ইউরোপের ত্রাতা মেরকেল কী এবার অবসরে যাচ্ছেন!

অ্যাঞ্জেলা ডরোথিয়া মেরকেল- বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারিত এক বিজ্ঞ রাষ্ট্রপ্রধানের নাম। ১৫ বছর ধরে দক্ষ হাতে সামাল দিচ্ছেন ইউরোপে বিজ্ঞান ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি জার্মানিকে।
মিতভাষী ও জনপ্রিয় এ নারী চ্যান্সেলরকে যেসব রাজনীতিবিদ দুর্বল প্রতিপক্ষ ভেবেছেন তাদের অনেকেই ছিলেন ভিনদেশি পুরুষ রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু, তারা সকলেই ভুল করেছিলেন। দর কষাকষিতে মেরকেলের দক্ষতার প্রমাণ তারা হাতেনাতেই পান। তাদের সকলকেই; 'কত ধানে কত চাল, কত খই বা মুড়ি-মুড়কি' হতে পারে তার হিসাব কড়ায়-গন্ডায় বুঝিয়ে দিয়েছেন মেরকেল।
'মেরকেলকে কখনো ছোট করে দেখ না' বৈশ্বিক কূটনীতিতে তাই কথাটি এখন আপ্তবাক্য হিসেবেই পরিচিত।
বজ্রকঠিন অথচ জাতীয় উন্নতিতে নিবেদিতপ্রাণ এই রাষ্ট্রপ্রধানকে এবার হারাতে পারে জার্মানি। কারণ, চলতি বছরের শেষদিকে পদত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিশ্বের সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রপ্রধান খ্যাত মেরকেল।
নিজ শাসনামলে যুক্তরাজ্যের পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী, চারজন ফরাসী প্রেসিডেন্ট, আটজন ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী এবং জো বাইডেনকে ধরলে চারজন মার্কিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রক্ষা করবেন তিনি। অংশ নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা আর দর কষাকষিতে। খোদ ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো অস্থিরমতি রাজনীতিককেও ঠাণ্ডা মাথায় সামলেছেন মেরকেল।
মহামারী, বিশ্ব অর্থনীতি আর মানবাধিকারের মতো অসংখ্য ইস্যুতে ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, তখন পশ্চিমা বিশ্বের নির্ভরতার স্থল হয়ে উঠেছিলেন মেরকেল। দায়িত্বের সফলতা নিয়ে তার কোনো গৌরব বা আত্মপ্রচারও নেই। মেরকেলের বিদায় তাই শুধু জার্মানি বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নয় বরং বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে কোনো মহীরুহের ছায়া সরে যাওয়ার মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
বিস্ময়কর ট্র্যাক রেকর্ড সত্ত্বেও মেরকেল তার পুরো ক্যারিয়ারে অজস্র চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নিজের কাছেই যেন নিজেকে বারবার প্রমাণ করেছেন।
এই সময়ে অনেক প্রতিপক্ষ তার উপর চাপ সৃষ্টি করে বা তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করেছিল। এদের মধ্যে ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও। মেরকেল কুকুর খুব ভয় পান, তা জেনেশুনেও বৈঠকের সময় একটি স্বাস্থ্যবান ল্যাব্রাডর জাতের কুকুর নিয়ে হাজির হন পুতিন। ডোনাল্ড ট্রাম্প মেরকেলকে 'বোকা' বলে গালি দেন। এমনকি তাকে অপেক্ষায় রেখে ১৫ মিনিট ফোনে খোশগল্প করেছেন প্রাক্তন ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি।
