জ্বালানিতে ভর্তুকির চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু বরাদ্দ কম

বিশ্ববাজারে বাড়ছে গ্যাসের দাম। এর ফলে বাজেট বরাদ্দের চেয়ে তিনগুণ বেশি ভর্তুকির বোঝা চাপছে সরকারের কাঁধে। এ অবস্থায় শিল্প ও বিদ্যুত খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির চাপ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার কথা ভাবছে সরকার।
গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে অর্থনীতিতে যাতে এর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সেজন্য নিম্ন-আয়ের মানুষ, কৃষক ও কিছু বাছাইকৃত রপ্তানিকারকের জন্য তিনটি আলাদা প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
গত দুই মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একাধিক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
২০২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ও সার খাতে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন হবে। কিন্তু এর বিপরীতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
উদাহরণস্বরূপ, এলএনজি আমদানির ব্যয় মেটাতে ভর্তুকি বাবদ অর্থমন্ত্রণালয়ের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকা চেয়ে জ্বালানি বিভাগ পেয়েছে মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা।
২০২০ সালের অক্টোবরে স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ (মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজির মূল্য ৪ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি থেকে বেড়ে প্রায় ৩০ ডলারে পৌঁছেছে।
এছাড়াও গত নভেম্বরে এলএনজি আমদানি অব্যাহত রাখতে আরও ৯,৩৩১ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ চেয়ে চিঠি পাঠিয়েও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো টাকা পায়নি পেট্রোবাংলা। একটি এলএনজি কার্গো আমদানি করতে খরচ পড়ে ১,৬০০ কোটি টাকারও বেশি।
জ্বালানি খরচ বৃদ্ধিতে ভর্তুকি দিতে হিমশিম খাওয়ায় সরকারকে শিল্প ও বিদ্যুৎখাতে গ্যাসের মূল্য পুনঃনির্ধারণ করে এলএনজি আমদানির অর্থ সংকট সমাধান করার পরামর্শ দিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান।
২০১৯-২০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪৬ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছে। ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ১৫ শতাংশ, শিল্প খাতে ১৬ শতাংশ এবং সার কারখানাগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে ৫ শতাংশ গ্যাস।
জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ৪,০০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে পাওয়া গেছে মাত্র ২০০০ কোটি টাকা।
এই পরিস্থিতিতে এলএনজি কার্গো আমদানি বাবদ টাকা সংস্থানের বিষয়ে অর্থবিভাগের সঙ্গে আলোচনা করার ওপর জোর দিয়েছেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান।
অর্থ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ৩৫,০০০ কোটি টাকা ও সারে ২৫,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন হবে। আর এলএনজিতে ভর্তুকি প্রয়োজন হবে ১০,০০০ কোটি টাকা। বাজেটে বিদ্যুতে ৮,০০০ কোটি টাকা ও সারে ৯,১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রয়েছে। আর এলএনজিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪,০০০ কোটি টাকা।
এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেই কেবল ভর্তুকির চাপ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা।
কিন্তু মহামারিকালে দেশে কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ভর্তুকি তিনগুণ বাড়লেও সারের দাম বাড়াচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সম্মতি দেননি বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক।
তাছাড়া, ভারতে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ৭-৮ রুপি। বাংলাদেশে ইউরিয়ার দাম ১৬ টাকা কেজি। এ অবস্থায় দেশে ইউরিয়ার দাম বাড়ালে ভারত থেকে সার পাচার হয়ে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
গ্যাস-বিদ্যুতের ভর্তুকি বিষয়ে গত ২৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফীক-ই-এলাহী চৌধুরীর সভাপতিত্বে একটি উচ্চ-পর্যায়ের সভা হয়। সেখানে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য নিয়ে কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জ্বালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০২০ সালের অক্টোবরে স্পটমার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির মূল্য ৪ ছিল মার্কিন ডলারের কাছাকাছি, যা গত বছরের একই সময়ে ৩৬ ডলারে পৌঁছায়। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর এটি ছিল ২৯.৫ ডলার।
গত বছর স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২,৭৪০ এমএমসিইউ গ্যাস উত্তোলন হয়, যা এবার কমে নেমেছে ২,৪৫০ এমএমসিইউতে। জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন এলএনজির সরবরাহ ৬০০ এমএসসিইউ। কিন্তু দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪,০০০ এমএমসিইউ।
স্পট মার্কেটে এলএনজির চড়া দামের কারণে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
জ্বালানির সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কমাতে তিনটি প্রণোদনা প্যাকেজের পরিকল্পনা
