করোনা ও বন্যায় টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প অস্তিত্ব সঙ্কটে

টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প করোনা ভাইরাস ও সাম্প্রতিক বন্যায় হুমকির মুখে পড়ে গেছে। গত ২৬ মার্চ থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত করোনায় টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পে ২৫০ কোটি ৭১ লাখ ১৩ হাজার ২০০টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তাঁত শিল্পের দুর্দিন শুরু হয় করোনা প্রাদুর্ভাবের পরই। ভাইরাসের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকারি নির্দেশনায় সব কল-কারখানা-ফ্যাক্টরি বন্ধ ঘোষণা করায় চালু তাঁত ফ্যাক্টরিগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিসিকের হিসেব মতে, জেলার তাঁতশিল্পে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৮৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪০০টাকা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে থাকে। সর্বশেষ আঘাত হয়ে এসেছে বন্যা।
বন্যায় তাঁতশিল্পের তাঁত, কাপড়, তানা ও অন্য সরঞ্জামাদী সহ সবকিছু ভাসিয়ে নিয়েছে। প্রায় দেড় মাস ধরে পানি থাকায় তাঁতশিল্পের কাঁচামাল বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। প্রতিবছর ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয়। সারা বছরের খরচ পুষিয়ে নিয়ে লাভ উঠে আসে দুই ঈদে। সে আশা পূরণ হয়নি। করোনার কারণে টাঙ্গাইল শাড়ী বিদেশেও রপ্তানি গত চার মাস যাবত সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
লকডাউনের কারণে ঢাকাসহ দেশের শপিংমলগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় তাঁত শাড়ীর নতুন কোনো অর্ডার নাই। লকডাউন তুলে নেওয়ার পরেও কেনা কাটায় ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়েনি, ফলে তাঁতীদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এবারের কোরবানীর ঈদও মন্দাতেই পার হয়েছে। তাই ব্যবসা আর আগের পর্যায়ে যেতে পারছে না। এর ফলে অনেক টাঙ্গাইল শাড়ীর ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
বিসিকের তাঁত অঞ্চল
তাঁত বোর্ডের টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতীর বল্লায় বিসিকের একটি শাখা রয়েছে, এর আওতায় আছে: ঘাটাইল, মধুপুর, ধনবাড়ী, গোপালপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলার তাঁত। আর সদর উপজেলার বাজিতপুর বেসিক সেন্টারের অধীনে আছে দেলদুয়ার, বাসাইল, মির্জাপুর, নাগরপুর, সখীপুর।
তাঁত বোর্ডের কালিহাতির-বল্লা বিসিক সেন্টারের ৪৯টি প্রাথমিক তাঁতী সমিতি এবং ৪টি মাধ্যমিক তাঁতি সমিতির ৪ হাজার ৩৯১টি তাঁত কারখানা মালিকের ২৭ হাজার ৯৩১টি তাঁত চালু আছে। ২ হাজার ৬৭৩টি তাঁত আগে থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে অর্থাভাবে। করোনায় বন্ধ হওয়া এসব কারখানায় পুরো বিনিয়োগ নষ্ট হয়ে গেছে। আর চালু কারখানা সর্বশেষ ক্ষতির শিকার হল বন্যার। পানি এসে ফ্যাক্টরিতে চালু তাঁত, তাঁতে থাকা সুতার ভিম, কাপড় ও অন্য সরঞ্জামাদি বিনষ্ট হয়েছে, এতে বিনিয়োগ ও অসমাপ্ত কাজও আর তোলা যাবে না।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাজিতপুর বিসিক সেন্টারের ৩২টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি ও তিনটি মাধ্যমিক সমিতির দুই হাজার ২৬৭ তাঁত মালিকের মোট ১২ হাজার ৪২৯টি তাঁত রয়েছে। এরমধ্যে ২ হাজার ৬৭৩টি তাঁত আগে থেকেই বন্ধ বা উৎপাদনে নেই । চালু আছে ৯ হাজার ৭৫৬টি তাঁত ।
বিসিকের এই সেন্টারের তাঁতগুলোতে মূলত মিহি সুতার ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি হয়। বিসিক সূত্রের হিসাব অনুযায়ী করোনা মহামারির কারণে সরকারি নির্দেশনা মেনে বন্ধ রাখায় প্রতি তাঁতে ৮০০ টাকা হারে প্রতিদিন গড়ে ৭৮ লাখ ৪ হাজার ৮০০টাকা ক্ষতি হয়েছে। এখন বন্যার কারণে অধিকাংশ কারখানা বন্ধ।
কালিহাতী সেন্টারের আওতাধীন ১৭টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি ও একটি মাধ্যমিক তাঁতী সমিতির অধীনে আছে আরও দুই হাজার ১২৪টি তাঁত কারখানার ১৮ হাজার ১৭৫টি তাঁত। এসব তাঁতে মোটা সুতার শাড়ি বানানো হয়।
বিসিকের সেন্টারের হিসাব মতে, গত মার্চের ২৬ তারিখ থেকে করোনার কারণে ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় প্রতিটি তাঁতে দৈনিক ন্যূনতম ৬০০ টাকা হারে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৯ লাখ ৫ হাজার টাকা করে ক্ষতি হয়েছে।
সব মৌসুমই গেল, বিক্রি নেই
টাঙ্গাইলের তাঁত মালিক, শ্রমিক, বিসিক সেন্টারের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন তাঁত শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে। শাড়ি ব্যবসার সেরা মৌসুম হল, পয়লা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ও দুর্গাপুজা। পয়লা বৈশাখে কোনো শাড়ি বিক্রি হয়নি। ঈদুল ফিতররে মাড়ি বিক্রি হয়নি। ঈদুল আযহায়ও কেউ নতুন শাড়ি নেয়নি। এই উৎসবগুলোর জন্য যেসব শাড়ি আগেই তৈরি করে মজুদ করা ছিল সেগুলোও বিক্রি হয়নি। বৈশাখে শাড়ির উৎপাদনে ১০৭ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। শাড়ি প্রতি গড়ে ১০০টাকা লাভে বিক্রি হলে ৮ কোটি ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকার মত লাভ হত। ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে দামি শাড়ি তৈরি ও বেশি শাড়ি বিক্রি হয়। কিন্তু বৈশাখের অভিজ্ঞতায় ঈদুল ফিতরে শাড়ি উৎপাদনে কোন লক্ষ্যমাত্রাই নির্ধারণ করা হয়নি।
একই অবস্থা গেল ঈদুল আযহায়ও। আগামী দুর্গাপুজায়ও এই অবস্থা বদলানোর কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তাঁত মালিকরা।

'সরকারী সাহায্য পেলেইও কি দাঁড়াতে পারব?'
