‘মহামারিতে দেনায় জর্জর ভারতীয়দের সুরক্ষায় দরকার কার্যকর সরকারি স্বাস্থ্য বিমা’

আগামী কয়েক সপ্তাহে ভারতে কোভিড-১৯ জনিত মৃত্যুর সংখ্যা বর্তমানের দ্বিগুণ হওয়ার অনুমান করা হচ্ছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে বহু মৃতের শবদাহ হচ্ছে মাটিতে গর্ত করে জ্বালানো গণচিতায়। কিন্তু, কারো মৃত্যুতেই তার পরিবারের দুর্ভোগ শেষ হয় না। ইহলোক ত্যাগকারী রোগীর চিকিৎসার বিলের পাহাড় জমতে জমতে এমন আকার নিয়েছে যা শোধ করতে গিয়ে কর্মজীবী অনেক পরিবার অন্তত দুই-তিন প্রজন্মব্যাপী দারিদ্র্যের শিকার হবে। প্রাণঘাতী কোভিড থেকে বাঁচতে ভ্যাকসিন পেতে উদগ্রীব অপেক্ষাকৃত তরুণেরাও, সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে তারা এখন সেজন্য মূল্য দিতেও বাধ্য হচ্ছেন। সব দেখেশুনে বোধ হয়, রাষ্ট্রের মলিন স্বাস্থ্য নিরাপত্তার শেষ বুননটিও যেন ছিন্ন হয়েছে।
মহামারির আগের সাধারণ সময়ে নিজস্ব সঞ্চয় ভেঙ্গে বা বন্ধু ও আত্মীয়দের থেকে ধার করে চিকিৎসার খরচ বহন করতেন ভারতীয়রা। সামর্থ্য থাকাদের সিংহভাগও এর বাইরে ছিলেন না। সমাজের বঞ্চিতদের সরকারি হাসপাতালের বাইরে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ ছিল সীমিত। নিজ খরচে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের ব্যয় বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ। ৬০ শতাংশের বেশি জনসংখ্যার চিকিৎসা খরচ বিমার আওতায় না থাকায়, এমনটা না হওয়ারও কারণ নেই। সরকারি চাকরিজীবীরা নানা রকমের বিমা পরিকল্পনার আওতায় চিকিৎসা ব্যয়ের উদ্বেগ থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পান, কিন্তু, স্বকর্মসংস্থানে জড়িত অন্যদের চিকিৎসা খরচ নিজেদেরই বহন করতে হয়। এভাবে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর ওপর নির্ভরতা তৈরি হওয়ার ফলে খরচও দিনে দিনে বাড়ছে।
সার্বজনীন স্বাস্থ্য বিমা প্রণয়নে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছিল নরেন্দ্র মোদির সরকার, বেশ কয়েকবার তাতে ব্যর্থ হওয়ার পর, দুই বছর আগে তারা একটি ব্যবস্থা ঘোষণা করে। সেই সময় সরকারের পক্ষ থেকে একে 'বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য বিমা পরিকল্পনা' বলে দাবি করা হয়, যার আওতায় আসবে জনসংখ্যার দরিদ্রতম ৪০ শতাংশ।
ভারতের কয়েক দশক পুরোনো স্বাস্থ্য বিমা নীতির একটি উন্নত সংস্করণ হওয়ার কথা ছিল নতুন ব্যবস্থাটির। সরকারের কোষাগার থেকে বার্ষিক বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ ইতঃপূর্বে পরিবারপ্রতি মাত্র একজনের সেবা নেওয়ার যে সীমাবদ্ধতা ছিল, সেটাও অপসারণের লক্ষ্য নেওয়া হয়।
নতুন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত পরিবার পিছু ৫ লাখ রুপি পর্যন্ত অপারেশন খরচ নির্বাহের সুযোগ রাখা হয়। শহর ও গ্রামাঞ্চলের সংজ্ঞায়িত 'বঞ্চিত' শ্রেণির জন্য শিথিল করা হয় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তির পরিধি।
সরকারি বিমা পলিসির এই সংস্কার যুগান্তকারী বলেই মনে হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, এটি স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ কার্যত বৃদ্ধি করেনি। প্রথম কারণ, এর আওতায় যারা সুবিধা পেতে পারেন বা যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন- তাদের শ্রেণিকরণ করা হয় দশ বছর পুরোনো জরিপের ভিত্তিতে, যেখানে রয়েছে সর্বশেষ তথ্যের অভাব। দ্বিতীয়ত, ভারতে চিকিৎসা খাতে ব্যক্তিগত খরচের ৬০ শতাংশই ব্যয় হয় স্বল্পকালীন সেবা ও টেস্টে। এই দিকটি বিমার আওতায় পড়েনি। বিমা নীতিতে বেসরকারি হাসপাতাল নির্ভরতা থাকার কারণেও এর কার্যকারিতা নিয়ে ডিউক গবেষকরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সবশেষে যে বিষয়টি বলা হয়েছে তা হলো; সত্যিকার অর্থেই যদি এর সুবিধা পাওয়ার জন্য নির্ধারিত শ্রেণির সকলের ব্যয় নির্বাহ করা হয়, তাহলে প্রকৃত ব্যয় বার্ষিক বাজেট বরাদ্দকে বহুগুণে ছাড়িয়ে যাবে।
মহামারির ভয়ানক বিস্তারে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবিত একটি দেশে এই মুহূর্তেই দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের চিন্তা করাটাও হয়তো কঠিন। জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে বিমার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য এক লাখ কোটি রুপির একটি তহবিল গঠনের কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় সরকার। গত সপ্তাহে হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, মহামারির সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউ থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যেই এমন পরিকল্পনা খতিয়ে দেখছেন কেন্দ্রীয় নীতি-নির্ধারক মহল। তারপরও বলতে হয়, সকলের জন্য ন্যূনতম সেবা নিশ্চিত করা এবং তার মান বৃদ্ধির এটাই আসল সময়। অধিক গুরুত্ব দিয়ে নীতি-নির্ধারকদের এখনই সে ব্যাপারে তৎপর হতে হবে।
