বহু ব্যবসায় প্রণোদনা পৌঁছেনি এখনো

করোনাভাইরাস বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার ঘোষিত ২১টি প্যাকেজের অধীনে দেওয়া ১.২২ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ৫৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে দাবি অর্থ মন্ত্রণালয়ের।
তবে এসএমইসহ দেশের প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নে এ প্যাকেজ খুব বেশি কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে অভিযোগ করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি দেশের উৎপাদন ও সেবা খাতের উদ্যোক্তাদের বড় অংশই এ প্যাকেজ থেকে সুবিধা পাননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর জন্য সরকারের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, দুর্নীতি ও ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতাকে দায়ি করছেন অর্থনীবিদরা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সরকারের অর্থ বিভাগ আয়োজিত 'স্টিমুলাস প্যাকেজেস ফর সাসটেইনেবল অ্যান্ড ইনক্লুসিভ রিকভারি ফ্রম কোভিড-১৯ ফলআউট ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে এসব বিষয় উঠে আসে।
এ পর্বের থিম ছিল, 'জব রিটেনশন, রিস্টোরেশন অব ডিমান্ড অ্যান্ড মেইনটেইন দ্য সাপ্লাই চেইন'।
এ আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং বিশেষ অতিথি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। অন্যদিকে, মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার।
আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ড. রুবানা হক, সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, বাংলাদেশ ও ভুটানে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি মিয়াং টেমবন এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি।
মূল প্রবন্ধে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, 'কোভিড-১৯ দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রয়েছে। এখন পর্যন্ত এ ঋণের ৫৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।' তবে এসএমই ও কৃষি ঋণ বিতরণে ধীর গতির কথা স্বীকার করেছেন অর্থসচিব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২ শতাংশ সুদে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন রপ্তানিকারকরা। বড় শিল্পের জন্য বরাদ্দকৃত ৩৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে অক্টোবর শেষে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা।
তবে এসএমইখাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হয়েছে।
অন্যদিকে, ৩ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে মাত্র ২৭৬ কোটি টাকার কৃষি ঋণ এবং কৃষি খাতের ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে ৪৯৭ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
এসএমই ও কৃষি খাতে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন নিয়ে হতাশা উঠে আসে নাজনীন আহমেদের বক্তব্যে।
তিনি বলেন, 'আমি ১৫০ জন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের অধিকাংশই এখনো সরকারের সুবিধা পাননি।' তবে এনজিও, কর্মসংস্থান ব্যাংক এবং পিকেএসএফের মাধ্যমে বিতরণ ঋণে কিছুটা সফলতার কথা তুলে ধরেন তিনি।
'প্রণোদনা প্যাকেজের অধীনে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে ৫০ বিলিয়ন টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এখন পর্যন্ত ২৫ বিলিয়ন টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ টাকা পেয়েছেন প্রায় ৪৪ হাজার মানুষ। তারা প্রান্তিক। স্বত্বভোগীপ্রতি ঋণের পরিমাণ ৪৮ হাজার টাকার মতো। গবাদি পশু পালন, মৎস চাষ, পোল্ট্রি ও বৃক্ষরোপনসহ বিভিন্ন কাজে তারা এই টাকা বিনিয়োগ করেছেন। টাকার পরিমাণ খুব বেশি না হলেও তা এই প্রান্তিক মানুষদের কাজে লেগেছে,' বলেন তিনি।
প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা কাগজে থাকলেও বড় শিল্প ছাড়া বাকিরা এখনো বেশ পিছিয়ে রয়েছে বলে জানান সেলিম রায়হান।
সানেমের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৭% ব্যবসা সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে কোনো টাকা পায়নি; অন্যদিকে, ৯% কোম্পানি স্বত্বাধিকারীরা এই প্যাকেজ সম্পর্কে জানেনই না।
জরিপে অংশ নেওয়া ৩০১টি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রণোদনা পেয়েছে ৮%; অন্যদিকে ৪৪টি মাঝারি আকৃতির প্রতিষ্ঠানের মধ্য ফান্ড পেয়েছে ২০%।
জরিপে অংশ নেওয়া ১৫৬টি বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রণোদনা ফান্ড পেয়েছে ৪১%। অবশ্য, প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, অর্থবছরের পূর্ববর্তী প্রান্তিকের তুলনায় এ প্রান্তিকে ফান্ড পাওয়া সহজ।
সরকারের প্রণোদনা সঠিকভাবে না পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন প্রধান মন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসও।
তিনি বলেন, 'অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ রিকভারিতে অনেক ভালো ভূমিকা রেখেছে। তবে সব কিছু শতভাগ হওয়া আমাদের দেশে সম্ভব নয়। কিছু সমস্যা রয়েছে, তা সমাধানে আমরা চেষ্টা করছি।'
প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা রপ্তানি খাত সবচেয়ে ভালোভাবে পেলেও এ খাতের সমস্যা তুলে ধরেন রুবানা হক।
তিনি বলেন, 'ইউরোপসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে অক্টোবরে নেগেটিভ গ্রোথ দেখেছি আমরা। করোনার সেকেন্ড ওয়েভের আশঙ্কায় এটি আরও বাড়বে। তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় আশঙ্কার জায়গা তৈরি পোশাকের প্রাইস ড্রপ।'
গত তিন বছরে গড়ে ১.৮০ শতাংশ হারে প্রাইস ড্রপ ও চলতি বছরে তা ৫.২৩ শতাংশে উন্নীত হওয়ার আশঙ্কা করেন তিনি।
অন্যদিকে, তৈরি পোশাকের জন্য দেওয়া প্রণোদনা প্যাকেজের জন্যই এ খাত টিকে থাকতে পেরেছে বলে উল্লেখ করেন বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সী।
তিনি বলেন, 'আমরা যদি আমাদের ব্যবসা কার্যক্রম চালিয়ে নিই, তাহলে আমাদের মানুষেরা টাকা পাবেন এবং দেশের সার্বিক অর্থনীতির চাকা গতিশীল থাকবে।'