তাঁত চালিয়ে আর চলা যাবে না, তাঁত বন্ধ কোনো আয় উপার্জন নেই। নিঃশ্ব তাঁত শ্রমিক ও মালিকরা অনেকেই পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছে। কেউ কেউ পৈত্রিক পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় গিয়ে ইতিমধ্যে সুবিধা করতে না পেরে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। এখনও যারা পেশা পরিবর্তন করেননি তারা মনে করছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠে- লোকসান পুষিয়ে আর উঠে দাঁড়ানো যাবে না।
টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী পাথরাইলের তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ী নীল কমল বসাক জানান, করোনা ও বন্যা তাঁত শিল্পের মহা ক্ষতি করে ফেলেছে। সরকারি প্রণোদনা প্রদানের পাশাপাশি তাঁত শাড়ির বাজার তৈরিতেও সরকারের ভূমিকা নিলে যদি কিছু হয়।
টাঙ্গাইল জেলা তাঁতি লীগের সহ-সভাপতি কালাচাঁদ বসাক জানান, করোনা মহামারি ও বন্যায় টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপাদন ধ্বসে পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ শিল্প আদৌ থাকবে কি-না তাই নিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেছে তারা। যদি সুদমুক্ত ঋণ ও সরকারি প্রণোদনা না পাওয়া যায় তাহলে আর তাঁতি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মোফাখখারুল ইসলাম জানান, করোনা মহামারিরর সাথে বন্যার ভয়াবহতা যোগ হয়ে জেলার তাঁতশিল্পকে অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলেছে। গত ২৬ মার্চ থেকে জেলার সব তাঁত ফ্যাক্টরি বন্ধ। তাঁত মালিক ও এর সাথে জড়িত প্রায় দেড় লাখ মানুষ কর্মহীন অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যারা এক সময় দান-অনুদান বিতরণ করেছে- তারাও এখন নিজেদের পরিবারের মৌলিক চাহিদা পুরণ করতে পারছেনা। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে তাঁতিদের উৎপাদিত পণ্য ঘরে থেকে বিনষ্ট হচ্ছে, কোথাও বিক্রি হচ্ছেনা। সুদমুক্ত ঋণ ও সরকারি প্রণোদনা ব্যতিত এ সঙ্কট থেকে তাঁতিদের মুক্তির পথ নেই।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বল্লা (কালিহাতী) বিসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মো. ইমরানুল হক বলেন, 'এখানকার তাঁতিরা সাধারণত মোটা সুতায় তৈরি শাড়ি উৎপাদন করে। করোনার সাথে বন্যা যোগ হয়ে এ শিল্পে মহাদুর্যোগের সৃষ্টি হয়েছে। ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় একদিকে উৎপাদন নাই, অন্যদিকে প্রতিটি তাঁতি পরিবার চরম অর্থাভাবে পড়ে গেছে।'
তাঁত বোর্ড ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করছেন। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ এতো বেশি যে সামান্য এই ঋণ তাঁতিদের তেমন কোনো উপকারে আসছে না। মো. ইমরানুল হক তাঁতিদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনকে তালিকা পাঠিয়েছেন বলে জানান।
টাঙ্গাইল সদরের বাজিতপুর বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, তারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতীদের মাত্র ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছেন। সরকারি নির্দেশনার বাইরে তাদের কাজ করার সুযোগ নেই। শাড়ি উৎপাদন ও বাজারজাত করণ কিংবা নতুন বাজার সৃষ্টিতে তাঁতীদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি জানান, মূলত করোনা ও বন্যায় তাঁতশিল্পকে ধসের মুখে ফেলেছে। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারলেও করোনা পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ শিল্প মহাসঙ্কটে পড়বে।