আগামী বাজেটে আগের মতোই ঋণের সুদ, ভর্তুকিতে বরাদ্দ বাড়ছে

আগামী বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ, ভর্তুকি ও সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়তে চলেছে, যদিও আরো ভালোভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এসব খাতে ব্যয় কমানোর শর্ত দিয়েছে।
বাজেটে মোট ৭.৬৪ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা সাজিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যা বুধবার (১০ মে) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হবে।
সার্বিক বাজেটে ১৪ শতাংশ বরাদ্দ বাড়লেও, অন্যান্য নির্বাচনী বছরের বাজেটের মতো নতুন কোন চমক থাকছে না ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে। কারণ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি)-তে বরাদ্দ মাত্র ১১ শতাংশ বাড়তে পারে।
আগামী বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় এডিপি অনুমোদন দেওয়া হবে।
অন্যদিকে, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় চলমান ১২২টি কর্মসূচিতে সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছর বরাদ্দ বাড়ছে মাত্র ৫,০০০ কোটি টাকা, যার একটি অংশ ব্যয় হবে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন পরিশোধে।
এমনকী উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পুরনো কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দেওয়া ছাড়া আর্থিক নীতিতে নতুন কোন পদক্ষেপ থাকছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুরোপুরি মুদ্রানীতির ওপর ভরসা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় আগামী অর্থবছরের ব্যয় বরাদ্দের বিভাজন তুলে ধরবে অর্থ বিভাগ। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কোন নির্দেশনা পাওয়া গেলে, সে অনুযায়ী ব্যয় বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হবে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার, কোনখাতে কতো বরাদ্দ রাখা হবে – তা চূড়ান্ত করতে মঙ্গলবার অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
বৈঠক অংশ নেওয়া অর্থ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এবার অনেকটা সংকোচনমূলক ও গতানুগতিক বাজেট হচ্ছে। সরকারের চলমান কৃচ্ছ্রসাধনের চেষ্টা আগামী অর্থবছরও থাকবে। অন্যান্য নির্বাচনী বছরের বাজেটে যেভাবে জনতুষ্টির অর্জনের জন্য নতুন নতুন কর্মসূচি নেওয়া হয়, এবার তেমনটি থাকছে না।
'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলেও – ওএমএস পরিচালনা কিংবা দরিদ্রদের সহায়তা দেওয়ার মতো কিছু সুযোগ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে বিশেষ কোন অস্ত্র নেই। তাই মুদ্রানীতির মাধ্যমেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠেয় সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর তা তুলে ধরবেন'- জানান বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৬.৫%। যদিও গত এপ্রিল মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.২৪% এবং গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮.৬৪%।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সর্বোচ্চ ৪১% বরাদ্দ বাড়ছে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। চলতি অর্থবছর এখাতে বরাদ্দ আছে ১৭,০০০ কোটি টাকা, আগামী অর্থবছর তা বেড়ে ২৪,০০০ কোটি টাকা হতে পারে।
সার্বিকভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের সুদ ব্যয়ে বরাদ্দ থাকছে ১.০২ লাখ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণের সুদ ছাড়াও এখান থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণের সুদ, সঞ্চয়পত্রের সুদের একটা অংশ এবং ট্রেজারি বন্ডের ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয়। চলতি অর্থবছর এখাতে বরাদ্দ রয়েছে ৮০,৩৭৫ কোটি টাকা।
আইএমএফ এর চাপে সরকার গ্যাস, বিদ্যুত ও সারের দাম বাড়িয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে বিদ্যুতের দাম আরও একবার বাড়ানো হবে বলে আইএমএফকে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেপ্টেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। তারপরও চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকিতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। তবে বাড়তি বরাদ্দের অর্থ চলতি অর্থবছরের ভর্তুকির বকেয়া পরিশোধে ব্যয় হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকিতে বরাদ্দ রয়েছে ১.০২ লাখ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর এটি বেড়ে ১.১০ লাখ কোটি টাকা হতে পারে। বিপুল ভর্তুকির মধ্যে বিদ্যুৎখাতে বরাদ্দ থাকছে ৩৩,০০০ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকিতে ১৭,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, পরে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৩,০০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
সব ধরণের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানোর ফলে আগামী অর্থবছর কৃষি খাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা কমবে বলে হিসাব করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছর এখাতের ভর্তুকিতে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে।
আগামী অর্থবছর কৃষিখাতে ভর্তুকিতে ১৭,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকতে পারে বলে জানা গেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যা ছিল ১৬,০০০ কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে অতিরিক্ত ১০,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সরকারের শেষ বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নতুন করে ৭.৩৫ লাখ বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া, প্রায় এক দশক পর আগামী অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে। এতে নতুন অর্থবছর এখাতে অতিরিক্ত ১,৫২৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে যে ৭.৩৫ লাখ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আসবে, তার মধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়বে ৫.৩৫ লাখ। এছাড়া, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে এক লাখ করে।
একইসঙ্গে বয়স্কভাতার উপকারভোগীদের মাসিক ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হচ্ছে। এছাড়া, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের মাসিক ভাতার পরিমাণ ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে।