বাংলাদেশে নৌ-বিমা: ০.৩০% ন্যূনতম প্রিমিয়ামে ক্ষতিগ্রস্ত আমদানিকারক, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা

দেশের নৌ-বিমা খাতে বর্তমানে ন্যূনতম প্রিমিয়াম হার ০.৩০ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক হারের তুলনায় অস্বাভাবিক রকমের বেশি। এর ফলে ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ঘাড়ে গিয়েই চাপছে বলে জানান বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তারা।
তারা বলছেন, বিমা প্রিমিয়ামের ন্যূনতম হার নির্ধারণ বিদ্যমান মুক্তবাজার অর্থনীতি ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আন্তর্জাতিক হারের চেয়ে অনেক বেশি ন্যূনতম হার নির্ধারণের করার মাধ্যমের প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে মত দেন তারা।
এছাড়া বাংলাদেশ ছাড়া এরকম বিমার ন্যূনতম হার নির্ধারণ কোনো দেশেই নেই। বাংলাদেশে যেখানে ন্যূনতম প্রিমিয়াম হার ০.৩০ শতাংশ, আন্তর্জাতিক বিমা বাজারে সেটি ০.০১ শতাংশ থেকে ০.১ শতাংশের মধ্যে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানেও একই হার।
বাংলাদেশ মেরিটাইম ল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক মেরিটাইম আইনে ন্যূনতম প্রিমিয়াম হার নির্ধারণের বিষয়ে কিছু বলা নেই। উন্নত দেশগুলোতেও ন্যূনতম হার নির্ধারণ করা হয় না। বিমার বাজার সবসময় মুক্ত থাকে। বাংলাদেশে ন্যূনতম হার নির্ধারণে প্রতিযোগিতার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
'এছাড়া বাংলাদেশে নৌ-বিমার প্রিমিয়াম হার তুলনামূলক বেশি। আমদানি খাতের এই ব্যয় ভার শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকে বহন করতে হয়।'
বাংলাদেশের আমদানি নীতি অনুযায়ী, দেশীয় কোম্পানির কাছেই নৌ-বিমা করতে হয়।
সেন্ট্রাল রেটিং কমিটির (সিআরসি) সুপারিশের ভিত্তিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সাধারণ বিমার প্রিমিয়ামের হার, সুযোগ-সুবিধা ও শর্তসমূহ নির্ধারণ করে। দেশের নৌ-বিমার প্রিমিয়ামের ন্যূনতম হারও তারা নির্ধারণ করে থাকে।
নৌ-বিমায় ঝুঁকি বিবেচনায় ইন্সটিটিউট কার্গো ক্লজেস (আইসিসি) অনুসারে তিন ক্যাটাগরির বিমার প্রচলন আছে।
২০২০ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ মেরিন ট্যারিফ শুল্ক সংশোধনের মাধ্যমে পুনরায় নৌ-বিমার প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ করে আইডিআরএ। সেখানে আইসিসি-এ ক্যাটাগরিতে ০.৪৫ শতাংশের সঙ্গে অন্যান্য পলিসি যুক্ত, আইসিসি-বি ক্যাটাগরিতে ০.৪৫ শতাংশে এবং আইসিসি-সি ক্যাটাগরিতে ০.৩০ শতাংশে বিমা প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা সাধারণত সবচেয়ে কম খরচের ক্যাটাগরি, অর্থাৎ আইসিসি-সি গ্রহণ করে থাকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের আমদানির বিপরীতে দেশের বিমা কোম্পানিগুলো ঝুঁকি বণ্টন করতে বিদেশি কোম্পানির কাছে গ্রাহকের বিমার বিপরীতে পুনঃবিমা করে। সেক্ষেত্রে গ্রাহক থেকে মাত্র ০.০৫ শতাংশ প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বিদেশি বিমা কোম্পানির কাছ থেকে সরাসরি বিমা পলিসি গ্রহণের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএপিএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন টিবিএসকে বলেন, 'মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সর্বনিম্ন হার নির্ধারণ করা হলে সেবাগ্রহীতা ও দাতার মধ্যে দর কষাকষির সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসবে। প্রতিযোগিতার পরিবেশ থাকবে না।'
অবশ্য বিভিন্ন খাতে সর্বোচ্চ সেবামূল্য নির্ধারণের চর্চা রয়েছে বলে জানান তিনি। 'যেমন বাপা থেকে আমরা প্রতি আমদানি চালানের বিপরীতে লোকাল ডেলিভারি চার্জ সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছি।'
আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, 'আইন অনুযায়ী ক্ষমতাবলে প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ করে আইডিআরএ। প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ করা হয় বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে। হার নির্ধারণ করার সময় আন্তর্জাতিক বিষয়াদিও বিবেচনা করা হয়। হার নিয়ে আপত্তি থাকলে ভবিষ্যতে হালনাগাদ করা হবে।'
