ইউক্রেন শান্তি চুক্তিতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিলের প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের

ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করতে মিত্রদের সামনে একটি প্রস্তাব পেশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রস্তাবে যুদ্ধ শেষ করার শর্তাবলি ও টেকসই যুদ্ধবিরতির জন্য মস্কোর ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা শিথিলের রূপরেখা রয়েছে।
শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও শান্তি আলোচনায় দ্রুত অগ্রগতি না হলে ট্রাম্প প্রশাসন এ প্রচেষ্টা 'বাদ দিতে' প্রস্তুত বলে ইঙ্গিত দেওয়ার পর এই উদ্যোগ এল। তবে রোমে শুক্রবার দেওয়া এক বক্তব্যে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, তিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে 'আশাবাদী'।
সংশ্লিষ্ট ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার প্যারিসে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনার মূল কাঠামো তুলে ধরা হয়।
এই প্রস্তাব অনুযায়ী, যুদ্ধ কার্যত যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায়ই বন্ধ হবে—অর্থাৎ বর্তমানে রাশিয়ার দখলে থাকা ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলো মস্কোর নিয়ন্ত্রণেই থেকে যাবে। কিয়েভের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছাও বাদ দেওয়া হবে। আলোচনার গোপনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি।
প্যারিসের আলোচনায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের বৈঠকও হয়। পাশাপাশি রুবিওর সঙ্গে ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের আলোচনা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দেন, তারা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ণ যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে চান। ফের আলোচনা করতে মিত্র দেশগুলো আগামী সপ্তাহে লন্ডনে ফের একত্র হবে।
একজন কর্মকর্তা বলেন, এই পরিকল্পনাগুলো নিয়ে কিয়েভের সঙ্গে আরও আলোচনা করতে হবে এবং এগুলোকে চূড়ান্ত সমঝোতা হিসেবে ধরা যাবে না। এছাড়া ইউরোপীয় মিত্ররা রাশিয়ার দখলে থাকা অঞ্চলগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না বলেও জানান তিনি। কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেন, ক্রেমলিন যদি যুদ্ধ বন্ধে রাজি না হয়, তবে আলোচনার কোনো অর্থ নেই। সেইসঙ্গে যেকোনো চুক্তি করার জন্য ইউক্রেনকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রুবিও শুক্রবার বলেন, ইউক্রেনের তরফ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চাওয়া 'অনুচিত কিছু নয়', তবে এখন পর্যন্ত আলোচনা সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্ররা তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে রুবিওর এক ফোনালাপের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এক বিবৃতিতে বলেন, ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের অবসান চায় এবং এখন সব পক্ষকে একটি স্থায়ী ও টেকসই শান্তির রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়েছে।
এই বিষয়ে অবগত এক ব্যক্তি জানান, কিয়েভ ইতিমধ্যেই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে—এবং তাদের অবস্থান হলো, প্রথমে মস্কোকেও যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে হবে, তারপর অন্যান্য বিষয় আলোচনা করা যাবে।
ওই ব্যক্তি বলেন, প্যারিসে ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদের কাজ ছিল সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং শান্তিরক্ষী বাহিনী কীভাবে গঠন হবে, তা নিয়ে আলোচনা করা।
প্যারিসে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোকে ইউরোপীয় কর্মকর্তারা গঠনমূলক ও ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেছেন। আলোচনায় যুদ্ধ শেষ করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানিয়েছে ইউরোপের।
প্যারিস ছাড়ার সময় সাংবাদিকদের রুবিও বলেন, তিনি আশা করেন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি এ সংকট সমাধানে সহায়তা করবে। তবে তিনি এ-ও ইঙ্গিত দেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্য দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
'আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব না,' বলেন রুবিও। 'আমাদের এখনই ঠিক করতে হবে…এটা আদৌ আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সম্ভব কি না। যদি সম্ভব হয়, আমরা আছি। আর যদি সম্ভব না হয়, তাহলে আমাদের সামনে আরও জরুরি কাজ আছে।'
এই প্রস্তাবিত আংশিক যুদ্ধবিরতির আওতায় কৃষ্ণসাগর অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে রাশিয়া তাতে অস্বীকৃতি জানানোর ইউক্রেনীয় শহরগুলোতে বোমা বর্ষণ অব্যাহত রেখেছে। ক্রেমলিন জানিয়েছে, জ্বালানি অবকাঠামোকে ঘিরে যে ৩০ দিনের আংশিক যুদ্ধবিরতি কার্যকর ছিল, তা শুক্রবার শেষ হয়েছে।
প্যারিস বৈঠকে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের যৌথ পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা হয় হয়। দেশ দুটি যুদ্ধোত্তর ইউক্রেনে একটি 'বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরক্ষা বাহিনী' গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী যেন জনবল ও রসদের ঘাটতিতে না পড়ে, তা নিশ্চিত করার জন্য এ উদ্যোগ নিতে চায় তারা।
এছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চলকে রাশিয়ার অধীনে স্বীকৃতি দেওয়ার চিন্তা করছে বলে জানিয়েছেন বিষয়টির সঙ্গে জড়িত কয়েকজন। রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনার অংশ হিসেবেই এ ধরনের ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব আসছে বলে জানা গেছে।
ক্রিমিয়া অঞ্চলটি ২০১৪ সালে রাশিয়া দখল করে নেয়। সেখানে রাশিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হলেও তা আন্তর্জাতিকভাবে অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হয়। অঞ্চল দখলের মাধ্যমে সীমান্ত পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন থাকা সত্ত্বেও এই ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা ওই আইনকেই দুর্বল করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই ক্রিমিয়ার রুশ মালিকানার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে মরিয়া। যদিও এখনো ট্রাম্পের প্রস্তাবিত সমঝোতা নিয়ে পুতিন রাজি হননি।
যুক্তরাষ্ট্র এখনো এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। হোয়াইট হাউজ ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। আলোচনার সঙ্গে যুক্ত একজন মার্কিন কর্মকর্তা ক্রিমিয়া ইস্যুতে কোনো বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
তবে ইউক্রেনের বিস্তৃত অঞ্চল এখনও রাশিয়া দখলে রয়েছে। এমন অবস্থায় মস্কোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া কিয়েভের অনেক মিত্রের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সব সদস্যদেশের সম্মতি ছাড়া সম্ভব নয়।
চলতি সপ্তাহে ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ বলেন, 'পাঁচটি অঞ্চলকে' ঘিরে একটি সার্বিক চুক্তি হবে। তবে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি।
এদিকে রাশিয়া বলছে, যে চুক্তিই হোক না কেন, ২০১৪ সাল থেকে তারা ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল দখলে নিয়েছে—যেমন ক্রিমিয়া উপদ্বীপ এবং জাপোরিঝঝিয়া, খেরসন, লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলের বড় অংশ—এই দখলকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
রাশিয়া দাবি জানিয়েছে, যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে তাদের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। পাশাপাশি যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার দাবিও জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার কিয়েভে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, উইটকফ 'রাশিয়ার কৌশল অনুসরণ করছেন' এবং ট্রাম্পের এই দূতের 'ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড নিয়ে আলোচনা করার কোনো অধিকার নেই, কারণ এই ভূমি আমাদের জনগণের।'
জেলেনস্কি বলেন, 'যুদ্ধবিরতি না হওয়া পর্যন্ত আমরা ভূখণ্ড নিয়ে কোনো আলোচনা করব না। আমরা কখনোই ইউক্রেনের মাটি রাশিয়ার বলে মানব না।'