বাংলাদেশের নির্বাচন কেন বিভাগ অনুসারে বিভিন্ন দিনে করা সম্ভব নয়?

প্রতিবেশী ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে চলছে নির্বাচন। সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন এখন তৃতীয় ধাপে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে প্রায় রাজ্যগুলোতে কয়েক ধাপে নির্বাচন করে থাকে কিন্তু ফল ঘোষণা করে একদিনে। সেদিক থেকে বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে ৪০৩টি আসনের মধ্যে ১৩০টি আসনে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় উত্তরপ্রদেশ রাজ্যটি ব্রিটিশ শাসকরা প্রদেশ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন ১৯৩৭ সালের পয়লা এপ্রিল। তখন নাম ছিল যুক্তপ্রদেশ, যে নাম পাল্টে ১৯৫০ সাল থেকে নাম হয়েছে উত্তরপ্রদেশ। ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা তাজমহল এ রাজ্যের আওতাধীন। রাজ্যটির নির্বাচন ভারতীয় কেন্দ্রীয় লোকসভার নির্বাচনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। বেশ কিছুকাল যাবত উত্তরপ্রদেশ কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এতটা ভূমিকা রেখেছে যে, দেখা গেছে- উত্তরপ্রদেশে বিজয় মানে কেন্দ্রে লোকসভায় বিজয়।
ফরেস্ট রেঞ্জারের সন্তান অংক শাস্ত্রের গ্রাজুয়েট অজয় মোহন বিস্তের বর্তমান নাম যোগী আদিত্যনাথ। নব্বইয়ের দশকের রাম মন্দির আন্দোলন থেকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। মাত্র ২৬ বছর বয়সে উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর নামক আসন থেকে ভারতের ১২তম লোকসভা নির্বাচনে সর্বকনিষ্ঠ লোকসভা সদস্য নির্বাচিত হন। টানা পাঁচবার এই আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন যোগী আদিত্যনাথ। কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা যোগী আদিত্যনাথ এই প্রদেশের এক মহীরুহ হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। চেহারার বৈশিষ্ট্য এবং মাথায় চুল কামানো অসাধারণ মিল খুঁজে পাওয়া যায় মার্কিন অভিনেতা মার্ক সিনক্লেয়ার সাথে। উত্তর ভারতের বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও যোগী আদিত্যনাথ যেভাবে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন- তাতে কেন্দ্রের নেতৃত্ব দারুণ অস্বস্তির মধ্যে আছে। বিশেষ করে মোদি-অমিত জুটি। বিগত পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে মোদি-অমিত শাহ জুটি যোগী আদিত্যনাথকে নিয়ে পশ্চিমবাংলায় যে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন- তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
পশ্চিমবাংলার ক্ষমতা বিজেপির দখলে নিতে না পারলেও তাদের দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সহযাত্রী মমতা ব্যানার্জি সুনিপুণভাবে পশ্চিমবাংলার রাজনীতি থেকে কংগ্রেস ও বাম জোটকে বিদায় করতে পেরেছেন। যদিও নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমে যে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবাংলা রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন তার অন্যতম সহযাত্রী ছিল শুভেন্দু অধিকারী। সেই প্রাক্তন সহযোগী বন্ধু শুভেন্দু অধিকারীকে মমতা ব্যানার্জি হারিয়েছেন বিজেপির হিন্দুত্ববাদীদের কাছে। এমনকি নন্দীগ্রাম আসনে মমতা ব্যানার্জি নিজেও পরাজিত হয়েছেন শুভেন্দু অধিকারীর কাছে। যোগী আদিত্যনাথ, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ'র হাত ধরে এখন শুভেন্দু অধিকারী বিজেপি নেতা।
আদিত্যনাথ এর জনপ্রিয়তায় দারুণভাবে শঙ্কিত মোদি অমিত শাহ জুটি। ৪০৩টি আসনের মধ্যে যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে বিজেপি এ রাজ্যে বর্তমানে ৩১২টি আসন নিয়ে রাজ্য শাসন করছে। যোগী আদিত্যনাথের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অখিলেশ যাদবের দল পেয়েছিল ৪৭টি আসন। আর মায়াবতীর দল পেয়েছিল ২৭টি। অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি এবারের নির্বাচনে জোটবদ্ধ না হলেও কংগ্রেসের সমর্থন পেয়েছে। গত নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৭টি আসন। এমনকি দীর্ঘকালের রায়বেরেলি আসনটিও কংগ্রেস হারিয়েছিল সেই নির্বাচনে।