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে বছরে ৮০ বিলিয়ন ডলারের মতো আমদানি বাণিজ্য হয়, যার বড় একটি অংশই হয় সমুদ্রপথে। ফলে বছরে নৌ-বিমায় প্রায় ২৪০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয় আমদানিকারকদের।
আইডিআরএর বিরুদ্ধে বিএসআরএমের মামলা
বিমা প্রিমিয়ামের ন্যূনতম হার নির্ধারণ করায় প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ এনে আইডিআরএর বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রতিযোগিতা কমিশনের একটি মামলা দায়ের করে ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম।
মামলায় বলা হয়, ন্যূনতম হার নির্ধারণের ফলে বিমা কোম্পানির মধ্যে বাজারের কোনো প্রতিযোগিতা নেই। দেশের বাজারের প্রচলিত ন্যূনতম হার আন্তর্জাতিক প্রিমিয়াম হারের চেয়ে অনেক বেশি।
মামলায় আইডিআরএর মতামত চাওয়া হলে সংস্থাটি বলে, ঝুঁকির অভিজ্ঞতা, প্রবণতা ও অন্যান্য ব্যয়সহ প্রাসঙ্গিক বিষয় বিবেচনা করে প্রিমিয়ামের হার নির্ধারণ করা হয়। ২০২০ সালে মেরিন ট্যারিফ শুল্ক সংশোধনের মাধ্যমে প্রিমিয়ামের গত হার ২২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশের মতো ছোট বাজারে দেশীয় কোম্পানির কাছে বিমা সেবার বাধ্যবাধকতা বন্ধ করলে বিমা সংস্থাগুলো তাদের বাধ্যবাধকতাগুলো পালন করতে অক্ষম হবে বলেও উল্লেখ করে আইডিআরএ।
২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর দেওয়া চূড়ান্ত আদেশে বলা হয়, নৌ-বিমার বিদ্যমান নির্ধারিত হার সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতাপূর্ণ নয় বলে বিবেচিত হয়। নৌ-বিমার হার প্রতিযোগিতাপূর্ণ করার লক্ষ্যে আইডিআরএ এবং সেন্ট্রাল রেটিং কমিটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
রায়ে আরও বলা হয়, বিমা বাজারকে প্রতিযোগিতামূলক করার প্রয়োজনে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকা প্রয়োজন। এ পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোম্পানির বরাবরে বিশেষ রেট ধার্য করা এবং বিমা ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে কমিশন দেওয়া ও নেওয়ার চলমান প্রথার বিষয়ে বিমা আইন, ২০১০ এবং বিমা উন্নয়ন ও কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১০ এবং বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ সেন্ট্রাল রেটিং কমিটি প্রবিধানমালা, ২০১২ এর বিধানাবলী বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং সেন্ট্রাল রেটিং কমিটি কর্তৃক যথাযথভাবে অনুসরণ করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
বিশেষ হার সুবিধা প্রত্যাহার
নথিপত্রের তথ্যমতে, ২০০০ সালে বাংলাদেশ মেরিন ট্যারিফ শুল্ক প্রণয়নের মাধ্যমে নৌ-বিমার প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ করেছিল আইডিআরএ।
ওই সময় আইসিসি-এ ক্যাটাগরিতে ০.৭০ শতাংশের সঙ্গে অন্যান্য পলিসি যুক্ত, আইসিসি-বি ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে আগত নৌ-যানের জন্য ০.৭০ শতাংশ ও অন্যান্য সমুদ্র বন্দরের জন্য ০.৮০ শতাংশ এবং আইসিসি-সি ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে আগত নৌ-যানের জন্য ০.৫০ শতাংশ ও অন্যান্য সমুদ্র বন্দরের জন্য ০.৬০ শতাংশ বিমা প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ করা হয়েছিল।
তখন বড় আমদানিকারকদের আবেদনের ভিত্তিতে ২০০৭ সালে বিএসআরএম, পিএইচপি, আবুল খায়ের গ্রুপের মতো বেশ কয়েকটি কোম্পানির জন্য প্রিমিয়াম হারে বিশেষ রেট ঘোষণা করা হয়। আইসিসি-এ-তে ০.৫৫ শতাংশ, আইসিসি-বি-তে ০.২০ শতাংশ ও আইসিসি-সি-তে ০.১৫ শতাংশ বিশেষ রেট নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এ বিষয়ে হাইকোর্টে রিটও করেছে বিএসআরএম।
বিএসআরএম-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির আলিহোসাইন টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের প্রচুর পরিমাণে আমদানিকৃত পণ্য রয়েছে এবং আমরা একটি স্বনামধন্য কোম্পানি। আমাদের সুখ্যাতি এবং ন্যূনতম ঝুঁকির কারণে বিমা কোম্পানি আমাদের যুক্তিসংগত প্রিমিয়াম দিতে পারে। কিন্তু ন্যূনতম প্রিমিয়াম নির্ধারণের ফলে কাঁচামাল আমদানি করতে বিমার জন্য আমাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা অযৌক্তিক।'