যে প্রত্যাবর্তনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আগামী রাজনীতির ভবিষ্যৎ
গত কয়েক দিন ধরেই বিএনপির নেতা-কর্মীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাতা সরগরম। ফেসবুকের ওয়াল থেকে শুরু করে মেসেঞ্জার—সবখানেই ভিডিও, পোস্টার আর ডিজিটাল কার্ডের ছড়াছড়ি। সবার শেয়ার করা পোস্টেই ঘুরেফিরে একটিই স্লোগান—'লিডার আসছে!'
ভার্চ্যুয়াল জগতের এই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে রাজপথেও। রাজধানীর বড় বড় ল্যাম্পপোস্ট থেকে শুরু করে ঢাকার অলিগলি—সর্বত্র ঝুলছে একই বার্তার প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন। প্রিয় নেতাকে একনজর দেখতে এবং রাজসিক সংবর্ধনা দিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় ছুটে আসছেন হাজারো নেতাকর্মী। রাজধানীর পথে পথে এখন যেন মানুষের ঢল।
অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হচ্ছে আজ। প্রায় ১৭ বছরের প্রবাসজীবন বা নির্বাসন কাটিয়ে আজ বৃহস্পতিবার দেশের মাটিতে পা রেখেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সামনের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। ঠিক এমন সময়ে তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কেবল বিএনপির জন্যই নয়, বরং দেশের চলমান রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এই সন্ধিক্ষণেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা অবশ্য বেশ আত্মবিশ্বাসী। তাঁরা জোরগলায়ই বলছেন, আসন্ন নির্বাচনে ধানের শীষের ভূমিধস বিজয় হবে। আর সেই বিজয়ের হাত ধরেই প্রায় দুই যুগ পর ক্ষমতার কেন্দ্রে ফিরবে বিএনপি, যার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হাল ধরবেন তারেক রহমান।
১৯৭৮ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে বিএনপির যাত্রা শুরুর পর দলটির ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকার নজির আর নেই। নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে পারলে ক্ষমতার বাইরে থাকার দীর্ঘ এই খরার অবসান ঘটবে। তবে তারেক রহমানকে ঘিরে নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা যেমন আকাশচুম্বী, তেমনি তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জের পাহাড়ও নেহাত ছোট নয়।
লন্ডনে প্রবাসজীবনের দীর্ঘ দিনগুলোতে দলকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তারেক রহমান বারবারই নেতাকর্মীদের প্রতি একটি বার্তা দিয়েছেন—আসন্ন নির্বাচন হবে জাতির জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। গত বছরের আগস্টে হাসিনা সরকারের পতনের পর উদ্ভূত রাজনৈতিক ডামাডোল তাঁর সেই সতর্কবার্তাকেই যেন নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ এখন যে নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, তা সম্ভবত এ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় 'অগ্নিপরীক্ষা'। চরম অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক মেরুকরণ আর রাজপথের উত্তপ্ত পরিস্থিতি—সম্ভবত এত বড় বাজি ধরে, কিংবা এত ঝুঁকি নিয়ে কোনো নির্বাচন এ দেশে আগে কখনও হয়নি।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যেদিন তারেক রহমান দেশ ছেড়েছিলেন, আর আজ যেদিন তিনি ফিরছেন—মাঝখানের এই সময়টুকুতে বদলে গেছে অনেক কিছুই। দুই সময়ের বাস্তবতার মধ্যে তৈরি হয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের কয়েক মাস আগে যখন তাঁকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই নির্বাসনে যেতে হয়েছিল, তখনো দেশে দলের হাল শক্ত হাতে ধরে রেখেছিলেন তাঁর মা, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ২০১১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলনে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
এরপরের ইতিহাস শুধুই নজিরবিহীন দমন-পীড়নের। হাজারো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হয়েছে মামলা, জেল খেটেছেন অসংখ্য মানুষ। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে যেতে হয় খালেদা জিয়াকেও। ফলে সে বছরের নির্বাচনে তিনি অযোগ্য ঘোষিত হন—যে নির্বাচনটি রাজনৈতিক অঙ্গনে 'রাতের ভোট' বা 'মধ্যরাতের নির্বাচন' হিসেবেই বেশি পরিচিতি পায়।
বন্দী অবস্থায় খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে। বিএনপির দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ও ত্যাগের এক জীবন্ত প্রতীক হয়ে তিনি আজ হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী, লড়ছেন এক কঠিন লড়াই।
অথচ খালেদা জিয়ার নিজের রাজনৈতিক পথচলা ছিল আপসহীন ও সংগ্রামমুখর। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ভেঙে পড়া দলকে তিনি নতুন করে গড়ে তুলেছেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও শেখ হাসিনার মতো দুই শাসকের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে বিএনপিকে তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় এনেছেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় নেতৃত্বের দায়িত্ব এখন তারেক রহমানের হাতে। মায়ের কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে প্রবাসে বসেই তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। দীর্ঘ সময় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তাঁর অভাব তীব্রভাবে অনুভব করেছেন, তাই দীর্ঘ বিরতির পর তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দলের কর্মীদের কাছে এক গভীর আবেগের মুহূর্তও বটে।
গত বছরের আগস্টে হাসিনা সরকারের পতন এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর দৃশ্যত মাঠ ফাঁকাই ছিল। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, বিএনপির ক্ষমতায় ফেরাটা বুঝি এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা. কিন্তু গত ১৬ মাসে সেই 'সরল সমীকরণ' ক্রমেই জটিল হয়ে উঠেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীলতার দিকে মোড় নিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে মব সহিংসতা, সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং দুটি জাতীয় দৈনিকের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনা—দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে গভীর শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক তো বটেই, খোদ বিএনপির নেতারাও এখন শঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, পটপরিবর্তনের পর কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা ও 'ডেমোক্রেসির' বদলে দেশ কি তবে 'মবোক্রেসি'র দিকে ঝুঁকছে?
পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে জামায়াতে ইসলামীর অভাবনীয় পুনরুত্থান। একসময়ের জোটসঙ্গী এখন বিএনপির প্রধান নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০০১ সালে যে চারদলীয় জোটের শরিক হিসেবে জামায়াত ক্ষমতায় এসেছিল, আজ তারাই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বড় বড় সমাবেশ করে নিজেদের শক্তির জানান দিচ্ছে। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে জামায়াত আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে দেখছে নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর 'সেরা সুযোগ' হিসেবে। ফলে রাজনীতির মাঠে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে বিএনপির মুখোমুখি এখন সরাসরি জামায়াত।
অনিশ্চয়তার এই ঘনঘটার মধ্যেই প্রশ্ন উঠছে—নির্বাচন কি যথাসময়ে হবে? যদি হয়, তা কি আদৌ অবাধ ও সুষ্ঠু হবে? তারেক রহমানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ কাটছে না দলের অন্দরে। তবুও বিএনপি নেতারা আশাবাদী। তাঁরা মনে করছেন, দীর্ঘ বিরতির পর নেতার সশরীরে উপস্থিতি দলের তৃণমূলকে নতুন করে উজ্জীবিত করবে। একই সঙ্গে অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির সমর্থন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের চাপ বজায় রাখতেও তাঁর উপস্থিতি নিয়ামক ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। চারপাশের এই অস্থিরতা যেমন শঙ্কার, তেমনি তা তারেক রহমানের জন্য নিজেকে প্রমাণ করার এক বড় সুযোগও বটে। তিনি কি কেবল পটপরিবর্তনের সুফলভোগী হবেন, নাকি দলীয় রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে একজন বিশ্বাসযোগ্য রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন—সেই সিদ্ধান্ত এখন তাঁর হাতে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি বারবার 'প্রতিহিংসার রাজনীতি' অবসানের কথা বলেছেন। জোর দিয়েছেন জাতীয় ঐক্যের ওপর। তাঁর কথায় স্পষ্ট, তিনি অতীতের বিবাদ জিইয়ে না রেখে ভবিষ্যতের দিকেই তাকাতে চান।
দেশে ফিরে তারেক রহমান মূলত দুটি রাজনৈতিক কৌশল বা প্রস্তাবনা নিয়ে এগোতে চাইছেন। এর প্রথমটি হলো তারুণ্যনির্ভর এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন। আসন্ন ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রায় ৪ কোটি নতুন ভোটার প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, যা মোট ভোটারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাছে টানতে চান তিনি। তাই তাঁর পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা সংস্কার, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তরুণদের ভাষা ও আকাঙ্ক্ষা বুঝেই তিনি সাজাচ্ছেন তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।
দ্বিতীয় এবং অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়টি হলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বয়ান। বিগত হাসিনা সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে, যেখানে অন্যদের অবদান ছিল প্রায় উপেক্ষিত। কিন্তু গত বছরের পটপরিবর্তনের পর দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে। এখন জামায়াত ও তাদের সমমনা কিছু দল ইতিহাসের এমন কিছু ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে, যাকে অনেকে ইতিহাসের বিকৃতি হিসেবেই দেখছেন।
তারেক রহমান ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা ইতিহাসের এই নতুন মেরুকরণের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, একপেশে ইতিহাস যেমন কাম্য নয়, তেমনি বিকৃত ইতিহাসও গ্রহণযোগ্য নয়। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা এবং তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণাকে সামনে এনে বিএনপি ১৯৭১-এর 'প্রকৃত ইতিহাস' রক্ষার ওপর জোর দিচ্ছে।
নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলেও, আসল লড়াইটা শুরু হবে তার পর থেকেই। দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এতটাই দুর্বল যে সেগুলোর কাঠামো নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতির চাকাকে কিছুটা স্থিতিশীল করতে পারলেও প্রশাসনের বড় অংশজুড়েই নেমে এসেছে স্থবিরতা। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, বিগত বছরগুলোর লাগামহীন লুটপাট আর দুর্নীতির ক্ষত সারিয়ে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে অন্তত চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে।
তারেক রহমান যদি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার মসনদে বসেনও, তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে এমন এক বাংলাদেশকে পাবেন—যা আক্ষরিক অর্থেই বিপর্যস্ত। এখানে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ফেরানো, প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করা কিংবা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কোনো 'জাদুকরী সমাধান' বা শর্টকাট রাস্তা নেই। নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হয়তো দলকে চাঙ্গা করবে, কর্মীদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করবে; কিন্তু এক বিভক্ত ও ক্ষতবিক্ষত জাতিকে একসূত্রে গেঁথে রাষ্ট্র পরিচালনা করাই হবে তাঁর নেতৃত্বের আসল পরীক্ষা।
