যেসব কারণে ইউক্রেনে যুদ্ধ বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার পেটে নির্দয় আঘাত করেছে

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও যুদ্ধ-সংঘাত পীড়িত মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয় জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। বলতে পারেন, ডব্লিউএফপি ২০২১ সালে তাদের অর্ধেকের বেশি সরবরাহ কোন দেশ থেকে কিনেছিল? যদি বলেন ইউক্রেন, তবে আপনিই সঠিক।
বিশ্বের সেই রুটির ঝুড়িখ্যাত অঞ্চলেই যখন যুদ্ধের আগুন, স্বাভাবিকভাবেই তার আঁচে ঝলসে যাচ্ছে খাদ্যের বৈশ্বিক সরবরাহ চক্র ও ত্রাণ সহায়তার নেটওয়ার্ক। পৃথিবীবাসী এ যাতনা মরমে মরমে উপলদ্ধি করছে, সামনে আরও বড় বিপদের প্রমাদ গুণছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইউক্রেন একা নয়, রাশিয়াও খাদ্য উৎপাদনের বৈশ্বিক শক্তিকেন্দ্র। কৃষিপণ্যের এ দুই মহারথির লড়াইয়ে নানান প্রকার দানাদার শস্য- যেমন গমের দাম ভীষণ চড়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে মরিয়া চেষ্টা করেছে ইউরোপের সরকারগুলো, কারণ তারাই রাশিয়া-ইউক্রেনের কৃষিপণ্যের বড় ক্রেতা।
সয়াবিন ও সারের মতো ফসল উৎপাদন ও পশুখাদ্যের মূল উপকরণেরও যোগান দেয় দেশ দুটি। এই মৌলিক খরচগুলি আরও বেড়ে যাবে, এ শঙ্কায় প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে ইউরোপিয় চাষিদের। তবে সঙ্গতি থাকায় ইউরোপ হয়তো ঝঞ্ঝাক্ষুদ্ধ সময়টি পাড়ি দিতে পারবে। পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়বে, সঙ্গে মূল্যও; কিন্তু ভোক্তাদের হয়তো সুপারমার্কেটে পণ্যের খালি তাক দেখতে হবে না। তাছাড়া ধনী পশ্চিমা অর্থনীতিগুলোর কাছে রয়েছে সংগ্রহ উৎস বৈচিত্র্যকরণের সুযোগ।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্যই বিপদের ঘণ্টা সবচেয়ে জোরালো। প্রচণ্ড ক্ষরায় এরমধ্যেই খাদ্য উৎপাদনে পিছিয়ে থাকা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর সংকটই সবচেয়ে আসন্ন। এ অঞ্চলের দরিদ্র দেশগুলোয় রুটির মতো নিত্যপণ্যের দাম মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে যেতে পারে। আর মানুষ অভুক্ত থাকলে, পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারলে—শুরু হবে বিক্ষোভ, আন্দোলনসহ বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধের শীর্ষ চারটি অভিঘাত তুলে ধরতেই এ আয়োজন।
১. মূল্যের বিস্ময়কর ঊর্ধ্বগতি:
গম, ভুট্টা, সূর্যমুখীর তেল, যব ইত্যাদি কৃষিপণ্যে রপ্তানির জায়ান্ট ইউক্রেন। রাশিয়ার আগ্রাসনের পর কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলোয় জাহাজ চলাচল করতে পারছে না, ফলে থমকে গেছে এসব বাণিজ্য। আর সেকারণেই গম ও তেলবীজের দাম রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে, কারণে কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক ট্রেডাররা সরবরাহ বিচ্ছিন্নতা কতদিন থাকবে- তা নিয়ে অনিশ্চিত, তাই বেশি দাম দিয়ে হলেও পণ্য স্টক করছেন।
কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিক্সের সহযোগী অধ্যাপক ওলেগ নিভিয়েভস্কি বলেন, "সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি তখন হবে, যখন এ অঞ্চল থেকে কয়েক বছর কোনো রপ্তানি হবে না।"
খাদ্য সংকট যেন দেখা না দেয়- তা নিয়ে ইউরোপের রাজনীতিকরা সতর্ক; তবুও ইউক্রেনই হলো ইউরোপিয় ইউনিয়নে চতুর্থ বৃহৎ খাদ্য সরবরাহকারী। দেশটিকে ইউরোপের 'সবজি বাগান' বলাও হয়তো ভুল হবে না।
ইইউ নিজস্ব ভুট্টা আমদানির অর্ধেক, গমের এক-পঞ্চমাংশ এবং ভেজিটেবল অয়েল আমদানির এক-চতুর্থাংশ ইউক্রেন থেকে করে।
মহামারি জনিত মূল্যস্ফীতি এবং জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির চাপ ইইউ- এর খাদ্য উৎপাদক ও প্রক্রিয়াকারকরা যুদ্ধের আগেই অনুভব করেছেন। এখন ইউক্রেন ও রাশিয়ার সরবরাহ বন্ধ হওয়া তাদের কাছে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
ইউরোপের ধনী দেশের ক্রেতারা নানান প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে অভ্যস্ত। অথচ উৎসেই খাদ্যের দাম বেড়ে গেলে, প্রক্রিয়াকারকদের জন্য তা সংগ্রহ করার খরচ আরও বেশি হবে। আবার দাম বেশি ধরা হলে, সার্বিক বিক্রিবাট্টা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রমাদ গুণছে তারা।
খরচ কমানোর উপায় নেই বর্তমান বাজারে, ইউরোপের কৃষকরা উচ্চ ফলন ধরে রাখতে চাইলে সারের জন্য তাদের বাড়তি মূল্য দিতেই হবে। কারণ ইইউ তার চাহিদার ৩০ শতাংশ সার রাশিয়া থেকে আমদানি করে। মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞার পর, সারের দাম এরমধ্যেই ১৪২ শতাংশের রকেটগতিতে বেড়েছে গেল বছরের তুলনায়।
ইউক্রেনের রপ্তানি এতটাই সফল ছিল যে, ইইউ কৃষকরা যুদ্ধের আগে তা নিয়ে রীতিমতো অভিযোগ করেছেন। তারা ইউক্রেন ও ব্রাজিলের মতো দেশকে বড় প্রতিযোগী মনে করতেন- যারা কিনা তাদের চেয়ে কম দামে খাদ্যপণ্য বিক্রি করে স্থানীয় বাজার দখল করছে। তাই তাদের বর্তমান বাস্তবতাকে নির্মম পরিহাসই বলা যায়।
দুর্ভিক্ষের ভয়:
খাদ্য বাজারে থাকলেই হয় না, চাই তা কেনার ক্ষমতা। বিশ্বের কোটি কোটি দরিদ্র, সীমিত আয়ের মানুষ এবার দানাদার শস্যের দাম বাড়ায় দুমুঠো অন্নের সন্ধান করতে পারবে না- দেখা দিচ্ছে সেই ভয়।
তাৎক্ষণিক সংকট জোনে আছে, খাদ্যের জন্য ইউক্রেন ও রাশিয়ার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল—মিশর, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, লেবানন ও তুরস্ক। গ্যালপ রিসার্চের তথ্যমতে, আলজেরিয়ার ৪৮ শতাংশ গম আমদানির উৎস ইউক্রেন।
এই দেশগুলোকে এখন অন্য রপ্তানিকারক দেশের দুয়ারে ধর্না দিতে হবে, তাতে বিশ্ববাজারে দামের আগুনের শিখা- আরও বাড়বে বৈ কমবে না।
আসলে যুদ্ধরত দুই দেশ দানাদার শস্য বা সিরিয়াল উৎপাদনের বিশ্বশক্তি। যৌথভাবে বিশ্বের মোট গম রপ্তানির ২৯ শতাংশ তাদেরই অবদান। আর ময়দা, আটা থেকে প্রস্তুত করা রুটিই অনেক দরিদ্র দেশের প্রধান খাদ্য।
পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এরপর রাশিয়া আগের মতো বিপুল পরিমাণে দানাদার শস্য রপ্তানি করবে কিনা- তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কারণ নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়াতেও দারিদ্র্য বাড়বে, বাড়বে অনাহার- রুশ সরকার স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় বাজারে দাম কম রাখতে, রপ্তানি কমাতেই পারে।
শুধু ইউক্রেন ও রাশিয়ার ওপর সরাসরি নির্ভরশীল দেশের কপালই মন্দ, তাও কিন্তু নয়। খাদ্যের বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে দরিদ্রদের জঠরে আঘাত হানবে; বাংলাদেশ থেকে মাদাগাস্কার—খাদ্য নিরাপত্তায় পিছিয়ে থাকা সব দেশ হবে ভুক্তভোগী।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহেই দানাদার শস্যের দাম গড়ে ৫০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান বন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-অর্থনীতির অধ্যাপক মতিন কায়িম। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, আন্তর্জাতিক ট্রেডাররা পর্যাপ্ত গমের যোগান না পেলে, চাল, যব ও অন্যান্য দানাদার শস্য বেশি পরিমাণে কিনে বৈশ্বিক নিত্যপণ্যের দাম একযোগে বাড়িয়ে দেয়।
মূল্যের কারণে আগের মতো বড় পরিসরে সহায়তা দিতেও মুশকিলে পড়বে ত্রাণ সংস্থাগুলো। কারণ, চাহিদার তুলনায় তাদের তহবিল বরাবরই সীমিত।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির যোগাযোগ শাখার প্রধান জর্ডান কক্স বলেন, "আমরা কয়েক মাস আগে থেকে প্রয়োজন অনুসারে খাদ্যপণ্য কেনার পরিকল্পনা করি। একারণে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের কার্যক্রমে মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক ছায়া পড়বে না, তবে এক সময় সে চাপ ঠিকই আসবে। তাছাড়া, পরিবহনের বাড়তি ভাড়া এখনই গুণতে হচ্ছে।"
ইতোমধ্যেই ২০২২ সালকে "সর্বনাশা এক ক্ষুধার বছর" বলে অ্যাখ্যা দিয়েছে ডব্লিউএফপি।
খাদ্য সংকট রাজনৈতিক গোলযোগের সূচনা করবে নিঃসন্দেহে—এর আগে অনেক বিশ্লেষকই দেখিয়েছেন যে, এর ঘাটতিই ছিল এক দশক আগের আরব বসন্তের মূল অনুঘটক।
কায়িম বলেন, রাজনৈতিক দুর্যোগ তৈরিতে খাদ্য সংকটের জুরি মেলা ভার। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনটা হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি, আর মনে হচ্ছে সে প্রক্রিয়া শুরুও হয়েছে।
ইইউ কৃষি কমিশনার জ্যানসুজ উজেইচোস্কি সতর্ক করে বলেছেন, খাদ্য সংকট ইউরোপে শরণার্থীর চাপ বাড়াবে।
কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিক্সের নিভিয়েভস্কি বলছেন, "গ্রীষ্মকালেই খাদ্য নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় পরীক্ষায় পড়বে বিশ্ববাসী। কারণ, ইইউ ও ইউক্রেনের কৃষকরা ঠিক এ সময়ে তাদের বসন্তের ফসল সংগ্রহ করেন। কিন্তু, ইউক্রেনীয় কৃষকদের অনেকেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, অথবা নিজের জমির দখলই হয়তো হারিয়েছেন। সব মিলিয়ে আগামীর আভাস বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। চলতি বসন্তে তারা শস্য বপণ করতে পেরেছেন এমনটাও জোর দিয়ে বলার উপায় নেই।"
