কপ-২৬: বাংলাদেশের এই নারীর কাছে জলবায়ু সম্মেলনের কোনো অর্থ আছে!

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সবচেয়ে জনবহুল ইউনিয়ন গাবুরা। এখানকার যোগাযোগব্যবস্থা ভীষণ খারাপ। রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয় বেড়িবাঁধ। পাশ দিয়ে চলতে গেলে ভয়ে বুক দুরুদুরু করতে থাকে। বাঁধটার বেশিরভাগ বিলীন হয়ে গেছে নদীগর্ভে।
সেইসঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে লোনা পানি ঢুকে পড়েছে গাবুরায়। এখানকার কূপ আর জমি ভরে উঠছে লোনা সাগরজলে। ফলে উপকূলীয় এই অঞ্চলের মানুষকে টিকে থাকতে হচ্ছে লোনা পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে। এছাড়াও বেড়িবাঁধ ভাঙনের কারণে একসময়ের সবুজ শ্যামল গাবুরা এখন বৃক্ষশূন্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য যে পরিমাণ আর্থিক সাহায্য দরিদ্র দেশগুলোর পাওয়ার কথা ছিল, তা তারা পায়নি।
গাবুরা গ্রামের বাসিন্দা শরবানু খাতুন। ২০০৯ সালের সাইক্লোনের সময় তার স্থান হয় এক আশ্রয়কেন্দ্রে।
গাবুরার দুরবস্থা—এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্দশার কথা—বৈশ্বিক মঞ্চে তুলে ধরার জন্য শরবানুকে আমন্ত্রণ জানায় অক্সফাম।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কপ১৫ জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে শরবানু ডেনমার্কে যান। শরবানুর উপস্থিতিতে সবচেয়ে ধনী দেশগুলো দরিদ্রতম দেশগুলোকে প্রতিশ্রুতি দেয়, ২০২০ সালে তারা দরিদ্র দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য।
সে সময় এই প্রতিশ্রুতিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখা হয়েছিল।
কিন্তু ১২ বছর পরও প্রতিশ্রুত লক্ষ্য পূরণ হয়নি। অবস্থা এখন যেরকম, তাতে ২০২৩ সালের আগে সেই লক্ষ্য আর পূরণ করা সম্ভব হবে না।
শরবানু ও গাবুরার বাসিন্দাদের জন্য এর অর্থ কী?
যৎসামান্য সহায়তা গাবুরার লোকজন পেয়েছে। কিন্তু কোপেনহেগেনে যে পরিমাণ অর্থসাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেই তুলনায় কিছুই দেওয়া হয়নি।

কাদার বাঁধ তৈরির জন্য বালির বস্তা কেনার অর্থ দেওয়া হয়েছে গাবুরাবাসীকে। একটা নতুন স্কুল তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সাইক্লোনের সময় স্কুলটিকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
শরবানু বিবিসিকে বলেন, 'আমরা চারদিক থেকে পানিতে ঘেরা। কিন্তু সেই পানি আমাদের কোনো কাজে লাগে না।'
গাবুরাবাসীকে নিরাপদ খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় এক মাইলের বেশি পথ পায়ে হেঁটে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে রোজ পানি সংগ্রহ করতে যেতে হয় তাদের।
অনেকে নিত্যদিনের কাজকর্মে লবণাক্ত পানি ব্যবহার করায় আক্রান্ত হচ্ছেন চর্মরোগে। বিশেষ করে নোংরা পানিতে ধোয়ামাজার কাজ করতে হয় বলে মহিলারা রোগাক্রান্ত হচ্ছেন বেশি।
এদিকে এ অঞ্চলে নারীদের গর্ভপাতের হারও গেছে বেড়ে। গাবুরার নারীদের লবণাক্ত পানি পানের হার বেড়েছে বলেই তাদের গর্ভপাতের হার বেড়েছে কি না, তা নিয়ে ভাবছেন গবেষকরা।
৪৪ বছর বয়সি শরবানু বলেন, 'আমাদের করণীয় কী, তা বুঝে উঠতে পারছি না। মানুষ যদি আমাদের সাহায্য করে, তাহলে অবস্থা বদলাতে পারে।
'অন্য এলাকায় অভিবাসী হওয়ার মতো টাকাও আমাদের নেই। আমার সন্তানদের দেওয়ার মতো কিছুই আমার কাছে নেই।'
গ্লাসগোতে অংশ নেওয়া বিশ্বনেতাদের কাছে শরবানুর চাওয়া কী? বিশ্বনেতারা গালভরা যেসব প্রতিশ্রুতি দেন, তার কিছুই চান না তিনি। শরবানুদের চাওয়া অতি সামান্য—তাদের ইউনিয়নে একটা শক্তিশালী বাঁধ। সেই বাঁধটা যেন সহজে ভেঙে না যায়।
বাঁধের পাশাপাশি আর একটামাত্র চাওয়া শরবানুদের—নিরাপদ খাবার পানি।
শরবানু আর গালভরা প্রতিশ্রুতি চান না, চান কাজ। তিনি বলেন, 'আমরা প্রচুর ভোগান্তির শিকার হয়েছি—আমি চাই না আমাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের যেন আরও ভোগান্তি পোহাতে না হয়।'
- সূত্র: বিবিসি