২০০৫ সালে যখন মেরকেল জার্মানির সবচেয়ে বড় পদটিতে অধিষ্ঠিত হন, তখন তার মতো সাধারণ এবং অনভিজ্ঞ কেউ বেশিদিন ক্ষমতায় টিকবেন- সেটা কেউ প্রত্যাশাও করেনি।
তার ক্ষমতায় আরোহণের সংবাদ জার্মানির সবচেয়ে পঠিত দৈনিক- বিল্ড 'মিস জার্মানি' নামের শিরোনাম দিয়ে যেন কৌতুক করে। এমনকি তার নিজ দলেও তাকে ডাকা হতো 'ডাস মেডচেন' বা 'মেয়েটি' বলে।

কিন্তু, পুতিন ছাড়া তাকে তাকে ছোট করে দেখা কোনো রাজনীতিক বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে মেরকেলের মতো প্রাসঙ্গিক থাকতে পারেননি। অন্যেরা এসেছে আর চলেও গেছে, রয়ে যান শুধু মেরকেল। দিনে দিনে তার জনপ্রিয়তা আরো আকাশচুম্বী হয়। অন্যরা হারিয়ে যান বিস্মৃতির গহ্বরে। সেই 'ডাস মেডচেন' এখন 'ডাই মুট্টি' বা জার্মানদের জাতীয় জীবনে মাতৃত্ব আর স্থিতিশীলতার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী জয়েস মুশাবেন বলেন, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিউ) দল থেকে মেরকেলের উত্থানকে একটি অস্থায়ী নেতৃত্ব বলে মনে করা হয়েছিল। আসলে ওই সময়ে দলে তার প্রতিপক্ষ রাজনীতিকরা নানা ধরনের কেলেঙ্কারিতে দুর্নাম কুড়িয়েছেন।তাদের জায়গায় মেরকেল আসলেও অচিরেই কোনো পুরুষ নেতা তার স্থান পূরণ করবেন এমনটাই ভাবা হচ্ছিল। 'কিন্তু, সকলে মেরকেলের শেখার ক্ষমতাকে তুচ্ছ করে দেখেছিল,' পর্যবেক্ষণ মুশাবেনের।
মেরকেল টানা ১৮ বছর শক্ত হাতে দলকে সামলে, ২০১৮ সালে এসে দলীয় নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি দায়িত্ব ছাড়ার পর তার মতো যোগ্য অন্য কাউকে যে সহজে পাওয়া যাবে না, সেই বাস্তবতা অনুধাবন করে সবাই। এমনকি মেরকেলের নিজ পছন্দের উত্তরসূরী অ্যান্নেগ্রেট ক্রাম্প কারেনবাওয়ের টিকেছিলেন মাত্র এক বছরের বেশি সময়। এই সময়ে তিনি দলীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক বিভাজন রোধে রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত সময় কাটান।
চলতি সপ্তাহে মেরকেলের দল আর্মিন ল্যাসচেটকে পরবর্তী নেতা হিসেবে বেছে নেয়। ল্যাসচেট জার্মানির বর্তমান সরকারের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। মেরকেল চলে যাওয়ার পর তিনি আগামী নির্বাচনে দলের চ্যান্সেলর প্রার্থী হয়ে মেরকেলের উদার গণতান্ত্রিক নীতি রক্ষার্থেই লড়বেন। অর্থাৎ, মেরকেল অবসরে থাকলেও তার রাজনৈতিক আদর্শ থাকবে।
মেরকেলের আত্মজীবনীর লেখক এবং সম-সাময়িক রাজনীতি ও লৈঙ্গিক পরিচয় অধ্যয়ন বিষয়ের অধ্যাপক মুশাবেনের মতে, অতীতের বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং চারিত্রিক গুণের নজিরবিহীন যোগসুত্রেই মেরকেলের উত্থান।
"সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জার্মানির এক যাজকের ঘরে জন্ম মেরকেলের। দেখেছেন যুদ্ধ- পরবর্তী জার্মানির চরম দুরাবস্থা এবং সমাজতন্ত্রী শাসনের কঠোর বিধি-নিষেধের দেয়াল। পেশায় ছিলেন কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রির উপর ডক্টরেট করা বিজ্ঞানী। তাই সকল সমস্যাকেই তিনি জটিল গণিতের মতো বিশ্লেষণ করেন," মুশাবেন জানান।
- সূত্র: সিএনএন