গত নির্বাচনে যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হবেন কি না- তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা ছিল। মোদির ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কেন্দ্রীয় সরকার যোগী আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন দিতে বাধ্য হয়েছিল। তেমনি এবারও যোগী আদিত্যনাথের দল বিজেপি উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে জয়লাভ করলেও আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন কিনা সে আলোচনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। দুই দফার নির্বাচনে জল্পনা চলছে বিজেপি কতগুলো আসন হারাচ্ছে? আপাত হিসেবে দেখা যায় সামগ্রিকভাবে যদি ১০০ আসন হারায় তাহলেও বিজেপি ক্ষমতায় থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যোগী আদিত্যনাথ এবারও তৃতীয় বারের মতন মুখ্যমন্ত্রী হবেন কিনা? যোগী আদিত্যনাথ যদি তৃতীয় বারের মতন ক্ষমতায় আসেন তাহলে কেন্দ্রে মোদি-অমিত শাহ জুটির জন্য সেটি একটি অশনিসংকেত হতে পারে। কারণ যোগী আদিত্যনাথ কেন্দ্রের দিকে হাত প্রসারিত করবেন। সেটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর পদ একাধিকবার ধরে রাখার মধ্য দিয়েই নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন। যোগী আদিত্যনাথের ব্যক্তিগত সততা ভারতীয় রাজনীতিতে বিরল ঘটনা। ব্যক্তিগত সততার প্রশ্নে যোগী আদিত্যনাথ মানুষের কাছে শতভাগ সৎ হিসেবেই পরিচিত। যার ফলে রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের ১০০ পুলিশ অফিসারকে বরখাস্ত করার শক্তি অর্জন করেছিলেন যোগী আদিত্যনাথ। উত্তরপ্রদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক সহিংসতা, সামাজিক বিভাজন বিরাজমান। ঠাকুর-দলিত সম্পর্ক রাজ্যটিকে নতুনভাবে বিভাজিত করেছ। এ সবের মধ্যেও যোগী আদিত্যনাথ তার ব্যক্তিগত সততার কারণে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখেছেন।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে যোগী আদিত্যনাথের তেমন কোনো সার্থকতা দেখা যায়নি। মহামারি নিয়ন্ত্রণেও ব্যাপক ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে এই রাজ্যটিতে। করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে সৎকারবিহীন অবস্থায়। গ্রামের মহিলাদের জন্য বিনা পয়সায় অথবা সস্তায় খাদ্য রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা ছাড়া তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সার্থকতা নাই। তরুণ সমাজের মধ্যে ব্যাপক আস্থার অভাব কর্মসংস্থানের অভাবে। জাতপাতের সমস্যা। যোগী আদিত্যনাথ ব্রাহ্মণ বংশধর ঠাকুর পরিবার। যোগী আদিত্যনাথের সময়কাল দলিত-অবহেলিত উপেক্ষিত হয়েছে নতুন করে। যে কারণে উত্তরপ্রদেশের দলিত শ্রেণী এখন যোগী আদিত্যনাথ সরকারকে বলছে ঠাকুরদের সরকার। এমনি সব নানান যোগ-বিয়োগের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে ভারতের এই বৃহৎ রাজ্যটির নির্বাচন।
ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে আমাদের একটি বিশেষ শিক্ষণীয় দিক আছে। নিরপেক্ষ এবং কার্যকর নির্বাচন ব্যবস্থা ধরে রাখার জন্য ভারতের রাজ্যগুলোর নির্বাচন, লোকসভার নির্বাচন কয়েক ধাপে ভাগ করে দেওয়া হয়। যেমন উত্তরপ্রদেশের এবারকার নির্বাচন সাত ধাপে সম্পন্ন হবে। এতে করে নির্বাচন সুষ্ঠু করার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। নির্বাচনী ফলাফল একইদিনে প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন ধাপে নির্বাচন ব্যালট/ইভিএম এক স্থানে সংরক্ষণ করা হয়। সেখানে সিসিটিভির আওতাভুক্ত থাকে সমস্ত ব্যালট/ইভিএম। বাক্সবন্দী অবস্থায় রাখা হয় সিসিটিভির পাহারায়। তারপরে যখন ভোটগণনা শুরু হয় তখন সিসিটিভির আওতায় প্রকাশ্যে ভোটগণনা চলতে থাকে। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটগণনা কয়েকদফা করে হয়। এক দফা কিংবা দুই দফায় ভোটগণনা শেষ করা হয় না। কয়েক দফায় সেই ভোটগণনা হয়।
ভারতের রাজ্যগুলোতে বর্তমানে ইভিএম মেশিনে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে। প্রথম দিকে যখন ইভিএম মেশিন চালু করা হয়েছিল তখন এ নিয়ে ভারতের রাজ্যগুলোতেও নানান বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতের নির্বাচন কমিশন সার্থকভাবে নিজেদের এই ইভিএম মেশিননের সার্থকতা ভারতীয় জনগণের কাছে তুলে ধরতে পেরেছে। বর্তমানের নির্বাচনগুলোতে ইভিএম মেশিন নিয়ে আর কোনো বিতর্ক দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে ইভিএম মেশিন এবং সামগ্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার হওয়া দরকার।
উত্তর ভারতের এই রাজ্যের জনসংখ্যা বাংলাদেশের থেকেও বেশি। বর্তমানে সেখানে জনসংখ্যা ২০ কোটির বেশি। সেই বিবেচনায় ৪০৩টি প্রাদেশিক আসনের নির্বাচন সাত দফায় সম্পন্ন করা হচ্ছে- সেখানে বাংলাদেশের ৩০০ আসনের নির্বাচন কেন একদিনে সম্পন্ন করতে হবে? সে প্রশ্ন অবশ্যই করা যেতে পারে। কেন বাংলাদেশের নির্বাচন বিভাগ অনুসারে বিভিন্ন দিনে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়? আমাদের স্থানীয় সরকার বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনেকগুলো ধাপে অনুষ্ঠিত করার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনও সেই আলোকে অনেকগুলো ধাপে করা গেলে নির্বাচনের যেকোনো গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। ভারতের এই শিক্ষা আমরা কাজে লাগাতে পারি।