ইভ্যালির কাছে মার্চেন্টদের পাওনা ২০৬ কোটি টাকা

বিতর্কিত ই-কমার্স প্লাটফর্ম ইভ্যালির কাছে মার্চেন্টদের পাওনার পরিমাণ ২০৬ কোটি টাকা বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল। তবে কতটি মার্চেন্ট এর কাছে কোম্পানিটির এই দেনা সৃষ্টি হয়েছে, কিংবা কতদিনের মধ্যে দেনা পরিশোধ করবে ইভ্যালি- সে সম্পর্কে কিছুই বলেননি তিনি।
মার্চেন্টদের পাওনা কতোদিনের মধ্যে পরিশোধ করার পরিকল্পনা রয়েছে- বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এ প্রশ্নের কোন জবাব দেননি মোহাম্মদ রাসেল। বরং মার্চেন্টদের কাছে এই পরিমাণ দেনাকে 'স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য' বলে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন তিনি।
কাস্টমারদের ৩১১ কোটি টাকা দেনা পরিশোধ সম্পর্কে ইভ্যালি বলেছে, স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করার পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পেলে আগামী পাঁচ মাসে পরিশোধ করা হবে।
এই সময়ের মধ্যে নতুন বিনিয়োগ না পেলে কাস্টমারদের পাওনা পরিশোধের জন্য ইভ্যালি কি পদক্ষেপ নেবে- টিবিএসের এমন প্রশ্নের কোন জবাব দেননি কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
গত জুলাই মাসে নিজের ফেসবুক পেইজে যমুনা গ্রুপের কাছ থেকে ১,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ পাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন মোহাম্মদ রাসেল। তবে যমুনা গ্রুপের গ্রুপ পরিচালক মনিকা ইসলাম গত সপ্তাহে টিবিএসকে জানান, ইভ্যালিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ টিবিএসকে বলেন, ইভ্যালির বিষয়ে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে শিগগিরই বৈঠকে বসবে এ বিষয়ে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি।
মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান ও অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, সরকার কাস্টমার ও মার্চেন্টদের স্বার্থ রক্ষাকে প্রথম ও দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে। এর পরে কোম্পানির ভবিষ্যতের বিষয়টি বিবেচনা করবেন তারা।
মার্চেন্টদের পাওনা সম্পর্কে ইভ্যালি লিখেছে, ইভ্যালি সরাসরি উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকদের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে। এসব মার্চেন্ট গড়ে ন্যূনতম ১৫-২০% হারে মুনাফা করে। তাই, যে অর্থ দেনা হিসেবে আছে, তা অতি স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য।
'কোভিড মহামারির দুঃসময়ে মার্চেন্টরা ইভ্যালির মাধ্যমে অত্যন্ত সহজভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে উপকৃত হয়েছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনা করতে তাদের মজুদ রাখা, বিক্রয় ও বিপণন, বিক্রয় ও প্রদর্শন কেন্দ্র পরিচালনায় অনেক ব্যয় হয়, যা এক্ষেত্রে সাশ্রয় করে অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারে'- জানিয়েছেন রাসেল।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য নিয়ে পণ্য বিক্রি করলেও মার্চেন্টদের পাওনা পরিশোধ না করায় গত জুন থেকে বেশিরভাগ সরবরাহকারীই ইভ্যালিকে বাকিতে পণ্য দেওয়া বন্ধ রেখেছে। ফলে টি-১০ অফারে কিছু ক্রেতা অর্ডার করলেও, তা সময়মত সরবরাহ করতে পারছে না কোম্পানিটি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও মার্চেন্টরা ইভ্যালিকে পণ্য দেওয়া বন্ধ রাখায় দেড় মাসেও অনেক ক্রেতা পণ্য পাচ্ছেন না বলে টিবিএসের কাছে অভিযোগ করেছেন।
গত সপ্তাহে এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ রাসেল টিবিএসকে বলেছিলেন, টি-১০ এর টাকা পেমেন্ট গেটওয়েতে ব্লক থাকে। ফলে সব পণ্য নগদ টাকায় কিনে ক্রেতাদের সরবরাহ করতে হচ্ছে। এ কারণে কিছু ক্ষেত্রে পণ্য ডেলিভারি করতে দেরি হয়।
'এটা হওয়া স্বাভাবিক। নতুন বিনিয়োগ না পাওয়া পর্যন্ত সাপ্লায়ারদের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করবে। সময়ের ব্যবধানে এটি ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা করছি'- জানান তিনি।
গত জুন মাস থেকে ইভ্যালি তার কর্মীদের বেতন-ভাতাও পরিশোধ করছে না। বরং কর্মীদের চাকরি ছাড়তে নানাভাবে চাপ দিচ্ছে কোম্পানিটি।
ইভ্যালির নিজস্ব হিসাবেই কোম্পানিটির মোট সম্পদের মূল্য ১২১ কোটি টাকার বিপরীতে দায়ের পরিমাণ ৫৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ইভ্যালির সব সম্পদ বিক্রি করলে কাস্টমার ও মার্চেন্টদের পাওনার মাত্র ২২ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব।
গত জানুয়ারি থেকে ক্রেতারা যেসব পন্যের অর্ডার দিয়ে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করেছেন, সেগুলো ডেলিভারি করতে পারছে না ইভ্যালি। সময়মত পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হয়ে যেসব ক্রেতাকে রিফান্ড চেক দিয়েছিল ইভ্যালি, ব্যাংকে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স না থাকায় সেগুলো ক্যাশ হচ্ছে না। এ অবস্থায় অনেক ক্রেতা ফেসবুক পোস্টে কম মূল্যে ইভ্যালির দেওয়া চেক বিক্রির জন্য স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।
মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ইভ্যালি ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম নিয়েছে। কিন্তু মার্চেন্টদের কাছেও দেনা রয়েছে। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি অর্থ স্থানান্তর বা মানি লন্ডারিং করে থাকতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা তদন্ত করে দেখছে।
ইভ্যালির পক্ষে পক্ষে বড় ধরনের বিনিয়োগ পাওয়া কিংবা ব্যবসা করে মুনাফা থেকে দায় পরিশোধ করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রেক্ষাপটে ক্রেতা ও মার্চেন্টদের স্বার্থ রক্ষায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে চলতি সপ্তাহেই আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইভ্যালির ক্রেতাদের বিভিন্ন গ্রুপের এডমিনদের সঙ্গে গত সপ্তাহে বৈঠক করেছেন মোহাম্মদ রাসেল। তিনি ক্রেতাদের বলেছেন, নতুন বিনিয়োগকারী পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন তিনি। তবে এই সময়ে ইভ্যালির বিরুদ্ধে নেতিবাচক কমেন্ট ও স্ট্যাটাস দেওয়া থেকে ক্রেতাদের বিরত থাকতে অনুরোধ করেছেন।
'আমি ফেসবুক পোস্টে ইভ্যালির সাইটে ভিজিটরের তথ্য তুলে ধরছি, যাতে এগুলো দেখে ইনভেস্টররা আগ্রহী হয়। নতুন ইনভেস্টর না পেলে পুরনো অর্ডারের পণ্য ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব নয়'- ক্রেতাদের জানিয়েছেন তিনি।