৎ মৌর্য সাম্রাজ্যের সমরকৌশলেরও মূল চালিকা শক্তি। খিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শুরুর দিক থেকে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত স্থায়ী হয় এই সাম্রাজ্য।
ভারতীয় উপমহাদেশে ঘোড়ার ইতিহাসের পেছনেও এই সা¤্রাজ্যের সময়কালের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব, কেননা এই সময় থেকেই পরিষ্কার হতে শুরু করে যে ভারতবর্ষের কোন কোন জায়গা ঘোড়ার প্রজনন ও লালন-পালনের জন্য সহায়ক। একই সময়ে দূরের নানা দেশ থেকেও ঘোড়া আমদানি হতে থাকে, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব এমনকি আজকের দিন অবধি বিদ্যমান।
ভারতবর্ষে ঘোড়ার ইতিহাসে আলাদা করে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রয়েছে বাংলাও।
মৌর্যরা তাদের সংগ্রহের সেরা ঘোড়াগুলো নিয়ে আসত উত্তর-পশ্চিম ভারত ছাড়াও অধুনা আফগানিস্তান ও আশপাশের মধ্য এশিয়ার কিছু অঞ্চল থেকে। তুলনামূলক কম খ্যাতিসম্পন্ন ঘোড়াগুলো আসত গুজরাট থেকে।
সাধারণ যুগের প্রথম কয়েক শতকের মধ্যেই, মধ্য এশিয়ান-আফগান ঘোড়াগুলো উত্তর ভারতের ভূখ- পার হয়ে পৌঁছাত বাংলার বন্দরগুলোতে। সেখান থেকে আবার তাদের পাঠানো হতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এ ছাড়া কোহি বা পার্বতী ঘোড়া নামে পরিচিত তিব্বতি ঘোড়াও অনেক আগে থেকেই আমদানি করা হতো বাংলায়।
অর্থাৎ ভারতবর্ষসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাইরে থেকে আমদানিকৃত ঘোড়া পৌঁছে দেওয়ার পথে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিটের ভূমিকা পালন করত বাংলা।
ধারণা করা হয়ে থাকে, মোগল ভারতের তাংঘান ঘোড়াগুলোরও উৎপত্তি ঘটেছে সম্ভবত কোহি জাতের ঘোড়া থেকে। পূর্ব হিমালয়ের সঙ্গে সীমান্তবর্তী বাংলা ও বিহার অঞ্চলে প্রতিপালিত হতো এসব ঘোড়া।
সম্রাট শাহজাহানকে অনেক সময় উপহার হিসেবে এসব ঘোড়া দেওয়া হতো বাংলার পক্ষ থেকে।

তখনদার দিনে উপহার আদান-প্রদানকে খুবই উঁচু দরে মূল্যায়ন করা হতো মোগল দরবারে। এসব উপহার আদান-প্রদানের মাধ্যমে একে অন্যকে সন্তুষ্ট করা, সাহায্য প্রার্থনা, রাজনৈতিক মৈত্রী সৃষ্টি কিংবা কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হতো।
এসব অভিসন্ধিতে সার্থকতা অর্জনে হাতির পাশাপাশি ঘোড়া উপহার দেওয়ার চল ক্রমে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে।
সুতরাং বলা চলে, সপ্তদশ শতকে বাংলার সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিতেও উপহারস্বরূপ অগ্রণী ভূমিকা পালন করত ঘোড়া, যে ভূমিকা আজকের দিনে পালন করে থাকে আম কিংবা ইলিশ!
বিশেষ করে বাংলার টাট্টু ঘোড়াগুলো হতো বহুবর্ণবিশিষ্ট, যে বৈশিষ্ট্য ছিল শাহজাহানের অত্যন্ত পছন্দের। তাই তো একবার জন্মদিনে পুত্র শাহ সুজার কাছ থেকে এমন গোটা কুড়ি টাট্টু ঘোড়া উপহার পেয়েছিলেন তিনি।
সময়ের সাথে সাথে এ অঞ্চলে ঘোড়ার গুরুত্ব এতটাই আকাশচুম্বী হয়ে যায় যে অশ্বপালের প্রধান, অর্থাৎ ঘোড়াদের দেখাশোনার প্রধান দায়িত্বে থাকা পদটি হয়ে ওঠে রাজ দরবারের প্রধান পদসমূহের অন্যতম!
-
সূত্র : দ্য টেল অব দ্য হর্স : আ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া অন হর্সব্যাক (যশস্বিনী চন্দ্র)