হেলথ ইনস্যুরেন্সের অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে তাইওয়ান। দেশটির কোভিড-১৯ বিরোধী লড়াই গোটা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। যদিও ভারতের প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্য্যার তুলনায় তাইওয়ানের জনসংখ্যা অনেক কম প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ, তবুও তাদের স্বাস্থ্য সেবা খাতের ভিত্তি অনেক দৃঢ়, এবং সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক সুযোগ আছে।
দীর্ঘদিন ধরে তাইওয়ানে বাস করছেন এমন সকলেই দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য বিমার সুবিধা পান। চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও তার থেকে পরামর্শপত্র নেওয়ার ক্ষেত্রেও বিমা গ্রহণকারী যে এককালীন অর্থ শোধ করেন, তার সীমাও অত্যন্ত ন্যায্য, যথাক্রমে; ৭ ও ১৪ ডলার। হাসপাতালে রোগীর থাকার খরচের ক্ষেত্রেও অর্থ পরিশোধের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
তাইওয়ান চিরকাল এমন কার্যকর ব্যবস্থার আওতায় ছিল না, এমনকি ১৯৯৫ সালের আগে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন তাইওয়ানের বাসিন্দার কোনো স্বাস্থ্য বিমাই ছিল না। কিন্তু, তার পরের দশকগুলোয় রপ্তানি বৃদ্ধির নাটকীয় উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বাস্থ্য সেবায় আমূল পরিবর্তন আনে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাটি। এক্ষেত্রে তাইওয়ান এখন যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ, এমনকি জাপানের চাইতেও তারা খুব বেশি পিছিয়ে নেই।
তাইওয়ানের দৃশ্যপট নাটকীয় পরিবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যলয়ের অর্থনীতিবিদ উয়ে রেইনহার্ডট –এর সুপারিশ শুনে 'সিঙ্গেল পেয়ার' ব্যবস্থা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত। স্বাস্থ্য বিমার ক্ষেত্রে সিঙ্গেল পেমেন্ট হলো, বিমা গ্রহীতা সকল নাগরিকের আর্থিক সামর্থ্য যাই হোক না কেন, রাষ্ট্র তাদের সকলের ব্যয় নির্বাহ করবে। সিঙ্গেল পেয়ার' বলতে এখানে রাষ্ট্রকেই বোঝানো হয়েছে। এর মাধ্যমে সামর্থ্য অনুসারে সকল নাগরিকের থেকে বিমার প্রিমিয়াম গ্রহণ করা হলেও, কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তার খরচ যতই হোক, ব্যয় মেটায় সরকারি কোষাগার। এভাবে কার্যকর বিমা প্রণয়ন করলেও কিন্তু খরচ মাত্রাতিরিক্ত বাড়েনি। বরং সেবার স্বচ্ছতা নিশ্চিতে রোগীর মেডিকেল রেকর্ড ইলেকট্রনিক হেলথ কার্ডে সংরক্ষণ করার মতো ডিজিটাল পদ্ধতির সাহায্য নেয় তাইপে। তাইওয়ান সরকার স্বাস্থ্যখাতে মোট জিডিপির মাত্র ৬ শতাংশ ব্যয় করে, যা অন্যান্য ধনী দেশের চাইতে বেশ কম।
সে তুলন্যায় ভারতে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় জিডিপির মাত্র ১.২ শতাংশ। শুধু বেশি সংখ্যক জনসংখ্যাকে সেবার আওতায় আনার উদ্যোগ নিলেই হবে না, রেইনহার্ডট গুরুত্ব দিয়েছেন- সঠিক সেবায়। কিন্তু, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো; ভারতের মাত্র ৯ কোটি নাগরিক নিয়মিত বেতনভোগী, অর্থনীতিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মীর সংখ্যাই বেশি। এদের মধ্যে আবার ৮০ শতাংশ মাসে ২৭০ মার্কিন ডলারের চাইতেও কম আয় করেন। তাদের উপর নির্ভর করে সার্বজনীন সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন সহজ কাজ হবে না নিঃসন্দেহে।
এক্ষেত্রে কার্যকর সমাধান হতে পারে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার পরিধি বিস্তার। লাইসেন্স ভিত্তিক ওষুধ থেকে শুরু করে মেডিকেল পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার। এতে বিমার আওতায় থাকাদের মধ্যে বিতরণের ব্যয়ও কমবে। সরকারি গণস্বাস্থ্য খাতের কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও জনবল বৃদ্ধি থেকেও সহায়তা পাওয়া যাবে। ব্যয় করতে হবে উন্নত অবকাঠামো নির্মাণেও, এসব কাজে বর্তমানের দ্বিগুণ বা জিডিপির ২.৪ শতাংশ ব্যয় করলেও দীর্ঘকাল তার সুফল ভোগ করবে আপামর জনতা।
- লেখকদ্বয়:
- অঞ্জনি ত্রিবেদী - এশিয়ার শিল্প প্রতিষ্ঠান বিষয়ক ব্লুমবার্গে মতামত কলামিস্ট। ইতঃপূর্বে তিনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে যুক্ত ছিলেন।
- অ্যান্ডি মুখার্জি - ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক অ্যান্ডি মুখার্জি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক সেবাখাত নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। ইতোপূর্বে, তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজেও কলাম লিখতেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত