দূরদৃষ্টির অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেল বাংলালায়ন

সারা বিশ্বেই ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড সেবার ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। এই ক্ষয়িষ্ণু প্রযুক্তিতে অবাস্তবভাবে বিশাল বিনিয়োগ করে এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে বাংলালায়ন কমিউনিকেশনস লিমিটেডের। এছাড়া এই পতনের জন্য বিশেষজ্ঞরা টেলিকম নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দূরদর্শিতার অভাবকেও আংশিকভাবে দায়ী করেছেন।
বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডারদের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন সানম্যান গ্রুপের এই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ২০০৮ সালে বৈশ্বিক রেটের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি দামে স্পেকট্রাম কিনে ইন্টারনেট ব্যবসায় প্রবেশ করে।
তার প্রায় ১৪ বছর পর বিশেষজ্ঞদের সেই সতর্কবাণী ফলেছে। একে তো মাথার ওপর পাহাড়সম ঋণের বোঝা, তার ওপর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে লাইসেন্স হারিয়েছে কোম্পানিটি।
ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এই বিলুপ্ত কোম্পানিতে করা বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করতে বাংলালায়ন স্পনসরদের খুঁজছে।
টেলিকম ও আইসিটি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাংলালায়নসহ অন্যান্য ওয়াইম্যাক্স অপারেটরদের এই ব্যর্থতা আসলে শুরুতেই নিজেদের করা ভুলের ফল।
সুমন বলেন, 'মোবাইল অপারেটরগুলো এখন যে সেবা দেয়, সেই সেবা দেওয়ার উচ্চাশা নিয়ে লাইসেন্স নিয়েছিল ব্রডব্যান্ড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস বা ওয়াইম্যাক্স অপারেটরগুলো। উচ্চ মূল্যে স্পেকট্রাম এবং লাইসেন্স নিয়েছিল তারা, কিন্তু তা (তাদের আশা) পূরণ হয়নি।'
এছাড়াও চাহিদা অনুযায়ী প্রযুক্তি রূপান্তর করতে বাংলালায়ন ব্যর্থ হয়েছে বলে জানান সুমন। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সাল পর্যন্ত বিটিআরসির কাছে বাংলালায়নের বকেয়া ছিল ২০০ কোটি টাকা।
বিটিআরসি থেকে রেকর্ড ২১৫ কোটি টাকায় ৩৫ মেগাহার্টজ (এমএইচজেড) স্পেকট্রাম কিনেছিল বাংলালায়ন, অথচ বিশ্বব্যাপী এই প্রযুক্তির স্পেকট্রামের সর্বোচ্চ মূল্য ছিল প্রায় ৮০ কোটি টাকা।
ব্যবসা স্থাপন করতে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এই টাকার মধ্যে ১৭১ কোটি টাকা দিয়েছে এবি ব্যাংকের নেতৃত্বাধীন নয়টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক সিন্ডিকেট। এছাড়া কোম্পানিটি বন্ড ইস্যু করে ১৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে।
সে সময় টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি বিশেষজ্ঞরা বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করেছিলেন যে, তৃতীয় প্রজন্মের (৩জি) প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী উঠে যেতে থাকায় এরকম মাত্রাতিরিক্ত বিনিয়োগ কোনো সুফল আনবে না।
কিন্তু ওই সময় ৩জি প্রযুক্তি ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বিস্তৃত না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিল উচ্চগতির ইন্টারনেটের ব্যাপক চাহিদা থাকবে। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা সতর্কবার্তা ও সমালোচনা গ্রাহ্য করেনি।
বিটিআরসির তথ্যানুসারে, চালু হওয়ার পর প্রথম তিন বছরে অপারেটরটি নানা স্তরের মানুষ ও পেশাজীবীদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পায়। এ সময় বাংলালায়নের গ্রাহক সংখ্যা সাড়ে ৩ লাখে পৌঁছায়।
কিন্তু মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো ২০১৩ সালে দেশে ৩জি প্রযুক্তি চালু করার পর বাংলালায়নের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। উপরন্তু সরবরাহকারীরা ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি এ প্রযুক্তির সরঞ্জাম পাচ্ছিল না।
অল্পদিনের মধ্যেই উচ্চাশা নিয়ে শুরু করা উদ্যোগটির অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। অবশেষে নিয়মিত চার্জ ও ফি দিতে না পারায় ২০২১ সালে নিয়ন্ত্রক কমিশন বাংলালায়নের বিডব্লিউএ লাইসেন্স বাতিল করলে প্রতিষ্ঠানটির মৃত্যু ঘটে।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য মেজর (অব.) আব্দুল মান্নানের সঙ্গে ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও এই প্রতিবেদক তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।
সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, বকেয়া আদায়ে বিটিআরসি এখন কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে খেলাপি হওয়া মোট ১৩৯ কোটি টাকা ঋণ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সিন্ডিকেট ঋণদাতাদের প্রধান এবি ব্যাংক বাংলালায়নের বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির জন্য নিলাম আহ্বান করেছে।
চূড়ান্ত পতনের আগে বেঁচে থাকার লড়াই
ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তির মতো ক্ষয়িষ্ণু খাতে বিনিয়োগ করে বাংলালায়নের পতনের জন্য অনেকেই বিটিআরসিকে দায়ী করছেন।
টেলিকম নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান অবশ্য নিজেদের দায় অস্বীকার করে বলেছে, বিনিয়োগের আগে ব্যবসার সম্ভাবনা যাচাই করা উদ্যোক্তার দায়িত্ব। কেউ বিনিয়োগ করলে তাকে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের নয়।
তারপরও ওয়াইম্যাক্স অপারেটরগুলোকে এলটিই (লং-টার্ম ইভালুয়েশন) লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি।
এদিকে ওয়াইম্যাক্স সেবাদাতারা মোবাইল অপারেটরগুলোর সঙ্গেও কাজ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা-ও করতে পারেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিটিআরসির একজন পরিচালক বলেন, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা সেই ঝুঁকি নিয়েই বিনিয়োগ করেন। প্রযুক্তির আধুনিকায়নের ফলে বিনিয়োগের লোকসানের অনেক উদাহরণ রয়েছে বিশ্বে। এটা মেনে নিতে হবে।
তিনটি কোম্পানিকে মোট ১১০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বাংলালায়ন ও কিউবিকে দেওয়া হয়েছিল যথাক্রমে ২৩০০ মেগাহার্টজ ও ২৫০০ মেগাহার্টজ। আর পরবর্তীতে ওলোকে ২৬০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে ৪০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম বরাদ্দ দেওয়া হয়।
অন্যান্য অপারেটরও বিলুপ্ত
বাংলালায়ন কমিউনিকেশনস লিমিটেডের পাশাপাশি কিউবি ব্র্যান্ড নামে সেবা দেওয়ার জন্য বিডব্লিউএ লাইসেন্স পেয়েছিল অগার ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড বাংলাদেশ লিমিটেডও।
২০০৮ সালে কিউবিও ২১৫ কোটি টাকায় ৩৫ মেগাহার্টজ একটি স্পেকট্রাম কিনেছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ লিমিটেড ২০১৩ সালে ওলো নামে এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড ব্র্যান্ড নামে বাজারে প্রবেশ করে।
বিটিআরসি কর্মকর্তারা জানান, এসব কোম্পানিও তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে, বর্তমানে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই।
সূত্র জানায়, 'এরা লাইসেন্সের বিপরীতে নিয়মিত ফি ও চার্জ পরিশোধ করছে না, তাই কমিশন তাদের লাইসেন্স বাতিল করার পদক্ষেপ নেবে।'