আমদানির চলতি হিসাব ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত কমেছে ৪৫ শতাংশ
আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এক মাসের ব্যবধানে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরের তুলনায় জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বৈদেশিক বাণিজ্যে চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (কারেন্ট একাউন্ট ব্যালেন্স) উদ্বৃত্ত প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে চলতি হিসাব ভারসাম্যের উদ্বৃত্ত ছিল ৪.৩২ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, জুলাই-জানুয়ারিতে তা নেমে এসেছে ২.২৪ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ এক মাসে কমেছে ৪৫ শতাংশের বেশি।
যদিও গেল অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি এই সাত মাসে চলতি হিসাব ভারসাম্যের উদ্বৃত্ত নয় বরং ঘাটতি ছিল ১.৮ বিলিয়ন ডলার।
সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত ব্যালেন্স অব পেমেন্ট প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জানুয়ারি মাসে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি সামান্য হ্রাস হওয়া চলতি হিসাব ভারসাম্যের উদ্বৃত্ত কমেছে।
চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২৫.২৩ বিলিয়ন ডলারের আমদানি ব্যয় জুলাই-জানুয়ারিতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.৯২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ জানুয়ারি মাসেই আমদানি বেড়েছে ৬.৬৯ বিলিয়ন ডলার।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্য এবং জ্বালানি ও সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এছাড়া রেমিটেন্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধিও কমেছে। এসবের প্রভাবে কারেন্ট একাউন্ট ব্যালেন্সের উদ্বৃত্ত কমে আসছে।
জুলাই-জানুয়ারি সময়ে আমদানি ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই সাত মাসে ভোগ্যপণ্য, চাল, গম এবং পণ্য উৎপদানে ব্যবহার করা মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। তবে হ্রাস পেয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি।
সরকারের চালের মজুদ কমে যাওয়ায় আমদানি বাড়ানো হয়েছে। এতে জুলাই-জানুয়ারি সময়ে এ বাবদ আমদানি ব্যয় হয়েছে ২৭৫ মিলিয়ন ডলার, যা গেল অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ গুণ বেশি।
অন্যদিকে ক্রুড পেট্রোলিয়াম (অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম) আমদানি বাবদ চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ব্যয় হয়েছে ২.৩ বিলিয়ন ডলার, যা গেল অর্থ বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ গুণ বেশি।
গেল বছর মহামারির প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যের যে ভয়াবহ পতন হয়েছিল তা কাটিয়ে এখন দাম বাড়তে শুরু করেছে।ডিসেম্বরে যেখানে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের (ক্রুড অয়েল) দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৪৫ ডলার, জানুয়ারির শেষে তা ৫২ ডলার ছাড়িয়েছে। ৮ই মার্চ সোমবার এই দাম ৬৭ ডলার ছুঁই ছুঁই করেছে।
এছাড়া সয়াবিন তেল, রাসায়নিক, ওষুধ তৈরির কাঁচামাল ও কাপড় রং করার রাসায়নিক আমদানি বেড়েছে। তবে তুলা, সুতা, আয়রন ও স্টিল আমদানি কমেছে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি বিশ্লেষণের অন্যতম সূচক মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি)। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) এ খাতে আমদানি ব্যয় ছিল ৬.৬ বিলিয়ন ডলার। যা গেল অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম।
এদিকে বিনিয়োগের আরেক সূচক সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে হতাশা কাটছে না। জুলাই-জানুয়ারি সময়ে নিট এফডিআই ২৭ শতাংশের বেশি কমে দাঁড়িয়েছে ৫৩০ মিলিয়ন ডলার।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মহামারির প্রকোপ কমে আসা ও টিকাদান শুরু হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা গতি আসতে শুরু করায় কারাখানাগুলো উৎপাদেন যাচ্ছে।
"এজন্য শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়ছে। তবে করোনার অনিশ্চয়তা এখনো না কাটায় নতুন বিনিয়োগে যেতে চাইছেন না উদ্যোক্তারা। এজন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ও বিদেশি বিনিয়োগ কমছে।"বলেন তিনি।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি এই সাত মাসে রেমিটেন্স আয় গেল অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া একই সময়ে নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশিদের দেশে বিনিয়োগ ১৫.৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৯ মিলিয়ন ডলার।
তবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে তারা শেয়ার বিক্রি করে ১৮০ মিলিয়ন ডলার উঠিয়ে নিয়েছেন।
চলতি হিসাব ভারসাম্যের উদ্বৃত্ত কমলেও বৈদেশিক লেনদেনের সার্বিক ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট-বিওপি) উদ্বৃত্ত জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বেড়ে ৬.৪১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
একটি দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসে, তার বিপরীতে আমদানি ব্যয়সহ যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায় তার বিয়োগ ফলই হচ্ছে বিওপি। চলতি হিসাব ভারসাম্য বিওপি'র একটি অংশ।
রেমিটেন্স ও বিওপি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ৪২.৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এই পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে প্রায় আট মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা সম্ভব।
গেল ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তবে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ৩ মার্চ রিজার্ভ ৪২.৭৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়।