৩. সংরক্ষণবাদের উত্থান:
ধরুন আপনি একজন রাজনীতিক। দায়িত্বশীল, গণতান্ত্রিক দেশের নেতা। আপনি চান না আপনার নিজের দেশের মানুষ অনাহারে থাকুক। এজন্য আপনি প্রথমেই কী করবেন? আপনি হয়তো প্রথমেই বন্ধ করবেন খাদ্য রপ্তানি, চোরাচালান রোধে বন্ধ করে দেবেন সীমান্ত। একইসঙ্গে, সরকারিভাবে খাদ্য মজুতদারিও শুরু করতে পারেন।
এ ধরনের মজুতদারি ও বাণিজ্যিক সংরক্ষণবাদের ভয়ই এখন দাবানলের মতো ছড়াচ্ছে। উন্নত দেশগুলো মহামারিকালে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টিকা মজুদ করে, এবার তারা খাদ্যেও একই কাজ করতে পারে।
অবশ্য গত সপ্তাহে জি-৭ জোটের ধনী দেশগুলোর মন্ত্রীরা এক জরুরি বার্তায়, খাদ্য রপ্তানিতে বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ আরোপ না করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
সবাই কিন্তু সে আহবানে কান দিতে নারাজ। এরমধ্যেই দানাদার শস্য রপ্তানি সীমিত রাখার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে হাঙ্গেরি, তবে দেশটি এটি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা নয় বলে দাবি করেছে। যদিও এনিয়ে হাঙ্গেরির কড়া সমালোচনা করেছে ইউরোপিয় কমিশন।
আর্জেন্টিনা, তুরস্ক, সার্বিয়া এবং ইউক্রেন ও রাশিয়াও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বা তার হুমকি দিয়েছে।
বন বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়িম বলছেন, "আজকের দুনিয়ায় সবাই সম্পর্কিত। বড় রপ্তানিকারকরা যদি এমন করে, তাহলে পৃথিবীর বাকি সব দেশকে বিশ্ববাজারে মূল্যের চাপে পিষ্ট হতে হবে। আর সেটা খাদ্য আমদানিকারক দেশের ঘাড়ে মারাত্মক বোঝা।"
এদিকে মার্কিন কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীন কৌশলগত খাদ্য মজুদ বাড়াচ্ছে। বাড়তি মজুদ করে বেইজিং আফ্রিকার খাদ্য আমদানি নির্ভর দেশগুলোর ওপর প্রভাব বৃদ্ধি করবে এমনই অভিযোগ ওয়াশিংটনের। কিন্তু, আফ্রিকার খাদ্য সংকট নিরসনে এ মুহূর্তে আমেরিকার পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ পদক্ষেপের কথাও কিন্তু তারা জানাননি।
৪. সবুজ স্বপ্নের পতন:
ইউক্রেন যুদ্ধের আগে উন্নত বিশ্বের কৃষি ও খামারকে আরও দূষণমুক্ত করার চাপ বেড়েছিল। ইউরোপিয় ইউনিয়নে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পরিবেশবাদীরা কৃষিতে মিথেন ও কার্বন নিঃসরণ কমানোর দাবি তুলেছিলেন। সরকারগুলোও তাতে সায় দেওয়া শুরু করেছিল।
দূষণের একটি বড় উৎস মাংস উৎপাদন বা গবাদি পশুপালন। ইউরোপের খামারের পশুখাদ্য হিসেবে বিপুল পরিমাণ ভুট্টা আসতো ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলি দিয়ে। সেগুলো এখন বন্ধ থাকায় উচ্চমূল্যের পশুখাদ্য কেনার চাপ বাড়ছে ইউরোপের খামারিদের ওপর।
পশুখাদ্য সংকটের মেঘ দেখে শঙ্কিত ইইউ। গবাদিপশু খাতে বিপর্যয়ের ভয় থেকেই স্থগিত রাখতে চাইছে কৃষিকে পরিবেশ বান্ধব করে তোলার নিয়মনীতি।
- সূত্র: পলিটিকো