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে অর্থনীতিতে যাতে এর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেজন্য তিনটি আলাদা প্যাকেজ দেওয়ার কথা ভাবছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ বিভাগ ইতিমধ্যেই সেচের জন্য ডিজেলের ওপর নির্ভরশীল কৃষক এবং ৩০ শতাংশের বেশি দরিদ্র থাকা ৬০ উপজেলার দরিদ্র কর্মহীনদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচির জন্য পৃথক প্রণোদনা প্যাকেজের কাজ শুরু করেছে।
এছাড়াও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য একটি নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে। তবে কাকে এই প্যাকেজের আওতায় আনা হবে, তা ঠিক করা হয়নি। কারণ ইতিমধ্যেই বর্তমানে ছোট-বড় সব ধরনের রপ্তানি খাতের জন্যই প্রণোদনা রয়েছে বলে জানান এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
তাছাড়া কৃষি ও শিল্প উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে কৃষক ও উৎপাদনমুখী রপ্তানিখাতের জন্য প্রণোদনা এবং মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশের বেশি হয়ে গেলে সে প্রভাব থেকে হতদরিদ্রদের রক্ষা করতে ওএমএস চালু করা ও কর্মসৃজন কর্মসূচি চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে।
খাদ্য সচিব মোসাম্মত নাজমুনারা খানম জানান, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ছয় মাস ওএমএস কার্যক্রম চালু রাখতে তারা ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির সভায় ভর্তুকি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে তার প্রভাব মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ে একটি কৌশলপত্র উপস্থাপন করে অর্থবিভাগ। তাতে ভর্তুকি চাপ কমাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম পুনঃনির্ধারণ করার প্রস্তাব এবং গ্রাহকদের উপর এর চূড়ান্ত প্রভাব কমাতে তিনটি উদ্দীপনা প্যাকেজ ঘোষণা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থ বিভাগ সব খাতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব কমাতে এবং দরিদ্রদের মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে রেহাই দিতে কৌশল তৈরি করেছে।
তবে আগে থেকে চলমান সম্প্রসারণমুলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করায় সেটি অব্যাহত রাখা ছাড়া বাড়তি কিছু করার নেই বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সরবরাহ ব্যবস্থায় গতি বাড়াতে পদ্মা সেতুসহ মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ওই কৌশলপত্রে। এছাড়া সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করার পরামর্শ রয়েছে তাতে।
মন্ত্রণালয় মনে করছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কাঙ্খিত লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে, যা ২০২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধের রাজস্ব সংগ্রহে প্রতিফলিত হয়েছে। এ সময় রপ্তানি ও আমদানির প্রবণতা এবং উৎপাদন বেড়েছে ক্রমাগত এবং বেসরকারি খাতে বেড়েছে ঋণের প্রবাহ।
তবে বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি, টাকার দাম পড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে উৎপাদন খরচ বাড়া এবং আন্তর্জাতিক ফ্রেইট খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয় কর্মকর্তারা। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সীমিত আয়ের মানুষ।
ভর্তুকি চাপ কমাতে স্থানীয় বাজারে দাম না বাড়ালে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। এই প্রেক্ষাপটে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আর্থিক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থবিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ভর্তুকির চাপ কমাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে অর্থনীতিতে তার প্রভাব কেমন হবে এবং সেটা কিভাবে পূরণ করা সম্ভব হবে, সেসব নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছে। কিন্তু তারা এখনও কোনো চূড়ান্তে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি।
তিনি বলেন, সেচের ৫৩ শতাংশ ডিজেল ও ৪৭ শতাংশ বিদ্যুৎনির্ভর। ডিজেলের মূল্য বাড়ানোর পর যদি বিদ্যুতের মূল্যও বাড়ে, তাতে আগামী বোরো মৌসুমে যাতে নেতিবাচক প্রভাব না পরে, সেজন্য কৃষকদের লক্ষ্যভিত্তিক প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ছোট-বড় সব ধরনের রপ্তানি খাতের জন্য প্রণোদনা রয়েছে। রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনক। তবে আন্তর্জাতিক ফ্রেইট খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় আমদানির মতো রপ্তানিতেও ব্যয় বাড়ছে।
ফলে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্বেও কোনো কোনো খাতে রপ্তানি এখনও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে।
সার্বিক দিক বিবেচনা করে রপ্তানিকারকদের জন্য পৃথক একটি প্রণোদনা প্যাকেজ প্রণয়নের পরিকল্পনা নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির প্রাক্বলন ৫.৫ শতাংশ থেকে ৫.৭ শতাংশ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৬.০৫ শতাংশ হয়েছে। শীত কমে গেলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়তে পারে।
এ অবস্থায় দরিদ্রপ্রবণ ৬০টি উপজেলার কর্মহীন দরিদ্রদের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসৃজন কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে।
এছাড়া ৩০ শতাংশের বেশি দারিদ্র্য হার থাকা ৬০ উপজেলার দরিদ্র কর্মহীনদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচির জন্য পৃথক প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনা করার কথাও জানান ওই কর্মকর্তা।