পরামর্শক নিয়োগ বিলম্বে পাইপলাইনে আটকে আছে ৫ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১.২৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণ

দেশের হাই-টেক পার্কগুলোর জন্য ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরি এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নেওয়া বাংলাদেশ প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ডিজিটাল অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ প্রজেক্টে বিশ্বব্যাংক ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন দেয় ২০২০ সালের জুনে।
চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ডিসেম্বরে এ ঋণের মেয়াদ শেষ হবে। কিন্ত পরামর্শক নিয়োগ জটিলতায় এখনও এই ঋণের ৪১৮.৬৬ মিলিয়ন ডলার ছাড় হয়নি, যা মোট ঋণের ৮৬ শতাংশ।
দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, কিন্তু প্রতিশ্রুতির বড় অংশই ছাড় করানো যায়নি, এমন ছয়টি প্রকল্প চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে পাঁচ প্রকল্পের ৮৬ শতাংশ থেকে ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত ঋণের অর্থছাড় হয়নি। এই পাঁচ প্রকল্পে নিট প্রতিশ্রুতি ১.৩৯ বিলিয়ন ডলার। ছাড় হয়নি ১.২৯ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
কর্মকর্তারা পরামর্শক নিয়োগে চ্যালেঞ্জ ও ক্রয় জটিলতাকে মূল বাধা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এসব কারণে বাস্তবায়ন ধীরগতি এবং অর্থছাড়ে বিলম্ব হচ্ছে। এসব বাধা গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন উদ্যোগগুলো সময়মতো সম্পন্ন করার জন্য হুমকিস্বরূপ।
পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মো. মামুন-আল-রশীদ বলেন, পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র দলিল তৈরি এবং পরামর্শক তৈরিতে টার্মস অভ রেফারেন্স তৈরিতে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এটাই পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিলম্বের মূল কারণ।
'প্রকল্প পরিচালকরা স্টাডি করেন না। প্রকল্প প্রস্তাবও পড়ে দেখেন না,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে বিলম্ব হওয়ার আরেকটি কারণ, সংস্থাটির নিজস্ব ক্রয়নীতি রয়েছে। এটি অনুসরণ করতে গিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়।
ডিজিটাল অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক টিবিএসকে জানান, দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় এই প্রকল্পের অর্থছাড় কম।
'প্রকল্পটি শুরু করতে দেরি হয়েছে। প্রকল্পের ক্রয় পরামর্শক নিয়োগেও দেরি হয়েছে। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের অনেক রেগুলেশন রয়েছে, সেগুলো অনুসরণ করতে হয়েছে এবং তারপর দরপত্র ডকুমেন্ট তৈরি করতে হয়েছে। এতে অনেক সময় চলে গেছে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, এই প্রকল্পে অনেকগুলো বড় আকারের দরপত্র রয়েছে। অন্যান্য প্রকল্পের মতো এসব ক্রয়কাজের মূল্যায়ন সহজ নয়। দরপত্র মূল্যায়নের প্রতিটি পর্যায়ে অংশগ্রহণকারীদের জানাতে হয়েছে। এগুলো করতেই অনেক সময় লেগেছে।
পাইপলাইনে পড়ে আছে ৯.৫৯ মিলিয়ন ডলার
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশে মোট চলমান প্রকল্পের সংখ্যা ৫৩টি। এসব প্রকল্পে সক্রিয় পোর্টফোলিও হলো ১৫.৯৯ বিলিয়ন ডলার। আর পাইপলাইনে পড়ে আছে বা ছাড় হয়নি ৯.৫৯ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একজন ঊধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিশ্বব্যাংকে ৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছাড় না হওয়ার কথা বলা হলেও ২০২৬ সালের ডিসম্বের পর্যন্ত যেসব ঋণের মেয়াদ শেষ হবে, সেগুলো হিসাব করলে ছাড় না হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ২.৮৯ বিলিয়ন ডলার। আর ২০৩১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব ঋণের মেয়াদ রয়েছে, সেগুলো ধরলে ছাড় না হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় 9 বিলিয়ন ডলার।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিশ্ববাংক যে তারিখে ঋণ অনুমোদন দেয়, সে তারিখকে বিবেচনায় নিয়ে ছাড় না করা অর্থের পরিমাণ হিসাব করে। অন্যদিকে কোনো প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ঋণ অনুমোদের পর তা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন হয়। তারপর ঋণচুক্তি হয়ে।
প্রকল্প অনুমোদনে পর প্রশাসনিক অনুমোদন ও প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করতে আবার এক-দেড় বছর সময় লাগে। আবার পরামর্শক নিয়োগে কোনো কোনো সময় দুই থেকে তিন বছর লাগে। ফলে শুরুর দিকে অর্থছাড় কম থাকে।
এক দশকের পুরনো প্রকল্প
এছাড়া ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংকের অনুমোদন পাওয়া বাংলাদেশ মডার্ন ফুড স্টোরেজ অ্যান্ড ফ্যাসিলিটিজ প্রজেক্টে এখনও পর্যন্ত ৭২.৭০ মিলিয়ন ডলার অর্থ পাইপলাইনে পড়ে আছে।
এই প্রকল্পে প্রতিশ্রুত ৪১২ মিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে ১১ বছরে ১৮.৮ শতাংশ ঋণ ছাড় হয়নি এখনও। এই প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জের খাদ্য গুদাম নির্মাণ করছে খাদ্য অধিদপ্তর।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, দরপত্র জটিলতায় ১১ বছরেও এ প্রকল্পের পুরো অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি।
আরও যেসব প্রকল্পের ঋণছাড় আটকে
ক্লাইমেট-স্মার্ট এগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টে গত সাড়ে ৩ বছরে বিশ্বব্যাংকের ৯৫ মিলিয়ন ডলারের নিট প্রতিশ্রুতির মাত্র ৮.৯ মিলিয়ন ডলার ছাড় করা হয়েছে। ফলে এ ঋণের ৯১ শতাংশ অর্থ অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
প্রকল্প পরিচালক খন্দকার মোহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার টিবিএসকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অংশে ডিজাইন ও সুপারভিশনের জন্য পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হয়েছে।
'পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে প্রক্রিয়াগত জটিলতা ছিল। এতে বাকি কাজ আটকে থাকায় অর্থছাড় হচ্ছে ধীর গতিতে,' বলেন তিনি।
এদিকে চার বছরেও দরপত্র প্রক্রিয়াতেই যেতে পারেনি হায়ার এডুকেশন অ্যাকসেলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক ১৯১.২৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করে ২০২১ সালের ২৪ জুন। এই প্রকল্পে ৯০.৫ শতাংশ ঋণ এখনও ছাড় হয়নি।
এ প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক আসদুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নে এই ঋণ ব্যবহার করা হবে। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চাহিদা প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে। আগামী জুনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাহিদা মূল্যায়নের পর ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ করা হবে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের বাংলাদেশ রোড সেফটি প্রজেক্টে বিশ্বব্যাংকের ৩৫৮ মিলিয়ন ডলারের ঋণ বোর্ড সভায় অনুমোদন পায় ২০২২ সালের মার্চে।
এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আমানুল্লাহ, টিবিএসকে বলেন, প্রকল্পটিতে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক সময় লেগেছে। এ কারণে প্রকল্পটি ২০২৩ সালে বাস্তবায়ন করা শুরু হলেও অর্থছাড় কম।