লকডাউন আরোপের আগে কারো সঙ্গেই শলাপরামর্শ করেননি মোদি: বিবিসি'র অনুসন্ধান

এক বছর আগে বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর লকডাউন চালু করার আগে কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় এবং রাজ্যগুলোর সঙ্গে শলাপরামর্শ করেননি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিবিসি প্রতিবেদক জুগাল পুরোহিত এবং অর্জুন পারমার- এর এক অনুসন্ধানে তা প্রকাশ পেয়েছে।
নিজস্ব অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ভারত সরকারের স্বাস্থ্য, অর্থ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো নানান বিভাগের কাছে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় ২৪০টি আবেদন করে বিবিসি। লকডাউনের আগে তাদের সঙ্গে আদৌ পরামর্শ করা হয়েছে কিনা এবং কী পরিমাণ করা হয়েছে- সেটা জানতেই নেওয়া হয় এই উদ্যোগ।
তবে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় পাওয়া সরকারি প্রতিক্রিয়ায়; প্রধান প্রধান সরকারি বিশেষজ্ঞ বা বিভাগের সঙ্গে লকডাউন চালু করার আগে থেকে আলাপ-আলোচনার কোনো প্রমাণই মেলেনি।
সরকারের সব বিভাগের সাড়াও সমানতর ছিল না। যেমন লকডাউন কার্যকরে প্রধান ভূমিকা রাখা ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবিসি'র তথ্য প্রদানের অনুরোধ বারবার নাকচ করে দিয়েছে।
মন্ত্রণালয়টি যুক্তি দেয়, অনুরোধপত্রে যেসব প্রশ্ন ছিল সেগুলোর উত্তর "দেশের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে জড়িত যা রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের জিম্মাদার হিসেবে মন্ত্রণালয় সংরক্ষণ করে। ফলে ভারতীয় অধিকার আইন-২০০৫ এর ৮ নং অনুচ্ছেদের (১)(ক) এবং (ঙ) ধারার আওতায় এমন তথ্য প্রকাশে দায়মুক্তি পেয়েছে মন্ত্রণালয়।"
গুরুত্বপূর্ণ নানা বিভাগের সঙ্গে কেন সময় থাকতে থাকতেই আলোচনা করা হয়নি সেব্যাপারেও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করে বিবিসি। তবে সেই অনুরোধেও সাড়া মেলেনি।
পৃথিবীর সবচেয়ে কড়াকড়ি লকডাউন:
গেল বছরের ২৪ মার্চ করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে ভারতজুড়ে সম্পূর্ণ লকডাউন চালু করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ভারত বেশ আগেই লকডাউন চালুর উদ্যোগ নেয়, তখন পুরো দেশে মোট সংক্রমিত ছিলেন মাত্র ৫১৯ জন। প্রাণহানি ঘটে ৯ জনের। বিশেষজ্ঞরা আশা করেছিলেন, বিপুল জনসংখ্যাকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা গেলে জীবাণু বিস্তারের গতি হ্রাস পাবে আর সেই সুবাদে যে সময় পাওয়া যাবে- তার মধ্যেই করোনা পরীক্ষা এবং সংক্রমণ উৎস শনাক্ত করাসহ আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিদ্যমান স্বাস্থ্য অবকাঠামো প্রস্তুত করা সম্ভব হবে।
টানা ৬৮ দিন ধরে কঠোরভাবে আরোপ করা ওই লকডাউনকে বিশ্বের সবচেয়ে কড়াকড়ি মাত্রার পদক্ষেপ বলে সংজ্ঞায়িত করেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এতে দেশটির দরিদ্ররা চরম বিপর্যয়ের শিকার হন। অনেকেই হারান চাকরি ও স্বকর্মসংস্থানের ছোট ব্যবসা। অনাহারে ও দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফেরার ক্লান্তিতে মারাও যান অনেকে।
এই সময়ে হাসপাতাল, ফার্মেসী আর মুদি দোকান ছাড়া বন্ধ ছিল সকল প্রকার অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গণপরিবহন। আকাশপথে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ভ্রমণও বন্ধ রাখা হয়।
এই অবস্থায় দরিদ্রদের সামনে নেমে আসে চরম সঙ্কট। বিশেষ করে, অপুষ্টিতে ভোগা শিশু এবং গর্ভবতী মায়েরা যারা সরকারি খাদ্য সহায়তার উপর নির্ভর করতো, তাদের জন্য সহায়তা পাওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়ে। স্থগিত ছিল নানান প্রকার রোগের টিকাদান কর্মসূচি। শিশু স্বাস্থ্যের জন্য যা মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে। তবে এখানেই শেষ নয়, গুরুতরা অসুস্থরা এমনকি মুম্বাই ও দিল্লির মতো প্রধান প্রধান শহরেও চিকিৎসা সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অসুবিধায় পড়েন।
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা- অথচ তারাই হলেন ভারতের কর্মী গোষ্ঠীর বড় অংশ। গৃহস্থালি কর্মী থেকে ফুটপাতের ব্যবসায়ী ও নির্মাণ শ্রমিক সকলেই এখাতের কর্মী এবং কর্মসূত্রে নগরবাসী হলেও, তাদের মূল আবাস ভারতের দূরতম গ্রামীণ জনপদে। লকডাউনের কারণে তারা আকস্মিকভাবে বেকার হয়ে পড়েন, কবে থেকে জীবিকা উপার্জন আবার শুরু করতে পারবেন- সেটা নিয়েও ঘোর অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউনের আগে থেকে আলোচনা না করায় স্থানীয় সরকারগুলো পরিযায়ী এসব শ্রমিকদের দলে দলে গ্রামে ফেরার মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাহায্য করার মতো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় লাখ লাখ পরিযায়ী কর্মী হেঁটে বাড়ির পথ ধরেন। পথিমধ্যে দুর্ঘটনা, ক্লান্তি ও ক্ষুধায় তাড়িত হয়ে অনেকেই মারাও যান।
আরেকদিকে অবশ্য মহামারি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের কঠোর লকডাউনের কারণে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বেঁচে গেছে। সেই সুবাদে মিলেছে চিকিৎসা অবকাঠামো ও সক্ষমতা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ঢেলে সাজানোর সময়। তবে গেল বছরের জুলাই থেকে ধীরে ধীরে লকডাউন শিথিল করা মাত্র আক্রান্তের সংখ্যা আবার নতুন উচ্চতা লাভ করতে থাকে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের পর বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ করোনা সংক্রমণ সংখ্যা হলো ভারতের।
সর্বশেষ ১২ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হওয়াসহ ১,৬০,০০০ মৃত্যুর কথা জানিয়েছে দেশটির জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
বৈঠক বা শলা-পরামর্শ হয়নি কিছুই:
জাতীয় লকডাউন ঘোষণার আগেই ৩০টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল স্থানীয়ভাবে লকডাউন চালু করেছিল। এসব লকডাউনের মেয়াদ ছিল ৩১ মার্চ পর্যন্ত।
তবে কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, "জরুরী সতর্কতা বাস্তবায়ন এবং নানাবিধ স্বাস্থ্য সতর্কতার পদক্ষেপ সমন্বয় করার জন্য" জাতীয় লকডাউন ঘোষণা ছিল অপরিহার্য।
কেন্দ্রীয় সরকারের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- নীতি আয়োগ- এর ভাইস চেয়ারম্যান রাজিব কুমার বলেন, "সকলের সঙ্গে পরামর্শ করেই প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত নেন। তাই তিনি হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে দাবি করাটা সঠিক নয়।"

