এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত সংকটাপন্ন ৪ ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিতে চাইছে ঢাকা উত্তর

বিতর্কিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন থাকা চার শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আমানতের ২৯ কোটি টাকা ফেরত দিতে পারছে না। কিছু কিছু আমানত উত্তলনের জন্য পে-অর্ডার পেলেও নগদ টাকা এখনও পায়নি সিটি কর্পোরেশন। মূলত তারল্য সংকটের কারণে আমানত ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
সাম্প্রতি আমানতের টাকা ফেরত না পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বরাবর চিঠি দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। যদিও এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
ব্যাংক চারটি হলো— গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের দুটি শাখায় এফডিআরের চার কোটি টাকা উত্তলনের জন্য গত ১০ জুলাই আবেদন করে সিটি কর্পোরেশন। এরপর প্রায় দুই মাসের মধ্যে পে-অর্ডার পেলেও এখন পর্যন্ত ক্যাশ টাকা হাতে পায়নি তারা।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পান্থপথ মহিলা শাখায় আমানতের ৩ কোটি টাকা এবং উত্তরা শাখায় ১ কোটি টাকা পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের চিঠিতে বলা হয়, 'ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে আমানত রেখেছে। এরমধ্যে দুটি ব্যাংক থেকে আমানতের মেয়াদপূর্তিতে পে-অর্ডার পাওয়া গেলও নগদায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া, অন্য দুটি ব্যাংকের কাছে আমানতের মেয়াদপূর্তিতে নগদায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহে পত্র প্রেরণ, বারবার যোগাযোগের পরও অদ্যবধি পে-অর্ডার পাওয়া যায়নি।'
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম টিবিএসকে বলেন,, "আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে– যে সকল ব্যাংকে লাভ বেশি, সেসব ব্যাংকে টাকা রাখার। তাই আমরা ঐ ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে সরকারি ব্যাংকে রাখবো। তবে এখন টাকা তুলতে না পেরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর চিঠি দিয়েছি।"
"এখনও চিঠির জবাব পাইনি। চিঠিতে যে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাংকগুলোতে সেই পরিমাণ টাকাই রাখা আছে," যোগ করেন তিনি।
চিঠিতে দেখা যায়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মোহাম্মদপুর শাখায় উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ফিক্সড ডিপোজিট ছিল ১০ কোটি টাকা। ডিপোজিটের মেয়াদপূর্তিকে টাকা উত্তলনের জন্য আবেদন করা হয় গত ১০ জুলাই। এই ব্যাংক থেকেও পে-অর্ডার পাওয়া গেলেও নগদায়ন করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বিশ্বরোড শাখায় ১০ কোটি টাকার দুটি এফডিআর ছিল। এই ব্যাংকটি এখন পর্যন্ত গ্রাহককে পে-অর্ডার দেয়নি।
একইসঙ্গে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের প্রগতি সরণি শাখায় ডিপোজিট ছিল ৫ কোটি টাকা। সেখানেও গত ১৯ সেপ্টেম্বর আবেদন করে এখন পর্যন্ত পে-অর্ডার পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য মুঠোফোন একাধিকবার চেষ্টা করা করেও উল্লিখিত চার ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ঋণ জালিয়াতি ও নানা অনিয়োমের কারণে গত দুই বছর যাবৎ তীব্র তারল্য সংকটে রয়েছে দেশের প্রায় ১২টি ব্যাংক। এরমধ্যে শেখ হাসিনার আমলে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল ৮টি ব্যাংক।
এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোতে শেখ হাসিনার পতনের পর তারল্য সংকট আরও প্রকট হয়েছে। কারণ ব্যাংকগুলোতে কী পরিমাণ জাল-জালিয়াতি হয়েছে, তার বেশ কিছু চিত্র পরবর্তীতে বেরিয়েছে এসেছে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাংকগুলো নিয়ে আস্থা কমে যাওয়া, গ্রাহকরা তারল্য তোলা শুরু করেন। ব্যাংকগুলোয় নতুন করে আমানত রাখার বদলে, গ্রাহকের আমানত তোলার পরিমাণ বেড়েছে। ফলে তীব্র হয়েছে তারল্য সংকট।
যদিও ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে তারল্য গ্যারান্টি দিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এখন পর্যন্ত ৭টি ব্যাংক প্রথম একমাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি পেয়েছে প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তথ্য বলছে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটিড পেয়েছে ১,৪৯৫ কোটি টাকা; সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১,০০০ কোটি টাকা; গ্লোবাল ইসলামী ২৯৫ কোটি টাকা; ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭৭৫ কোটি টাকা; ইউনিয়ন ব্যাংক ১৫০ কোটি টাকা এবং ন্যাশনাল ব্যাংক পেয়েছে ৮২০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি নয়টি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা কারেন্ট অ্যাকউন্ট ঘাটতিতে পড়েছে প্রায় ১৮,০০০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক সবচেয়ে বেশি ৭,২৬৯.৬৬ কোটি টাকা ঘাটতি নিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে; অন্যদিকে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ৩,৩৯৪ কোটি টাকা এবং ন্যাশনাল ব্যাংক ২,৩৪২ কোটি টাকা ঘাটতিতে রয়েছে।
এছাড়া, ইউনিয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ২,২০৯.১৫ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ২,২০১.৯৫ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৮০.৯৫ কোটি এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ৩৯.৩৯ কোটি টাকা।
এছাড়া, পদ্মা ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক যথাক্রমে ২৩৪.৪৮ কোটি টাকা এবং ৯৫.৪২ কোটি টাকা ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে।