ইউক্রেনে আতঙ্কিত বাংলাদেশিরা, বাড়িভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছেন

১৯৮৪ সালে পড়াশোনা করতে বাংলাদেশ ছেড়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ইউক্রেনে পাড়ি জমান টাঙ্গাইলের খালেদ হাসান খান।
৬০ বছর বয়সী খালেদ গত ৩৮ বছর ধরে ইউক্রেনে বসবাস করছেন। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি রাজধানী কিয়েভে আছেন। বর্তমানে চার সদস্যের পরিবার নিয়ে তিনি এখানেই থাকছেন।
পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরির পরিবর্তে ব্যবসায় যোগ দেন খালেদ। শহরে তার ছোট একটি কাপড়ের দোকান আছে। কিন্তু দেশে যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেওয়ার পর থেকে ব্যবসা বলতে গেলে বন্ধ।
বুধবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে খালেদ হাসান বলেন, "ইউক্রেনে আসার পর আমি দুটো শহরে থেকেছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর অভিবাসী হিসেবে এখানকার সামাজিক ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনগুলো দেখেছি। দুর্নীতি এখানকার একটি বড় সমস্যা।"
তিনি আরও বলেন, "ইউক্রেনের জনগণ রাশিয়ার হাতে বিভিন্নভাবে শোষিত। কিন্তু ইউক্রেন ও রাশিয়া কোনোদেশের জনগণই যুদ্ধ চায় না।"
খালেদের স্ত্রীও পড়াশোনার জন্য বাংলাদেশ থেকে ইউক্রেনে যান। এখন তাদের দুই সন্তানেরই ইউক্রেনের নাগরিকত্ব আছে।
বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশিসহ সকল অভিবাসী কমিউনিটিই আতঙ্কিত। আমি কিয়েভে বসবাসরত প্রায় ১০০ বাংলাদেশিকে চিনি যারা ছোটখাটো ব্যবসা কিংবা চাকরি করেন। সবাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।"
"আজকাল মানুষ ঘরের বাইরে কম বের হওয়ায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় আমার বিক্রি ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। পর্যাপ্ত বিক্রি কিংবা আয় না থাকায় অধিকাংশ বাংলাদেশিই আর্থিক সংকটে ভুগছেন," বলেন তিনি।
২০০৫ সালে ইউক্রেনের নাগরিকত্ব পান খালেদ হাসান। কোনো প্রশাসনিক জটিলতা না থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে আর্থিক সংকট তার জন্য একটি বড় সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
গত কয়েক মাসে সীমান্তে সেনা মোতায়েনের খবরে ইউক্রেনের মুদ্রার মূল্য হ্রাস পেয়েছে। এনবিসি নিউজের তথ্য অনুসারে, ২৮ জানুয়ারি ইউক্রেনীয় মুদ্রার বিনিময় মূল্য ডলার প্রতি ২৮.৬ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা প্রায় সর্বনিম্ন রেকর্ডের কাছাকাছি।
স্টকহোম ফ্রি ওয়ার্ল্ড ফোরামের জ্যেষ্ঠ ফেলো আন্ডার্স আসলুন্ড বলেন, "বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইউক্রেনীয় বন্ড বিক্রি করে দিচ্ছে। সুদের হারও ২৫ শতাংশের ওপর পৌঁছেছে। ফলে সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ঋণ নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে।"
ইউক্রেনীয় মুদ্রা রিভনিয়ার মূল্য ধরে রাখতে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারকে বিদেশি রিজার্ভে হাত দিয়ে হয়েছে। বর্তমানে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সরকারের কাছে অবস্থার অবনতি না ঘটার জন্য সহায়তা চেয়েছে।
খালেদ জানান, ২০০৮ সাল থেকেই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা স্বচ্ছল নয়। অন্যান্য অভিবাসী কমিউনিটির মতোই তারাও স্বচ্ছল জীবনযাপনে হিমশিম খাচ্ছেন।
অনানুষ্ঠানিক একটি হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে ইউক্রেনে প্রায় ৫০০ বাংলাদেশি বসবাস করছেন।
মঙ্গলবার পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে জারি করা এক জরুরি প্রজ্ঞাপনে বর্তমান পরিস্থিতিতে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার কারণে ইউক্রেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সাময়িকভাবে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রাশিয়া কয়েক দিনের মধ্যে ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলে আক্রমণ চালাতে পারে বলে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সেজন্যই ঢাকা এই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, প্রবাসী বাংলাদেশিরা অন্য কোনো দেশে যেতে না পারলে বাংলাদেশে ফিরতে পারেন।
পোল্যান্ডের বাংলাদেশি মিশন ইউক্রেনে অবস্থানরত প্রবাসীদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়মিত জানানোর অনুরোধ জানিয়েছে। যেখানে বা যখনই তাদের সহায়তার প্রয়োজন পড়ে, তখনই যেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানে পৌঁছাতে পারে।
একইসঙ্গে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাংলাদেশিদের ইউক্রেনে সকল ধরনের ভ্রমণ এড়ানোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
সার্কুলারে আরও বলা হয়েছে, ইউক্রেনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দূতাবাস বাংলাদেশি প্রবাসীদের পরামর্শ দেবে।
তবে যুদ্ধ শুরু না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশিরা ইউক্রেন ছাড়বে না বলে জানিয়েছেন খালেদ হাসান।
"যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের পরিবারসহ অধিকাংশ বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিক ইউক্রেন ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু আমি যতদূর দেখেছি, এখন যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ," বলেন তিনি।
তবে যুদ্ধ না হলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
১৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুসারে, রাশিয়ার সঙ্গে সংকট বাড়লে ইউক্রেন থেকে হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে আসতে পারে বলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ধারণা করছে। পোল্যান্ডের কিছু শহর ইতোমধ্যেই শরণার্থীরা থাকতে পারে এমন জায়গার তালিকা তৈরি করছে। রোমানিয়াও শরণার্থী শিবিরের পরিকল্পনা করছে।
২০১৮ সালে পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের সময় বহু মানুষের ইউক্রেন ছাড়ার নজির আছে।
এদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ইউক্রেনে বসবাসকারী ব্যক্তিরা বাংলাদেশে ফিরতে চান কি না সেটি তাদের ব্যাপার।
তবে ইউক্রেনে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা যদি নিজ দেশে ফেরার পরিকল্পনা করেন তাহলে ইউক্রেনের প্রতিবেশি দেশগুলোর কাছে সহায়তা চাওয়াসহ বাংলাদেশ সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে তিনি নিশ্চয়তা দেন।
"যখনই কোনো দেশ বা অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়, আমরা নাগরিকদের সতর্ক করি ও সাবধানে থাকার পরামর্শ দিই," বলেন তিনি।
২০১৫ সালে ইয়েমেনে যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "ইয়েমেন যখন যুদ্ধবিদ্ধস্ত, তখন অনেক বাঙালি সফলভাবে দেশে ফিরেন। কিন্তু এর আগে আমরা লিবিয়ায় দেখেছি প্রজ্ঞাপন জারির পরেও অনেকে আসেননি। সুতরাং এটি তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে কেউ আসতে চাইলে বাংলাদেশ সহায়তা করবে।"
এদিক ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া এক লাখের বেশি সৈন্য মোতায়েন করেছে। আগামী কয়েকদিনে মধ্যে রাশিয়া হামলা চালাতে পারে বলে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে মস্কো এ ধরনের পরিকল্পনার কথা উড়িয়ে দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো 'হিস্টিরিয়া' আক্রান্ত বলে অভিযোগ করেছে।