তবে দেশটির জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (এনডিএমএ)- এর কাছে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, মোদির উপস্থিতিতে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বা সেই প্রেক্ষিতে জাতীয় লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো শলাপরামর্শ বা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি।
একই ইঙ্গিত দিয়েছে, দিল্লি, আসাম ও তেলেঙ্গানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়। একইসাথে, পাঞ্জাব, গুজরাট এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর বিবিসি'র অনুরোধে সাড়া দিয়ে বলেছে লকডাউন নিয়ে আগে থেকে আলোচনার কোনো প্রমাণ তাদের হাতে নেই।
সরকারি নীতি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কাজ করা একজন অধিকার কর্মী অঞ্জলি ভারদাওয়াজ বিবিসি'কে বলেন, "আপনারা যে চিত্র আবিষ্কার করেছেন তা মেনে নেওয়া যায় না। ভারতে জানুয়ারির শুরু থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হতে থাকলেও লকডাউন শুরু হতে থাকে ২০ মার্চের পর থেকে। আকস্মিক কোনো বন্যা বা ভূমিকম্পের মতো করে মহামারি দেখা দেয় না। তাই প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণার আগে সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেবেন- এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত।"
হঠাৎ করে লকডাউনে ভারতীয় অর্থনীতিও বিপুল চাপের মধ্যে পড়ে, এমনকি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আকারে সংকোচনে পড়ে দেশটির জিডিপি।

রাজ্য সরকার পর্যায়ের স্থানীয় লকডাউন ব্যবস্থা চললে বরং আরো ভালো ফল পাওয়া যেত বলে মনে করেন দেশটির নির্দলীয় অর্থনীতিবিদ এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এতে বিভিন্ন এলাকার সংক্রমণ পরিস্থিতি বুঝে লকডাউন বিধিনিষেধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো স্থানীয় প্রশাসন। অর্থনীতির ক্ষতি তাতে কম হতো এবং মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনাও ঘটতো কম।
সরকারি নীতি বিশ্লেষক প্রিয়া রঞ্জন দাশ বলেন, "অবশ্যই আরো ভালো পরিকল্পনা করার সুযোগ ছিল। লকডাউনের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয়ভাবে নয়, বরং বিভিন্ন রাজ্য ও তাদের অধীন বিভিন্ন জেলায় সংক্রমণ হার অনুসারে স্থানীয় পর্যায়ে নেওয়া দরকার ছিল। দেশজুড়ে সার্বিক লকডাউনের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কিন্তু, সেই বিবেচনা উপেক্ষা করে যা করা হয়েছে তাতে অতি-শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পড়ে ভারতীয় অর্থনীতির পারফরম্যান্স।"
- সূত্র: বিবিসি